বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং খুব প্রচলিত ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বোধকরি সবচেয়ে কুখ্যাত। ঢাবি, জগন্নাথও
কম যায় না। মেডিকেল, বুয়েটও আছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় কমবেশি
এর চর্চা চলে। জাতীয়ও বাদ না। ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজও এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি মেয়েদের হলেও চলে।
শোনা যায় ইডেন, জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা বেশি এগিয়ে।
শুধু হল এ চলে; এমন না। ক্যাম্পাস সংলগ্ন ছাত্রাবাসেও র্যাগিং চলে। যাকে এক প্রকার নির্যাতনও বলা চলে।
আদব-কায়দা শেখানোর নাম করে নিপীড়ন করা হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে। গত বছরও তো ঢাবির এক
শিক্ষার্থী তার ভর্তি বাতিল করে এলাকার এক কলেজে ভর্তি হয়েছিল। অনেকে চুপ করে সহ্য করে। পরবর্তীতে
সে একই কাজ করে জুনিয়রদের সাথে। এমনটাই বহুদিন ধরে চলে আসছে।
আগে বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কথা বলা হতো না। যেমন বলা হতো না মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিয়ে। এখন
কোনকিছু চাপা থাকে না। সব দিনের আলোর মতো সামনে চলে আসে। তবুও যে পরিস্থিতির খুব পরিবর্তন হয়েছে,
ব্যাপারটা তেমন না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেকে তো কুকর্ম করেও ঘুরে বেড়ায়।
আমার পড়ালেখা প্রত্যন্ত এলাকায়। স্কুল, কলেজ; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও ময়মনসিংহে। যদিও উপজেলা ভিন্ন।
১৮ বছরের আমি মাত্র ত্রিশালে গিয়েছি। কয়েকমাস ময়মনসিংহ সদরে কোচিং করলেও এই প্রথমবার কোন জায়গায়
অনেকদিন থাকার জন্য গেলাম। পথঘাট চিনি না। উঠলাম ‘খাদিজা ছাত্রাবাস’ নামে এক ছাত্রাবাসে। রুমমেট
নাহিদ নামের এক বড়োভাই। বাড়ি রংপুর।
লোক খারাপ না। তবে তুখোড় ধুমপায়ী। সারা ঘর সিগারেটের প্যাকেটে ভর্তি। পরিষ্কার করে কোনমতে রাত্রী
যাপন করলাম।
পরদিন পত্রিকা পড়তে গেলাম। রুমমেট বড়োভাই বললেন, সিনিয়ররা আগে পড়বে।
আমি থ। আমি যখন পত্রিকা হাতে নিই, কেউ ছিল না।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আমি একটু বাইরে বের হব। হঠাৎ একজন ইশারায় একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ওই ঘরে বড়ো
ভাইরা যেতে বলছে।
একটু বিব্রত আমি। কাউকে তেমন চিনি না। হঠাৎ কোথায় যাব? এমনিতেও মানুষের সাথে মেলামেশা কম আমার।
যেতে যেহেতেু বলছে, না গেলে হয়ত সমস্যা হবে। তাই সাহস করে গেলাম। যা হওয়ার হবে।
ঘরে প্রবেশ করে দেখি ১৫-২০ জন খাট, চেয়ারে বসে আছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনকে জেরা করছে।
আমি ভাবলাম হয়ত কোন অপরাধ করেছে, তাই জেরা করছে।
আমি দরজার কাছে দাঁড়ানো। দেখলাম বামপাশের এক কোণে চাপ দাড়িওয়ালা এক ছেলে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
