উপন্যাসে চরিত্রধারণার রূপান্তর
রফিকউল্লাহ খান
উপন্যাসের শরীরী উপাদানগুলোর মধ্যে চরিত্রের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ শুরু হয় ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। লিও তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়োভস্কি, হেনরি জেমস প্রমুখ ঔপন্যাসিকের মধ্যে উপন্যাসের চরিত্রগত তাৎপর্য প্রথম বহুমাত্রিকরূপ লাভ করে। যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে উপন্যাসের যাত্রাই সূচিত হয় চরিত্রপ্রধান উপন্যাসকে কেন্দ্র করে। ডানিয়েল ডিকোর ‘রবিনসন্ ক্রুশো’ (১৭১৯) ও ‘মল ফ্লান্ডার্স’ (১৯২২); স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা, অথবা ভার্চু রিওয়ার্ডেড’ (১৯৪০) ও ‘ক্লারিশা’ (১৭৪৭/৪৮); হেনরি ফিল্ডিংস-এর ‘টম্ জোনস’ (১৭৪৯) মূলত চরিত্রকেন্দ্রিক উপন্যাস। কিন্তু প্লট বা ঘটনাংশের সঙ্গে চরিত্রের আন্তঃসম্পর্কের শিল্পসূত্র তখনো সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেনি। উপন্যাসে দৃষ্টিকোনের (ঢ়ড়রহঃ ড়ভ ারব)ি নিগূঢ় তাৎপর্য তখনও গুরুত্ববহ হয়ে ওঠেনি ঔপন্যাসিকদের কাছে। ফলে, চরিত্র প্রধান প্লট না হয়ে উপন্যাসগুলো পরিণত হয়েছে চরিত্রের বর্ণনায়। ওই কালের পাঠকের কাছে সেগুলো কালোপযোগী হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। চরিত্রের বস্তু অভিজ্ঞতা এবং বহুমুখী ক্রিয়াশীলতার বর্ণনাই মুখ্য হয়ে উঠেছে সেখানে। এইসব বিবৃতিধর্মী ও ক্রিয়াশীল চরিত্রপ্রাধান্যের মধ্যে পত্রোপন্যাস ‘পামেলা’-তে চরিত্র অনেকটা অক্রিয় (ঢ়ধংংরাব) ও ভাবময় রূপ লাভ করেছে। অবশ্য এই ধরনের উপন্যাসে ব্যক্তি-তথ্য, দিনপঞ্জি ও ঘটনার বহুকেন্দ্রিকতা বাস্তববাদী শিল্পদৃষ্টির পরিচয় বহন করে। ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই ঘটনা প্রধান হতে শুরু করে উপন্যাস। জেন অস্টেন থেকে এই ধারার সূত্রপাত। তাঁর উপন্যাসে পূর্নাবয়ব সত্তারূপ নিয়ে প্লটের বিন্যাস ঘটে। ‘এমা’ উপন্যাসে চরিত্র প্রধান প্লট ভাবনার সূত্রপাত হলেও তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের (জন্ম: ১৭৭৫-মৃত্যু: ১৮১৭) পরিসমাপ্তি সেই সম্ভাবনার গতি স্তব্ধ করে দেয়। শতাব্দীর প্রথমার্ধে জেমস ফেনিসোর কুপার, ন্যাথানিয়েল হথর্ন এবং হারমান মেলভিল মার্কিন উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই নবোদ্ভূত শিল্পমাধ্যমের সম্ভাবনাকে করে তোলে সুদূর প্রসারী।
