মোবাইল আসার পর নম্বর বানিয়ে মিসকল দেওয়া ছেলেপেলের অভাব বোধহয় বঙ্গমুলুকে কখনোই ছিল না। আমি এসব তো করতামই, এর বাইরে যা করতাম, তা হলো- অপছন্দের শিক্ষকদের নম্বরে মিসকল দিতাম। কলব্যাক করলে রিসিভ করে রেখে দিতাম।
আমিনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক ছিলেন, আমরা ডাকতাম মঞ্জু স্যার। পেটানো স্বাস্থ্য ছিল উনার। গায়ের রং ছিল কুচকুচে কালো। ছেলেপেলেরা তাকে ‘পাঠা স্যার’ ডাকত। যদিও ব্যাপারটা বেয়াদবি পর্যায়ে চলে যেত। কিন্তু সেসবে ভ্রুক্ষেপ করত না কেউ।
কার কাছ থেকে যেন নম্বর পেয়ে উনাকে মিসকল দিলাম। ব্যাক করলেন কিছুক্ষণ পর। রিসিভ করতে ভয় লাগছিল। আমার সঙ্গে যে ছিল, সে বলল, “ভয় কেন? রিসিভ করে রেখে দে।” তাই করলাম। উনি কিছুক্ষণ হ্যালো, হ্যালো করে মোবাইল রেখে দিলেন।
উনার প্রতি ছেলেপেলের রাগের অন্ত ছিল না। সবসময় একটা ভাব নিয়ে থাকতেন। গ্রামের সরকারি স্কুল যেহেতু, আমাদের মতো চাষাভুষার ছেলেমেয়েরাই পড়ত বেশি। আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো। আরও একটা ব্যাপার খারাপ লাগত, যারা প্রভাবশালী তাদের ছেলেমেয়েদের যে যত্ন নেওয়া হতো, আমাদের তার সিকিভাগও নেওয়া হতো না। দেখা গেছে, ইচ্ছে করে পরীক্ষায় ফেল করানো হতো অনেককে। কলেজে উঠার পর এক স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়ায় নম্বর কম দিলেন। একজন তো আমাকে ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ বোর্ড পরীক্ষায় দেখা গেছে ওই বিষয়ে আমি ৮৫+ নম্বর পেয়েছি। এলাকায় যখন প্রাইভেট পড়াতাম, অনেক বছর পরও ওসব শিক্ষকের নামে একই অভিযোগ করত আমার শিক্ষার্থীরা। আমরা তেমন কিছু বলতেও পারতাম না। অনেক ছেলেপেলে ভাবতে শুরু করেছিল, শিক্ষকরা বোধহয় এমনই হয়। এ পেশাটার প্রতি ঘৃণা তৈরি হলো অনেকের।
দ্বিজেন স্যারের ছেলে তন্ময়ের সঙ্গে খাতির ছিল আমার। আমি তাকে শালা সম্বোধন করতাম, সে করত সম্বন্ধী। তাদের বাড়িতে গিয়ে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ায় সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল। তুম্পা নামে তার এক বড়ো বোন ছিল অবশ্য। একবার-দু’বার দেখেছিলাম। সম্পর্ক হয়নি, হওয়ার সুযোগও ছিল না।
তো একবার তন্ময়কে মোবাইলে মেসেজ দিলাম শালা সম্বোধন করে। পরদিন গিয়ে জানতে পারি, আসলে মেসেজটা তার বাবা, মানে দ্বিজেন স্যারের নম্বরে গিয়েছিল। আমি তো ভয়ে শেষ। স্যার অবশ্য কিছু বলেননি। এক-দু’দিন আমাকে দেখলে বিরক্তিভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন।
এ তো গেল দুষ্টুমির কথা। এবার দুটো ভালো ঘটনা বলি। একজন আমাকে কল দিয়ে গালমন্দ করছিলেন। বলছিলেন, টাকার মধ্যে নম্বর লিখে রাখিস। টাকা কি তোর বাপের? হেনতেন আরও কত গালমন্দ। মুখ বুজে সব সহ্য করলাম। ওপাশের অশ্রাব্য গালমন্দ শেষ হলে জানতে চাইলাম, কথা শেষ হলো কি না।
কিছু বলেন না। আমি বললাম, “আপনি কি কখনও টাকায় আপনার নম্বর লিখেছেন?” উনি না বললেন। আমি জানতে চাইলাম, “আপনার তাহলে কেন মনে হলো আমি টাকায় নিজের নম্বর লিখেছি? গালমন্দ শোনার শখে? এমন কি হতে পারে না কেউ শত্রুতা করে আমার নম্বর লিখেছে?” ওপাশের লোক আমার কথায় সায় দিলেন। আমি বোঝাতে সক্ষম হলাম আমি টাকায় নম্বর লিখিনি। উনি মাফ চাইলেন।
ওই সময়টায় অনেকেই শত্রুতা করে এর ওর নম্বর টাকায় অথবা টেবিল বা দেয়ালে লিখে রাখত। বিশেষ করে কোনো মেয়েকে প্রস্তাব দিলে সে রাজি না হলে তার নম্বরটাই লক্ষ্য থাকত। বাথরুমের দরজায় ছেলেমেয়ের নাম লিখে রাখত মাঝখানে যোগ চিহ্ন দিয়ে। আমি অবশ্য অতটা পেকে যাইনি তখনও। মনে পড়ে, কলেজে উঠার পর এক দাদা জিগ্যেস করেছিলেন, “লাভার আছে কি না?” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “এটা আবার কী?” উনি হেসে বলেছিলেন, “বাসায় গিয়ে ডিকশনারি খুঁজে বের করিস।” এখন ভাবলে অবাক লাগে লাভার মানে তখনও বুঝতাম না! এমন না যে লাভ শব্দটা পড়িনি, বা শুনিনি!
যাহোক, ছেলেরা আরও একটা কাজ করত তখন। কারও হাতের লেখা নকল করে এখানে-সেখানে উল্টোপাল্টা লিখে রাখত। একবার একজন পত্রিকার পাতায় এক মডেলের ছবির ওপর বুকের কাছে আমার নাম লিখে রেখেছিল। দন্তস্য এমনভাবে লিখেছিল, ঠিক যেভাবে আমি লিখি। বস্তুতঃ আমার নামটা ঠিক আমার মতোই লিখেছিল। আমি নিজেও দ্বিধান্বিত ছিলাম। যদিও আমি জানতাম, এমন কাজ আমি কখনও করব না। আমার ক্লাসমেট এক কাজিন লেখাটা পড়ে আমার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমি তাকে কিছু বোঝাতে পারিনি।
এবার লেখাটা শেষ করব। এটাও গালমন্দ নিয়ে। আমাকে ফোন করে শালা সম্বোধন করে বকাঝকা করলেন একজন। আমি এবার ঠাণ্ডা মাথায় সব সহ্য করে একসময় বললাম, “দুলাভাই, স্টক শেষ?” ওপাশের লোকটা এবার থতমত খেল। এত গালমন্দের পর কেউ এমন নম্রভাবে কথা বলার কথা না।
উনি বুঝতে পারলেন ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন। উনি বললেন, “আপনি মিশুক না?” আমি বললাম, “মানুষটা আমি মিশুক, কিন্তু আমার নাম মিশুক না।” আমার কথা শুনে উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, “ঠিক আছে দুলাভাই। কাকে ফোন দিলেন; এটা নিশ্চিত হয়েই গালমন্দ বা যা খুশি বলতে পারেন। সবাই আপনার শালা নাও হতে পারে।”
ছবি: ইন্টারনেট