somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কখনও কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার শখ জাগেনি

১২ ই জুন, ২০২৩ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মফস্বলের যে বিশ্ববিদ্যালয়টায় পড়ালেখা করতাম, সে এলাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় অত ছিল না। এখন যেমন পনেরো-বিশ হাজারে চলতেও কষ্ট হয়ে যায় (অবশ্য রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়াটাও স্বাভাবিক), মাত্র তিন হাজার টাকায় সেখানে মাস চলে যেত। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টা সরকারি, সেমিস্টার ফিও খুব বেশি ছিল না। মাত্র দু’হাজার পনেরো টাকা।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মাত্র তিন হাজার টাকা জোগাড় করতেও আমার কষ্ট হয়ে যেত। আমাদের পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ ছিল না। বাবা আরও সাত-আট বছর আগে সৌদি আরব থেকে খালি হাতে দেশে চলে এসেছিলেন। তার জমি-জমাও তেমন ছিল না। আমাদের সংসারের খরচ চালাতেন মামারা। সে খরচ থেকে মা আমার পড়ালেখার খরচ দিতেন।

বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তিন বছর আগে বিয়ে হয় মেজো বোনের। বাকি দু’ভাইবোনের বোঝা টানতে হতো মাকে। দু’ভাইবোন বললে অবশ্য ভুল হবে। আমার বোঝা বলাটাই যথোচিত। কারণ, ছোটো বোন খুব অবহেলায় বড়ো হয়েছে। আমি আর মেজো বোনের খরচ থেকে যে উদ্বৃত্ত থাকত, তাই খরচ হতো তার পেছনে।

আমি বুঝতে পারতাম, মায়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে টাকা পাঠাতে, কিন্তু কী করব বুঝতে পারছিলাম না। এর মধ্যে ডেসটিনিতে ধরা খেয়ে মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। সেখানে আমার পনেরো হাজার টাকা বিনিয়োগ করা ছিল। সে টাকার জন্য দিনরাত আফসোস হতে লাগল।

পড়ালেখা মোটেও হতো না আমার। সারাক্ষণ চিন্তা হতো কেমনে চলব? কেমনে তিন হাজার টাকা হবে অন্তত? বাড়িতে টাকা পাঠানোর দরকার নেই। মা-বাবাকে একটু বোঝামুক্ত করা তো দরকার।

আমার এলাকার একজন তার ফুফুর বাসায় থেকে ক্লাস করত। প্ররোচিত করে তাকে আমার সঙ্গে নিয়ে নতুন ছাত্রাবাসে উঠলাম। তারপর পরামর্শ করতে লাগলাম কেমনে শিক্ষার্থী জোটানো যায়। নিদেনপক্ষে আশপাশের কোচিং বা কিন্ডারগার্টেনে ক্লাস নিতে পারলেও হবে। মাত্র তিন হাজার টাকা উপার্জন করতে পারব না?

একসময় তাকে একটা কোচিং থেকে ডাকা হলো। দেখা গেল সে টিউশনিও করায়। আমি হতভাগা একটা শিক্ষার্থীও জোটাতে পারলাম না। তাকে যে বলব, আমাকে একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দাও, আমার চলতে কষ্ট হচ্ছে- আমার পক্ষে বলা সম্ভব হলো না। একটু অভিমানও হলো। সে তো জানতই আমার অবস্থা। সে স্বপ্রণোদিত হয়ে একটা টিউশনি দিতে পারল না?

মেসের আরেক সহপাঠীকে দেখলাম অন্য বিভাগের এক ছেলেকে টিউশনি দিল। আমি হাভাতের মতো চেয়ে রইলাম। নিজের প্রতি এত রাগ হলো! আমি কি এতই বেশি হলাম দুনিয়ায় যে, আমাকে কেউ স্কুল বা কোচিংয়ে ডাকে না? আমি কেন একটা টিউশনি পেতে পারি না?