ভাববস্তু ও অবয়বের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভিক্টোরীয় যুগ শিল্পের ইতিহাসে বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করেছে। এর পূর্ব-প্রান্তে রয়েছে রোম্যান্টিসিজমের সংবেদনশীলতা, অতি-আবেগ, অধরা প্রেমের মাধুরী, মানবসম্পর্কের মনোময় জগৎ, আর বহুচারী রহস্য লোক এবং উত্তর প্রান্তে আধুনিকতা বা মডার্নিজমের মাতৃজরায়ন ও তার বহুবর্ণিল যাত্রালগ্ন। ভিক্টোরীয় সাহিত্য শিল্পের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কেবল ইংরেজি সাহিত্য নয়, ইউরোপ-আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ছাড়িয়ে ব্রিটিশের কলোনিভুক্ত সমাজ ও সংস্কৃতিকেও আলোড়িত করতে সমর্থ হয়। এই কালসীমায় ফরাসি-জার্মান সাহিত্যের আকাশচুম্বী বিস্তার, রুশ কথাশিল্পের নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের ক্ষেত্রে সব মহাকায় বিপ্লবাত্মক ধারণা প্রসার লাভ করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানে চার্লস ডারউইন, দর্শন-সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কার্ল মার্সস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস মনোবিজ্ঞানে উইলিয়ম জেম্স্ ও সিগমুন্ডফ্রয়েড বিপ্লবাত্মক ধারণার জন্ম দেন। এভাবে ভিক্টোরীয় যুগের বহুস্তরীভূত জঠরেই অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয় ধ্বংসের বীজ-নবসম্ভাবনার বৃক্ষ। অর্থ ও পুঁজির মানদন্ডে মানবজীবন ও শ্রেণী সম্পর্কের যৌক্তিক স্বরূপ বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শায়িত (ওফবধষরুবফ) জীবন ও চরিত্রকল্পনা সাহিত্যে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। ভিক্টোরীর তত্বকেন্দ্রিক হওয়ায় চার্লস ডিকেন্সোর মতো সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠা ঔপন্যাসিকও হেনরি জেমস এবং ভার্জিনিয়া উল্ফের রোষানলে পড়েন।
উপন্যাসের চারিত্রনির্দেশক তত্ত্বসমুহ এই ভিক্টোরীয় যুগেই গড়ে উঠতে শুরু করে। ইউরোপ-আমেরিকায় এ সময়ে বেশ কিছু যুগান্তকারী উপন্যাস রচিত হয়-যেগুলো তত্ত্বনিরূপণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ভিক্টোরীয় উপন্যাসতত্ত্বের কাঠামো এর ফলে পরিপূর্ণতা লাভ করে। রেনেসাঁস ও ফরাসি বিপ্লবের বস্তুগত মানববাদকে শিল্পের মুখ্য উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চরিত্রকে অনেকেই উপন্যাসের কেন্দ্রে স্থাপন করেন। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চরিত্র প্রধান উপন্যাসগুলো মূলত বর্ণনায় পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু মানবসত্য প্রকাশের স্বার্থেই চরিত্রের অস্তিত্বরূপ ও ক্রিয়াশীলতা এ-পর্যায়ে ঔপন্যাসিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। যুদ্ধ কিংবা দুঃসাহসী অভিযানের সাফল্য কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রাধান্য নিরূপনের সূচক হিসেবে হারিয়ে ফেলে তার পূর্বতন মাহাত্ম্য।
