প্রথম পর্বের লিঙ্ক: Click This Link
কিন্তু খেতে তো হবে। না খেয়ে কেউ বাঁচতে পারে? তাই হোটেলওয়ালাকে বললাম, একবেলার খাবার টা একটু কষ্ট করে বাসায় দিয়ে আসা যায় কি না।
ওনার ওখানে কাজ করত এক ছেলে। ওই ছেলে একদিন খাবার নিয়ে গেল। ভাতের প্লেট ছিল খোলা। লোকজনের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লাম।
এরপর থেকে ব্যাগে ভরে খাবার টা আমিই নিয়ে যেতাম।
স্কুলে ঢোকার সময় বলা হয়েছিল কোচিং চালু হবে এখানে। বেতন ২,০০০ হলেও কোচিং থেকে ৩,০০০ আসতে পারে। মোট ৫,০০০। ভালোই চলবে। আমার ব্যক্তিগত খরচ তো অত বেশি না।
ত্রিশালে যখন ছিলাম, মনে মনে চাইতাম অন্তত ৩,০০০ টাকা উপার্জন করতে। থাকা-খাওয়া টা হলেই হতো। বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া টা ভালো লাগত না। তাছাড়া বাড়ি থেকে টাকা কেমনে দেবে? বাবা সৌদি থেকে দেশে চলে আসার পর তেমন কিছু করতে পারতেন না। সংসার খরচ, আমি ও আমার বোনদের পড়ালেখার খরচ সব মামারা দিতেন। তাদের কাছ থেকে খরচ নিতে ভালো লাগত না। আত্মসম্মানে লাগত।
ত্রিশালে এক সহপাঠীকে নিয়ে মেসে উঠেছিলাম যখন, দুজন চিন্তা করতাম কীভাবে টিউশনি করা যায়। দিনরাত কত পরিকল্পনা করলাম। একসময় দেখা গেল সে টিউশনি পেল অথচ আমি পেলাম না। এক দুজন সহপাঠীর অনেক টিউশনি ছিল। সঙ্কোচে বলতে পারি নি, তাই তারা দেয়ও নি। অভিমান হতো খুব। কিন্তু কার সাথে অভিমান করব? এ সংসারে আপনজন কে?
একসময় ময়মনসিংহে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানেও টিউশনি পেলাম না। কোচিং এ সিভি দিলাম, ডাকেও নি। এমন হতাশায় নিমগ্ন হলাম, পড়ালেখা শিকেয় উঠেছিলো।
যাহোক, স্কুলে কোচিং চালু হলো। চললো কয়েকদিন। সর্বোচ্চ্য চেষ্টা করলাম টিকে থাকতে। কিন্তু ভাঙা কপাল কি জোড়া লয়?কিন্ডারগার্টেনের প্রধান অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওনি কিছুদিন ছিলেন না; এই সুযোগে বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক কোচিং এর শিক্ষার্থীদের ভাগিয়ে নিয়ে গেলেন।
অকূল পাথারে পড়লাম আমি। প্রথমে যে কোচিং এ কাজ করার জন্য ভালুকায় গিয়েছিলাম, সেই কোচিং এর মহিলা একটা টিউশনি যোগাড় করে দিয়েছিলেন। একদিন পড়ানোর পর ২য় দিন গিয়ে দেখি শিক্ষার্থী বাসায় নেই। ফোন দিলাম। অভিভাবক জানাল, ছেলে স্কুলের শিক্ষকের কাছে পড়বে।
অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে। এরমধ্যে হঠাৎ স্কুলের দুজন মেয়েকে পড়ানোর প্রস্তাব পেলাম। বেতন ১,০০০ করে। আমি তো বেজায় খুশি। এগুলো শুরু করার পর আরও কিছু ছেলেমেয়ে জুটে গেল। মনে হলো অভাবের দিন বুঝি ফুরাল।
কিন্তু তেমন কিছু হলো না। এই যে স্কুলের কিছু ছেলে-মেয়ে আমার কাছে পড়ছে, বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকের সহ্য হলো না। দল পাকাতে লাগল আমার বিরুদ্ধে। স্কুলের প্রধান আমাকে পছন্দ করতেন, কিন্তু ওনার অনুপস্থিতিতে আমার টিকে থাকাই কঠিন হলো। কয়েকজন শিক্ষক সরাসরি অভিভাবকদের বললেন আমার কাছে যেন ছেলেমেয়েদের না পড়ায়। সরাসরি আমার বিরোধিতা করতে লাগলেন।
একদিন স্কুল টা ছাড়তে হলো। এরপর কয়েকটা কোচিং এ যোগাযোগ করলাম। ডাকল একটা থেকে। সেখান থেকে আমার বাসা অনেক দূর। তাই বাসা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ভালুকার 'মেঘার মাঠ' নামক জায়গায় বাসা নিলাম।
একমাস কোচিং করানোর পর সেখানকার এক ছাত্রকে বেত্রাঘাত করার কারণে চাকরি টা চলে গেল।
এরমধ্যে কয়েকটা টিউশনি ছিল। কিছুদিন আগে হঠাৎ এক কাজিনের সাথে বহুবছর পর দেখা হয়। তার মেয়েকে পড়াই। সে দু বেলা খেতে দেয়। যদিও মাস শেষে তাকে কিছু টাকা দিই।
কাজিনের বাসা থেকে 'মেঘার মাঠ' এর বাসা টা বেশ দূরে। অন্য একটা কোচিং এ যুক্ত হয়েছিলাম। ওই কোচিং শেষ করে আরও টিউশনি করে, ভাগ্নিকে পড়িয়ে নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যেত।
নাহিদ নামের একজন ছাত্র ছিল। ওর মা আমাকে স্নেহ করতেন। বাসায় গেলে যত্ন--আত্মী করতেন, খাওয়াতেন। সুসম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল এই পরিবার টার সাথে। একবার কী এক কারণে নাহিদকে মার দিলাম। সে মুখ ফুলিয়ে রাখল। তাদের বাসায় খাই বলে খোঁটা দিল।
ছেলেটাকে পছন্দ করতাম। এক মুহুর্তে সব ভালো লাগা উধাও হয়ে গেল। তাকে পড়ানো বাদ দিলাম। অবশ্য তাতে তেমন সমস্যা হলো না। টিউশনি আরও ছিল। আর একটা কোচিং তো ছিলই। সেগুলো করে মোটামুটি চলে যেত।
কোচিং টা একসময় সমস্যায় পড়ল। শিক্ষকদের বেতন হয় না। আমি যার মাধ্যমে গিয়েছিলাম, ওনি বেতন দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। একসময় কোচিং ছেড়ে দিলাম।
নানান কারণে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। মনে হলো ভালুকা ছাড়ার সময় বুঝি হলো৷ এখানে একদম মন টিকছে না। যদিও টিউশনি করে টিকে থাকা যেত, কিন্তু এত এত 'প্রতিকূলতা' আমাকে স্থির হতে দিল না। গাজীপুরে পরিচিত এক ছোটো ভাইয়ের কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:৩৯