রুমমেটকে বললাম, ময়মনসিংহে চলে যাব। কেন যাব, সেটা হয়তো সে ঠাহর করতে পারেনি অথবা আমাকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পায়নি। যদিও একবার সে থেকে যেতে বলেছিল। আমি তাকে বলতে পারিনি, একটা টিউশনি পেলে আমি থেকে যাব।

ময়মনসিংহে একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোর সুযোগ পেলাম কাকাত বোন মারফত। সে একটা টিউশনিরও ব্যবস্থা করে দিল। মেসের রুমমেটরা বলল, কিন্ডারগার্টেনে পড়ালে নিজের ক্যারিয়ার বরবাদ হয়ে যাবে। তাদের পরামর্শে সেখানে যোগ দিলাম না। টিউশনিতে মাত্র এক হাজার টাকা দেবে। তাই এটাও শুরু করলাম না।

অন্য এক কাকাত বোন আরও একটা টিউশনির প্রস্তাব আনল। একটা কাজের কারণে দু’দিন পর টিউশনিতে যাব বললাম। দু’দিন পর শুনি অন্য শিক্ষক নিয়ে নিয়েছে। ভাবলাম, হয়তো আরও প্রস্তাব পাব। অত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।

এরপর টানা দু’বছর একটা টিউশনির জন্য সারা ময়মনসিংহ শহর দৌড়িয়েছি। কোচিংগুলোতে সিভি পাঠিয়েছি, কিন্তু ডাক আসেনি একবারও। আমার খুব আফসোস হয়েছে আগের প্রস্তাবগুলো কেন গ্রহণ করিনি। আমি বুঝতে শিখি, উপদেশ দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই, কিন্তু একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার লোক পাওয়া যায় না। দু’পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করার লোকও কম।

একসময় ময়মনসিংহে থাকা হলো না আমার। বাড়িতে চলে আসি। সেখান থেকে মাঝেমাঝে গিয়ে ক্লাস করতাম ভার্সিটিতে। এই খবরটা এক প্রবাসী মামার কানে যায়। উনি আমার পড়ালেখার দায়িত্ব নেন। দু’বছর ভালোভাবেই কাটে।

দু’বছর পর মামা আর সহযোগিতা করেননি। আমি অনার্স শেষ করে কাজকর্মের খোঁজ করতে থাকি। গাজীপুর আসি, গার্মেন্টসেও যোগাযোগ করি; কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও পরীক্ষা দিই। কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি।

একসময় এলাকায় ফিরে যাই। মাস্টার্সের ক্লাস শুরু করি। উপার্জনের চেষ্টা চালাই। একটা কোচিংয়ে বিকল্প শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিই। সেই শিক্ষক চলে আসায় আমার আর কাজ করা হয় না।

এরপর চলে চিরাচরিত দুর্বিষহ জীবনযাপন। ভালুকা সদরে চলে এসে ভেতরের দিকে একটা কোচিং করাই। মাস শেষে টাকা আসে এক-দু’হাজার। সে টাকায় থাকাই চলে না, খাওয়া তো পরের কথা। টিউশনির প্রস্তাব পাই একটা। একদিন পড়ানোর পর সেটাও চলে যায়। এরপর একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো শুরু করি। ছয়-সাত মাস কঠোর পরিশ্রম করার পর যখন উঠে দাঁড়াব, তখনই চাকরিটা চলে যায়।

কথায় বলে, ‘কপালে আছে হাড় কী করবে চাচা শাহীদার’। আমার হলো সেই দশা। এরপর একটা কোচিং ধরি। একমাস পর সেটাও চলে যায়। এরপর আরেকটা স্কুলে কোচিং শুরু করলে দু’মাস পর তারা বেতন দিতে না পেরে আমাকে না করে দেয়।