জীবনের অনুষঙ্গেই শিল্পের বিষয় ও প্রকরণ-নবতর তাৎপর্য লাভ করে। উপন্যাসের মতো ঘটনা, চরিত্র ও ক্রিয়াকেন্দ্রিক শিল্প-আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এই থিসিস অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। সকল মানুষ, রাজনীতি-সক্রিয় নয়। কিন্তু নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের সকল মানুষের ভবিতব্য সেই অঞ্চলের সমাজ, রাজনীতি, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির ক্রিয়াশীলতার ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে, জনসাধারণ, মানুষ বা চরিত্রই হচ্ছে সবকিছুর নিয়ামক। একজন প্রকৃত ঔপন্যাসিকের জীবননীতি ও শিল্পনীতির মূলে যে বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার অঙ্গীকার ক্রিয়াশীল, তা জীবনের প্রতি শিল্পীর বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিরই ফল। এই ধারণা সূত্রেই সম্ভবত ক্রিস্টোফার কডওয়েল বলেছেন: ‘উপন্যাসের এবং বিবর্তনমূলক বিজ্ঞানগুলোর পূর্ণ বিকাশের জন্য এমন কি প্রতিভাবান ব্যক্তির ক্ষেত্রেও মূর্ত অভিজ্ঞতার পরিপক্বতার প্রয়োজন।’ ‘বিবর্তনমূলক বিজ্ঞান’ এবং ‘মূর্ত অভিজ্ঞতা’ শব্দান্ধ দু’টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঔপন্যাসিকের বস্তু-অভিজ্ঞতার মূর্ত রূপ হচ্ছে তাঁর উপন্যাসবিধৃত চরিত্র। আর বিবর্তনক্রম অনুসরণ করেই বহমান সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষ তথা ব্যক্তি এবং তত্ত্বধারণা-চরিত্রধারণা। উপন্যাস-গঠনের উপাদানসমূহের মধ্যে চরিত্রের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন হেনরি জেমস্, উব্লিউ.জে. হার্ভে প্রমুখ ঔপন্যাসিক ও উপন্যাস-তত্ত্ববিদ। হেনরি জেমস্ তাঁর ঞযব অৎঃ ড়ভ ঋরপঃরড়হ (১৮৮৪) প্রবন্ধে চিত্র এবং ঘটনাকে চরিত্রেরই অভিব্যক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। উপন্যাস চড়ৎঃৎধঃ ড়ভ ষধফু তে মনোবাস্তবতার আলোকে তিনি চরিত্র ও পরিপার্শ্বের আন্তঃশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি অতিক্রম করে গেছেন ভিক্টোরীয় উপন্যাসতত্ত্বের প্রথাগত চরিত্রায়ন পদ্ধতি। উপন্যাসের জন্য চরিত্র কতোটা পরম বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য তা তিনি সুস্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন:
ডযবহ ড়হব ংধুং ঢ়রপঃঁৎব ড়হব ংধুং পযধৎধপঃবৎ যিবহ ড়হব ংধুং হড়াবষ ড়হব ংধুং ড়ভ রহপরফবহঃ, ধহফ ঃযব ঃবৎসং সধু নব ঃৎধহংঢ়ড়ংবফ ধঃ রিষষ যিধঃ রং পযধৎধপঃবৎ নঁঃ ঃযব ফবঃবৎসরহধঃরড়হ ড়ভ রহপরফবহঃ? যিধঃ রং রহপরফবহঃ নঁঃ ঃযব রষষঁংঃৎধঃরড়হ ড়ভ পযধৎধপঃবৎ? যিধঃ রং বরঃযবৎ ধ ঢ়রপঃঁৎব ড়ৎ ধ হড়াবষ ঃযধঃ রং ওঃ হড়ঃ ড়ভ পযধৎধপঃবৎ? যিধঃ বষংব ফড় বি ংববশ রহ রঃ ধহফ ভরহফ রহ রঃ? ওঃ রং ধহফ রহপরফবহঃ ভড়ৎ ধ ড়িসবহ ঃড় ংঃধহফ ঁঢ় রিঃয যবৎ যধহফ ৎবংঃরহম ড়হ ধ ঃধনষব ধহফ ষড়ড়শড়ঁঃ ধঃ ুড়ঁ রহ ধ পবৎষরধহ ধিু, ড়ৎ রভ রঃ নব হড়ঃ ধস রহপরফবহঃ ও ঃযরহশ রঃ রিষষ নব যধৎফ ঃড় ংধু যিধঃ রঃ রহ. অঃ ঃযব ংধসব ঃরসব রঃ রং ধহ বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ পযধৎধপঃবৎ.
