তৃতীয় শ্রেণিতে উঠার পর স্কুল পালানো শুরু। টিফিনের পর কয়দিন ক্লাস করেছি, মনে পড়ে না। ঘন্টা পড়ার পর শার্টের নিচে হাফপ্যান্টের সঙ্গে বইগুলো চেপে ভোঁ দৌড়।
যেদিন বই বেশি থাকত, জানালা দিয়ে বাইরে সেগুলো ফেলতাম। তারপর প্রস্রাব করার বাহানায় বাইরে এসে বইগুলো নিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকতাম। তারপর কে আমাকে পায়!
চারটার আগে বাড়িতে গেলে মা বকবে, তাই টইটই করে সারা গ্রাম ঘুরতাম। চারটা বাজার পর বাড়িতে যেতাম। বইগুলো রেখে খেয়েদেয়ে আবার বাইরে বেরোতাম। সন্ধ্যে পর্যন্ত খেলাধুলা চলত।
আমাদের কমন খেলা ছিল দাঁড়িয়াবান্ধা। এছাড়া কাবাডি খেলতাম, ক্রিকেটও খেলতাম। ব্যাট হিসেবে ব্যবহার করতাম তালপাতার ডগা। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে ফুটবলও খেলা হতো।
সন্ধ্যের পর সাড়ে আটটা পর্যন্তু চলত পড়ালেখা। তারপর টিভি দেখা। টিভি বলতে বিটিভি। বিটিভিতে তখন ভালো ভালো নাটক হতো। ধারাবাহিক নাটকগুলোর পর্ব দেখার জন্য সপ্তাহ করে অপেক্ষা করতে হতো।
আমাদের বাড়িতে যখন টিভি ছিল না, তখন পাশের বাড়িতে চলে যেতাম। সেখানে যদি ব্যাটারিতে চার্জ না থাকত, দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে পাশের গ্রামে চলে যেতাম। শুক্রবারে চলা বাংলা সিনেমা তো কখনোই মিস করতাম না।
পুকুরে সাঁতার কাটা ছিল নিত্যদিনের অভ্যাস। দেখা যেত দিনে এক-দু ঘন্টা সময় সাঁতার কেটেই কাটত। জাল দিয়ে মাছ ধরতাম। অনেক সময় বরশি দিয়ে।
বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা খাল ছিল। কিশোর বয়সে বহুবার সেখানে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। খালুইয়ে করে ছোট মাছ আনতাম।
আমাদের গ্রামটা বেশি বড় নয়। প্রায় সব বাড়িতেই যাতায়াত ছিল। আমার বাবাকে সবাই চিনত। স্কুলে যাওয়ার সময় এক পোস্ট মাস্টারের বাড়ির ওপর দিয়ে যেতে হতো। ওই বাড়িটাকে কেউ কেউ উচালিবাড়ি বলত। উচালি জিনিসটা কী; এটা কখনও জানা হয়নি।
চতুর্থ, পঞ্চম বা আরও ওপরের ক্লাসে উঠার পর খুব কমই স্কুল মিস করেছি। স্কুল পালালেও স্কুলে যাওয়া কিন্তু কমেনি। ন্যূনতম টিফিন পর্যন্ত ক্লাস করেছি। বৃষ্টি-বাদলও স্কুলে যাওয়া থামাতে পারেনি। ছাতা না থাকলে দেখা গেছে কলাপাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে গেছি।
পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলাম। গণিতে বরাবরই দুর্বল ছিলাম। হাইস্কুলে ইংলিশে ভালো করতে শুরু করি। এই ধারাবাহিকতা কলেজ পর্যন্ত থাকে। কিন্তু গণিতের ভয় কখনও কাটেনি। কলেজে উঠার পর হিসাববিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে।
হাইস্কুলে উঠে বেশ চাপে পড়ি। হাতের লেখা না নিলে নীল ডাউন করে রাখা হতো। পড়া না পারলে মার। পড়ার জন্য মার কমই খেয়েছি, তবে হাতের লেখা না নেওয়ায় নীল ডাউন হওয়া কমন ছিল। আমার লেখা নিতে মনে থাকত না। অনেকদিন লেখা লিখেও ভুলে বাড়িতে রেখে গিয়েছি।
দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন। অসুস্থ হয়ে পড়ায় দু’দিন স্কুলে যেতে পারিনি। সুস্থ হয়ে স্কুলে যেতে ভয় লাগছিল। কারণ, তখন নতুন নিয়ম হয়েছে ক্লাসে। একদিন না গেলে দশ টাকা জরিমানা, সাথে মার ফ্রি। তৃতীয় দিনও মিস গেল। স্কুলে যাব কী যাব না, ভাবছি। তিনদিনে ত্রিশ টাকা জরিমানা। ত্রিশটা বেত্রাঘাত।
ভয়ে স্কুলেই গেলাম না দেড় মাস। ক্লাস টিচার দ্বিজেন স্যারের মার খাওয়ার শখ হয়নি। বাড়িতেই পড়তাম। সহপাঠীদের কাছ থেকে পড়া জেনে নিতাম। এরপর বেশিদিন ক্লাস ছিল না অবশ্য। সামনে নির্বাচনী পরীক্ষা। একেবারে সে সময়ই স্কুলে গেলাম।
ছবি: ইন্টারনেট
আরও পড়ুন: পুরানো সেই দিনের কথা (ছেলেবেলার পোংটামি)