আমার জন্মস্থান আমাকে আশ্রয় দিতে পারেনি। পাড়ি জমালাম গাজীপুর। এখানে এসে বিমা কোম্পানিতে ঢুকে প্রতারিত হলাম। এরপর ঢুকি একটা স্কুলে। সাত মাস কাজ করি। অভাব যখন ঘুচল, এর মধ্যে এই চাকরিও চলে যায়। এরপর দুটো কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিই। যা বেতন আসত, পেটে-ভাতেও চলত না। সর্বশেষ কোণাবাড়ীতে একটু স্কুলে ঢুকি।

করোনার কারণে এই চাকরিটাও চলল না। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। এলাকায় গিয়ে শুনি বড়ো বোনের স্বামীর পা ভেঙে গেছে ফুটবল খেলতে গিয়ে। তার সংসার চলছে না। ভাগ্নেকে নিয়ে তার ফার্মেসিতে বসতে লাগলাম। একসময় তার অবস্থা মোটামুটি ভালো হলে এক বন্ধুর সঙ্গে এলাকায় হোটেল খুলি, চা-পান বেচি, থালা-বাসন ধুই, ভাত বেচি। কিন্তু সেখানেও সুখ হলো না। ব্যবসা লাটে ওঠল।

কলেজের ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করি। দিন ফেরে বটে, কিন্তু মন আর বসে না। এলাকার লোকজন কেমন চোখে তাকায়! যেসব ছেলেমেয়ে স্কুল পাশ করতে পারেনি, তারা পয়সাওয়ালা। কেউ রাজনীতি করে পসার করে ফেলেছে। আর আমি মোটামুটি ভালো শিক্ষার্থী হয়েও চা-পান বেচেছি, এলাকায় টিউশনি করাই- এসব অনেকের আলোচনার বিষয়। আমার মনে হতে থাকে- এলাকা ছাড়লেই বাঁচি।

একটা চাকরির প্রস্তাবে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু এত অসম্মান আর অমর্যাদা, দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় থাকা আমার সহ্য হলো না। ছাড়তে বাধ্য হই এই চাকরি। একটা স্কুলে মৌখিক পরীক্ষা দিই। একটা প্রাইভেট চাকরিও হওয়ার কথা। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। আবার অকূলপাথারে পড়ি। প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি নিয়েও ছেড়ে দিই। দু’টো কোচিংয়ে নামমাত্র টাকায় ক্লাস করাই। আবার একটা চাকরির প্রস্তাব পাই, অথচ দু’মাস করে টাকা পাইনি একটাও। ছাড়তে বাধ্য হই। তারপর মন্দের ভালো নতুন একটায় ঢুকি। এখনও সেখানেই আছি, খেয়েপরে বেঁচে আছি।

চাকরির পাশাপাশি একটা টিউশনিও চলে। এখানেও ঠকে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। দুই বাচ্চাকে সপ্তাহে পাঁচ-ছ’দিন পড়িয়ে টাকা আসে চার হাজার। তাও সময় মতো না। এত কম পয়সায় রাজধানীতে কেউ পড়ায় কি না জানা নেই। আমি বোকা বলে পড়াই হয়তো অথবা পড়াতে বাধ্য হই। সবমিলিয়ে চলতে তো হবে।

এতদ্বসত্ত্বেও কখনও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার শখ জাগেনি আমার, মনে হয়নি বাড়ি,গাড়ি; অনেক নারী হোক। মোটামুটি স্বচ্ছল একটা জীবন চেয়েছি সবসময়।

অনেকেই যখন হাজার হাজার কোটি টাকা কামায়, অথচ জীবনকে উপভোগ করতে পারে না; তাদের জন্য আফসোস হয়। তাদেরকে মানসিক রোগী মনে হয়। যদি জীবনে সুখ না আনা যায়, শান্তি না আনা যায়; হাজার হাজার কোটি টাকায় কী লাভ? পেটপুরে খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম আর একটা সুখী পরিবার- বোধ করি এটুকুর সংস্থান করতে পারলেই জীবনের সফলতা। এর বাইরে চাওয়া ঘোরাঘুরি। অমরত্ব লাভ করা। আর কিছু না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১১
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×