উল্লেখ্য যে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে চরিত্র ও চরিত্রায়ন সমার্থক নয়। চরিত্র হচ্ছে উপন্যাসবিধৃত ব্যক্তিসত্তা। ঔপন্যাসিকের সৃজনদক্ষতা তার মধ্যে আরোপ করে ব্যক্তিত্ব-বলা যেতে পারে ব্যক্তির হয়ে ওঠার কার্যকারণ সৃষ্টি করে। আর চরিত্রায়ন হলো ঔপন্যাসিকের জীবনার্থ ও শিল্পশৃঙ্খলার নিগূঢ় পদ্ধতি। চরিত্রায়নের এই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিভিন্ন লেখকের অথবা অভিন্ন লেখকের প্রতিটি উপন্যাসের শিল্পস্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করে। এমন কি ঔপন্যাসিকের জীবনসংক্রান্ত বোধ এবং নির্মাণ কৌশলের শৃঙ্খলায় অভিন্ন উপন্যাসে ব্যবহৃত হতে পারে চরিত্রায়নের বিবিধ পদ্ধতি। ঘটনামুখ্য উপন্যাসে চরিত্রের ওপর ঘটনার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জীবনবাস্তবতার শিল্পরূপ হয়ে উঠতে গেলে মানুষ অর্থাৎ চরিত্রকেই প্রাধান্য দিতে হয়। চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে জনজীবন অভিজ্ঞতা, দর্শন ও বিজ্ঞান মনস্কতার ওপর সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতে হয় আধুনিক ঔপন্যাসিককে। ডব্লিউ. জে. হার্ভে-র মতে, গড়ংঃ মৎবধঃ হড়াবষং বীরংঃ ঃড় ৎবাবধষ ধহফ বীঢ়ষড়ৎব পযধৎধপঃবৎ চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও অনুপুঙক্ষ পর্যবেক্ষণশীলতাই মহৎ উপন্যাসকে করে তোলে অস্তিত্বময় ও কালাতিক্রমী। উপন্যাসে চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে যে মানবীয় সম্পর্কের রূপায়ন ঘটে তার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনাভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটে অনেক সময়। আবার কোনো কোনো চরিত্র পাঠককে উদ্বোধিত করে, প্রভাবিত করে এবং স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করে। বিশ্বসাহিত্যে এমন ঔপন্যাসিক-চরিত্রের সংখ্যাও কম নয়, যেগুলো মানুষের আদর্শভাবনা, নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা ও বিচ্ছন্নতাবোধের পরিপূরক হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে ‘রবিন্সন্ ক্রুশো’ থেকে শুরু করে আলবেয়্যর কামু’র ‘আউটসাইডার’ কিংবা স্যামুয়েল বেকেটের ত্রয়ী (সধষষড়ু-সধষড়হব ফরবং-ঞযব ঁহহধসধনষব) উপন্যাসের চরিত্র-ভাবনার রূপান্তরক্রম থেকে তিন শতাব্দীর মানব-অস্তিত্বের মৌল প্রবাহ শনাক্ত করা যেতে পারে। সমাজ-সংস্কৃতি ও আর্থ-উৎপাদন কাঠামো ভেদে তার রূপ হয়তো ভিন্ন, কিন্তু মানুষের বহু স্তরীভূত অস্তিত্বসংরাসের তা বিশ্বায়িত (এষড়নধষরুবফ) অর্কেস্ট্রা হয়ে উঠেছে।
২.
বাংলা উপন্যাসের জন্মলগ্ন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। ১৮৫৮ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে এই সমগ্রতা অন্বেষী শিল্পযাত্রার সূত্রপাত। এ-উপন্যাসের আদর্শ-দ্বন্দ্বের উৎ চরিত্র হলেও এটি চরিত্র প্রধান উপন্যাস নয়। এমনকি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রায় সকল শর্তপূরণকারী ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫) কিংবা ‘সীতারাম’ও (১৮৮৭) নয়। তবে বঙ্কিমচন্দ্র উপলব্ধি করেছিলেন ব্যক্তি-আগ্রাসী সামন্তসমাজ পটভূমিতে মানবহৃদয়ের আকাঙক্ষা, ব্যর্থতাবোধ ও যন্ত্রণার স্বরূপ। তাঁর ‘রজনী’ (১৮৭৭) ও ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৮৮৪) উপন্যাস দু’টির বিষয় ও