চেহারা কাঁদো কাঁদো। পরবর্তীতে তার নাম জেনেছিলাম ফিরোজ। তার পাশে দাঁড়ানো একজনের চেহারা
ভীত-সন্ত্রস্ত। আরিফ নাম। বোধকরি একটু আগে তার ওপর ঝড় বয়ে গেছে। উভয়ের বাড়ি গাজীপুর।
আমার পাশে একজন কান ধরে দাঁড়িয়েছিল। বেশ লম্বা আবার ফর্সা ছেলেটার চেহারা লাল হয়ে আছে।
মিরাজ নাম। চট্টগামে তার বাড়ি।
তার সামনে একটা পত্রিকা। অর্ধ নগ্ন এক মডেলের ছবি দেখা যাচ্ছিল। তাকে বলা হলো মডেলের ছবিতে চুমো
দিতে। যা বলা হলো, ভয়ে তাই করল।
আরও অন্যদের বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হলো। এবার আমার পালা। বলল, ২ এর নামতা বল। মেজাজ খারাপ হয়ে
গেল। চেনা নেই, জানা নেই এমন কাউকে তুইতোকারি করে কেমনে মানুষ।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ২ এর নামতা পারি না।
এটা বলাই কাল হলো আমার। ৩ ঘন্টা চলল অকথ্য গালিগালাজ। ইমরান নামের একজন ছিল তাদের সর্দার।
এছাড়াও মনির, জনি নামেও দুজন ছিল।
৩ ঘন্টা পর পাশের ঘরে নেওয়া হলো আমাকে। আমিনুল আর অপু নামের দুই বড়োভাইয়ের ঘর। অপু একটা
খোলামেলা ছবি দেখিয়ে বলল, এর বুকে চুমা দে।
আমি তো অপমানে বিবর্ণ হয়ে গেছি। যখন কথা শুনছি না, গালমন্দ শুরু এখানেও। চলল রাত ১০ টা পর্যন্ত।
বদরুল নামের এক ভাইয়ের সাথে এখানেই পরিচয় হয়েছিল। ওনি আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
রাতে ঘুম হলো না। প্রতিশোধ নিতে মন অস্থির। কিন্তু কেমনে? এখানে তো পরিচিত প্রভাবশালী কেউ নেই।
পরদিন ঘর থেকে বের হলাম। তৌহিদ নামের একজন ঘরে ডেকে নিল। তার সাথে সুমন নামের একজন। যতটা সম্ভব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করল।
এই তৌহিদ সম্পর্কে শুনেছিলাম অর্থনীতির ফার্স্ট বয়। মেলাতে পারছিলাম না। এত জঘন্য যার ব্যবহার, সে ফার্স্ট
হলেই কী না হলেই কী! এ নাকি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড়ো একটা পদে আছে। অনেক বছর আগে
ময়মনসিংহে একবার দেখা হয়েছিল। আগ বাড়িয়ে কথা বলেছিল। বিরক্ত মুখে উত্তর দিয়েছিলাম। হয়ত বুঝতে
পেরেছিল তাকে ক্ষমা করতে পারিনি। কেমনে ক্ষমা করব? ছাত্রাবাসে থাকাটা তো কঠিন করে তুলেছিল। তাও
কষ্ট করে ৬ মাস ছিলাম। যেদিন চলে আসব; সেদিনও সে খারাপ ব্যবহার করেছিল। এসব জানোয়ারকে কি
কখনো ক্ষমা করা যায়? অবশ্য সে ক্ষমা চায়ও নি।
আরও ঘটনা আছে। মারুফ নামের একজন ক্যাম্পাসে দুর্ব্যবহার করেছিল। এমন এমন কত ঘটনা যে আছে, মনে পড়লে খুব অসহায় বোধ করি। র্যাগিং যে কত ঘৃণ্য, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যরা বুঝবে না।
বিঃদ্রঃ এখনকার উদ্ধত ছেলেমেয়েদের কিছুটা শিষ্টাচার শেখানোর দরকার আছে। তবে সেটা অবশ্যই সীমার মধ্যে রেখে। নিপীড়ন যেন না হয়ে যায়। আর যারা আগে থেকেই ভদ্র, তাদের নিশ্চয়ই বেশি কিছু শেখানো দরকার পড়ে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ১১:০০