চরিত্র কল্পনায় স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ ও ‘ক্লারিশা’ উপন্যাসের ছায়াপাত আছে। বাংলা উপন্যাসে চরিত্র প্রধান প্লটের আদি দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘রজনী’ নিঃসন্দেহে বিবেচিত হতে পারে। যেমন, কোনো কোনো বিশ শতকীয় সমালোচক ‘পামেলা’র মধ্যেও লক্ষ্য করেছেন মনোবাস্তবতাধর্মী উপন্যাসের ভ্রুণ-বীজ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আদর্শায়িত বিষয় ও চরিত্রভাবনা ভিক্টোরীয় ঐতিহ্যসূত্রেই ব্রিটিশ কলোনি অন্তর্গত বাঙালি ঔপন্যাসিকরা লাভ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তার নানামুখী টানাপড়েনের উৎসগুলো দক্ষতার সঙ্গে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিছুটা আদর্শনিয়ন্ত্রিত হলেও ব্যক্তিসত্তার স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ও মুক্তচেতনাকে তিনি তাঁর উপন্যাসভাবনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। এমনকি, ‘প্রকৃত’ ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২) তেও তিনি ব্যক্তিসন্ধানী। উনিশ শতকের পরজীবী, অপুষ্ট, গণতান্ত্রিক সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্তের ব্যক্তিত্ববিকাশের লক্ষণ-সমূহ পরিণত রূপ লাভ করতে পারে নি। ইতিহাসের ব্যক্তি বা চরিত্র-পাত্ররা সে-তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন। সময় ও সমাজের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থান ও আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনার দিগন্ত প্রথম উন্মোচিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) উপন্যাসে। ব্যক্তি রোহিনীর আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনা কৃষ্ণকান্ত মহাশয়ের উইল, গোবিন্দ লাল এবং ভ্রমরের সামন্ত আদর্শ-আশ্রয়ী জীবনবেদে বিসর্জিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র মূলত ভাবনাপ্রধান চষড়ঃ ড়ভ ঃযড়ঁমযঃ ও ঘটনাপ্রধান চষড়ঃ ড়ভ বাবহঃং) প্লটের নির্মাতা। রেনেসাঁসের জীবনাদর্শের পূর্ণতর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার যে স্বাধীন বিকাশের সত্য সম্পর্কিত উনিশ শতকের বাংলায় তার স্ফূরণমাত্র দেখা গেছে।
ভিক্টোরীয় যুগের অবসান ঘটে ১৯০১ সালে। এবং এ বছরের মার্চ থেকে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হয়। এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। অনেক সমালোচকই ‘চোখের বালি’কে বাংলা সাহিত্যের ‘প্রথম আধুনিক উপন্যাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই উপন্যাসেই প্রথম মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার রূপায়ণ ঘটলো। বিনোদিনী-মহেন্দ্র-বিহারীর ত্রিমুখী সম্পর্কের জটিল স্তরসমূহ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই উন্মোচন করেছেন উপন্যাসে। বিনোদিনী চরিত্রের অন্তর-বাহিরের ক্রিয়াশীলতা উপন্যাস ঘটনার কেন্দ্রে স্থাপন করেছে তাকে। বিহারী মহেন্দ্রের পারস্পরিক সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের উপলক্ষ হিসেবে বিনোদিনীর অবস্থান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে। বাংলা উপন্যাসের চরিত্র-ধারণা যে এ-উপন্যাসে বাঁক পরিবর্তন করেছে, চরিত্রগুলোর সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব তার প্রমাণ। মানবিক সর্ম্পকজাত দ্বন্দ্বের মাত্রাবহুলতাও এ-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। আশা-মহেন্দ্র বিনোদিনী ও বিহারী কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ঘটনাকে অতিক্রম করে গেছে। এই দ্বন্দ্ব ‘তাদের প্রবৃত্তি-প্রবণতা, হৃদয়াবেগ ও অনুভূতি এবং প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা আশ্রয়ী ব্যক্তিত্বের পরস্পরের দ্বন্দ্ব। এ-দ্বন্দ্ব-প্রতিটি চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব মূল-উৎসারিত।’ ভিক্টোরীয় স্নিগ্ধতামন্ডিত স্বপ্নময় চরিত্রভাবনা থেকে এ-উপন্যাসের মানব-মানবীরা বহু দূরবর্তী। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজপ্রথার দ্বন্দ্বে বিনোদিনীর বিকাশ-প্রক্রিয়ার ক্রমধারা হলো-উপেক্ষা> বঞ্চনা> বিকার> মহত্ত। অর্থাৎ উপন্যাসের ঘটনা এখানে চরিত্রের ন্যায়ে বিন্যস্ত। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ (১৯১০) বাংলা সাহিত্যের প্রথম চরিত্র প্রধান প্লটের উপন্যাস। ঘটনা চরিত্রের আন্তঃশৃঙ্খলা সঙ্গে এ উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘ সংলাপ এবং তর্ক। জন্মসূত্রে আইরিশ পিতা-মাতার সন্তান গোরার জীবনক্রম ভারতবর্ষের জাতীয় সমাজ-রাজনীতি ও আদর্শের ক্রমধারায় বিকশিত ও পরিণত। তার মীমাংসিত জীবনাদর্শ রবীন্দ্রনাথের ঐ পর্যায়ের জীবনাদর্শেরই প্রতিধ্বনি। ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১৩) কাব্যের ভারততত্ত্বের পূর্বসূত্র এবং প্রাচ্য-প্রতীচ্য, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খিস্টান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমন্বয়ে মহামানবের মিলনতীর্থ হিসেবে ভারত বর্ষকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন তিনি। পূর্বেই বলেছি, কলোনিশাসিত ভারত বর্ষ তথা বাংলা ভূখন্ডে গোরার মতো চরিত্রের জন্ম ও বিকাশের পরিপ্রেক্ষিত তখনো সৃষ্টি হয়নি। ঐশ্বর্য, বিশালতা ও গভীরতায় গোরার মতো সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্ব ইউরোপীয় ধাঁচে গড়া। তার আত্মজীবন, আত্মসমীক্ষা, আত্ম-আবিষ্কার ও দার্শনিক মীমাংসা বাঙালি চৈতন্যের সম্ভাবনার উৎসমুখ খুলে দিয়েছে। এবং গণতন্ত্র ও মানবতন্ত্রের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে উন্মোচন করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তরকালে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের উপন্যাস শিল্পে যে বাঁক-পরিবর্তন ঘটে, তা কেবল জীবনাদর্শ প্রকরণগত নয়-রক্তচিহ্ন দ্বারা অঙ্কিত। মানুষের বস্তুগত সঙ্কট-অভিজ্ঞতা কতো তীব্র, ব্যাপক, গভীর ও মাত্রাবহুল হতে পারে, এ সময়ের উপন্যাস তার প্রমাণ। শিল্পীর অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসবিধৃত চরিত্র-পাত্রের আচার-আচরণ ও রঙ পরিবর্তিত হতে বাধ্য। বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত কালপর্ব এবং এ সময়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক চেতনাপ্রবাহ ও শিল্পরীতির রূপান্তর ধর্ম উনিশ শতকের জীবনজিজ্ঞাসা ও শিল্পদৃষ্টির বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। এই ভিন্নমাত্রিক জীবনধর্ম ও শিল্পাদর্শের প্রথম রূপায়ন রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬) উপন্যাস। ‘চতুরঙ্গ’ প্রকাশের সময়কালে ও পরবর্তী এক দশকের মধ্যে জেমস্ জয়েস এবং ভার্জিনিয়া উল্ফের যুগান্তকারী উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হয়। জেম্স জয়েসের চড়ৎঃৎধরঃ ড়ভ ঃযব ধৎঃরংঃ ধং ধ ুড়ঁহমসধহ (১৯১৬) ও টষুংংবং (১৯২২) এবং ভার্জিনিয়া উল্ফের লধপড়নং জড়ড়স (১৯২২) ও গৎং. উধষষড়ধিু (১৯২৫) পাশ্চাত্য উপন্যাসের বক্তব্য ও রীতির যে রূপান্তর ঘটায়, বাংলা সাহিত্যে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের ভূমিকা তার চেয়েও বেশি। উনিশ শতকের আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত ঘটনাও সমগ্র হয়ে ওঠা চরিত্রায়ন রীতি নতুন কালের চাহিদার কাছে তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। আধুনিক মানুষ অনেকগুলো খন্ড-অখন্ড বোধের সমষ্টি, তার চৈতন্য কখনো ভগ্নক্রম, কখনো বিন্দু-রঙে-রেখায় সমন্বিত। ‘চতুরঙ্গে’র জ্যাঠামশাই সচীশ-দামিনী-শ্রীবিলাস আধুনিক মানুষের খন্ড খন্ড রূপের এক অখন্ড সংস্করণ। আর সচীশ স্বতন্ত্রভাবে গোরারই উত্তরপুরুষ এবং রবীন্দ্রনাথেরও। জেমস জয়েসের ইউলিসিস-এর নায়ক লিওপোল্ড ব্লুম হোমরের ওডেসিয়ুসের যুদ্ধোত্তর সংস্কার। হোমরের নায়কের বৈশিষ্ট্য বীরত্ব, সাহসিকতা ও দুঃসাহসী অভিযান, আর জয়েসের নায়ক কাপুরুষ, ব্যক্তিত্ববর্জিত ও পলায়নপর। ওডেসিয়ুসের স্ত্রী পেনিলোপি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ধৈর্যশীলা ও স্বামীর জন্য অপেক্ষারত, আর মলি ব্লুম অন্য পুরুষের সঙ্গে পরকীয়ায় আসক্ত। হোমরের পেনেলোপির বৈশিষ্ট্য বিশ্বস্ততা আর জয়েসের পেনেলোপি (মরি ব্লুম) তা থেকে বহু দূরবর্তী।
৩.
বাংলা উপন্যাসে চরিত্র ধারণা রবীন্দ্রনাথর কাল থেকেই দ্বিবিধ ধারায় বিকাশ লাভ করেছে। এক. ভিক্টোরীয় রীতি; দুই. যুদ্ধোত্তর সময়, সমাজ, দর্শন ও নতুন নতুন চিন্তা ও তত্ত্ব-আশ্রয়ী রূপান্তরধর্মী রীতি। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমসাময়িক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেকগুলো চরিত্র প্রধান উপন্যাস লিখেছেন-যেগুলোর চরিত্র-পাত্ররা নাগরিক জীবনের তলদেশ থেকে শুরু করে বৃহত্তর গ্রামজীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর ‘দেবদাস’ (১৯১৭) ও ‘শ্রীকান্ত’ (প্রথম পর্ব-১৯১৭) চরিত্রপ্রধান উপন্যাস। ‘দেবদাস’ অতি-আবেগী ব্যক্তির প্রত্যাশার অপ্রাপ্তিজনিত আত্মক্ষয় এবং ‘শ্রীকান্তে’ (চার পর্বে সমাপ্ত) ব্যক্তি-চরিত্রের আত্মজীবনের বহুবিচিত্র ঘটনা রূপায়িত হয়েছে। সাধারণমানের ভিক্টোরীয় আঙ্গিক-অনুসারী হলেও চরিত্র ও ঘটনার নতুনত্ব বৃহত্তর পাঠক জীবনকে আলোড়িত করতে সমর্থ হয়। কেননা, তার আদর্শায়িত (রফবধষরুবফ) চরিত্র ধারণার প্রতি বাঙালি মানসের আকর্ষণ চিরকালীন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাংলা উপন্যাসের চরিত্র ধারণায় নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলোতে। আধুনিক মানুষের মনুস্যত্বহীনতা, কদর্যতা ও অসহায়তা অনেকটা নিয়তি নির্ধারিত বিশ্ববিধানের মতো বিন্যস্ত। পরিবেশ ও পরিস্থিতিতাড়িত মানব-অস্তিত্ব ভিন্ন মাত্রায় উন্মোচিত হয়েছে তাঁর লঘুগুরু’ (১৯২৮/২৯) ও ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ (১৯২৯) উপন্যাসে। নারী-পুরুষের সাধনা ও ব্যর্থতার উন্মোচন চিরকালের সাহিত্যের বিষয়বস্তু। কিন্তু, ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি তাকে কোন্ মাত্রায় নিয়ে যেতে সমর্থ, জগদীশ গুপ্তের উত্তম-টুকী-বিশ্বম্ভর-নটবর তার প্রমাণ। এইসব চরিত্রের ক্ষেত্রে পরিবেশ এক অমোঘ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে ব্যক্তি-মানুষের সকল শুভ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। আলোক-সন্ধানী মানুষ নিজের অস্তিত্বের মধ্যেই অনুভব করে অন্ধকারের অবিনাশী উপস্থিতি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সমাজ বাস্তবতা, মনোবাস্তবতা ও বিশ্লেষণ-ধর্মী চরিত্র-রহস্য অভিন্ন বোধের কেন্দ্রে মিলিত হয়েছে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র (১৯৩৬) শশী-কুসুম-মতি, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র (১৯৩৬) কুবের-কপিলা হোসেন মিয়া চরিত্র বিশেষ আর্থ-উৎপাদন কাঠামোগত অস্তিত্ব রূপের বহুমুখী প্রকাশ হিসেবে ব্যতিক্রমধর্মী। প্রাথমিক অস্তিত্ব, জৈব-প্রবৃত্তির ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম শশী-কুসুমের চরিত্র শৃঙ্খলার তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় না। বরং ‘পদ্মানদীর মাঝি’র চরিত্র-পাত্রদের ক্ষেত্রে চরিত্রায়নের এই মাত্রা অনেকটা সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কুবেরের ভাসমান জীবনধারার প্রতীকায়নে পদ্মানদী, কেতুপুর ও ময়নাদ্বীপের বিস্তৃত পরিসর অনেকটা বাস্তবসম্মত। এবং তার অন্তর্জীবনের আকুতি, হাহাকার ও দোলাচল রূপায়নে ঔপন্যাসিকের পরিচর্যার (ঞৎবধঃসবহঃ ) প্রয়োগ চরিত্রায়নকে তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে উপন্যাসের বিষয়ভাবনা ও চরিত্রায়নে নব-অঙ্গীকারের প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ের বাঙালি ঔপন্যাসিকরা যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় উপন্যাসের শিল্পরীতিকে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ভুক্ত করেন নতুন মানবীয় পরিস্থিতিতে (ঐঁসধহ ঈড়হফরঃরড়হ) চরিত্রের অস্তিত্বগত বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও ব্যর্থ সিসিকীয় সংগ্রামের রূপায়নই ঔপন্যাসিকদের কাছে পরম বলে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের উপন্যাসে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ এই নবমাত্রিক চরিত্রধারণাকে বাঙালির অস্তিত্বগত সংগ্রাম ও ব্যর্থতাবোধের সমান্তরালে বিন্যস্ত করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সত্তা ও আর্থ-উৎপাদন কাঠামোতাড়িত অস্তিত্বভাবনাকে ব্যক্তি ও সমষ্টির অস্তিত্ববিন্যাসের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রয়োগ করেছেন, বাংলা উপন্যাসে তা তুলনা রহিত। বাঙালি জীবনের রাজনৈতিক আত্ম-আবিষ্কারের সঙ্গে ব্যক্তির অস্তিত্বসত্তার সমীকরণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬) নবচেতনার শিল্পরূপ হয়ে উঠেছে। ঘটনা, পরিসর ও সমষ্টির রাজনৈতিক জাগরণের সঙ্গে ব্যক্তির সহজ অভিজ্ঞান ও আত্মরূপান্তর হাড্ডি খিজির ও ওসমান চরিত্রের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছে। উপন্যাসের চরিত্রভাবনা ঔপন্যাসিকের জীবন-গ্রহণ ও রূপায়নের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি সমাজের মানববিন্যাস ও আর্থ-উৎপাদন কাঠামো চরিত্রধারণার ক্ষেত্রে নিগূঢ় প্রভাব বিস্তার করে। চরিত্র রূপায়নে বস্তু-অভিজ্ঞতার সঙ্গে দার্শনিকতা ও বিজ্ঞান মনস্কতার সম্পর্ক যে কতো নিবিড়, বিশ্ব-উপন্যাসের পাঠ থেকে তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





