কথা উঠল পড়ালেখা নিয়ে। ছাত্র কেমন ছিলাম, সে প্রসঙ্গও উঠে এল। কথা যেহেতেু উঠলই, খুলে বলা যাক। আমার পড়ালেখা এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে মানসম্মত পড়ালেখা বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। বললে কে কী মনে করে জানি না, সত্যিটা হলো, শিক্ষকেরা আপডেটেড ছিলেন না। কী পড়াতেন না পড়াতেন, বোধকরি নিজেরাও জানতেন না।
মালেক নামের এক শিক্ষক ছিলেন, কাউকে কোনো প্রশ্ন জিগ্যেস করলে সে মুখ বিড়বিড় করলেই হতো, ঠিক না ভুল হচ্ছে; উনি ধরতে পারতেন না। ইংলিশ যিনি পড়াতেন, ঠিকমতো রিডিং পড়তে পারতেন না। গ্রামারে নিজেই অদক্ষ ছিলেন, পড়াবেন কী? বেশি বেশি রাইটিং পার্ট দিতেন। হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষকই ছিলেনই না। বিজ্ঞানের শিক্ষক পড়াতেন হিসাববিজ্ঞান। আমরা মিলন নামের বাইরের একজনের কাছে প্রাইভেট পড়ে নিতাম।
আমার রোল নম্বর হাইস্কুলে বেশিরভাগ সময় ৫ থাকত। নবম শ্রেণিতে একবার শুধু ৬ হয়। বলা চলে, মাঝারি মানের ছাত্র ছিলাম। ১-৩ পর্যন্ত রোল সবসময় মেয়েদেরই থাকত। মাঝেমধ্যে শিক্ষকদের মার খেলেও পরীক্ষায় ফল অত খারাপ হতো না। যদিও প্রাথমিকে তেমন ভালো করতে পারিনি। কোনো মতে পাশ করে গেছি। তবে হাইস্কুলে মোটামুটি ভালো হয়েছে।
আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তিন ভাইবোনের পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া আমার মা-বাবার জন্য কঠিন ছিল। যা সহযোগিতা পেয়েছি, মামারাই করেছেন। শিক্ষকগণও যেহেতু অদক্ষ ছিলেন, প্রাইভেট পড়া জরুরি ছিল। কিন্তু শিক্ষক পাব কই? যেতে হতো উপজেলা সদরে। যেহেতু আর্থিক অবস্থা খারাপ, বাসায়ই নিজে নিজে পড়তাম। বোন গণিত বুঝিয়ে দিত। ইংলিশে মোটামুটি ভালো ছিলাম।
কোচিংয়ের খোঁজ করতাম। এগুলোতে কম পয়সায় সব বিষয় পড়ানো হয়। কিন্তু আশপাশের ৪-৫ গ্রামে কোনো কোচিং ছিল না।
কলেজে উঠে প্রথম বর্ষ ভালোই যায়। নিজে নিজে সব বুঝতে পারি। কিন্তু দেখা গেল প্রাইভেট না পড়ার কারণে পরীক্ষায় নাম্বার কম আসে। হিসাববিজ্ঞান স্যার তো ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিলেন। আত্মবিশ্বাস ছিল আমার, জানতাম বোর্ড পরীক্ষায় ভালো করব। মোটামুটি ফল করেছিলাম। এ প্লাস না পেলেও একটা ফল করেছিলাম, যা আমাকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় উপজেলায় প্রথম করেছিল।
নির্বাচনি পরীক্ষার পর কয়েকমাস কোচিং করেছিলাম ভালুকা সদরে। ক্লাস করে যতটা না উপকৃত হয়েছি, তারচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি পরীক্ষা দিয়ে। নিজের ভুলগুলো ধরা পড়ত। একজন-দু'জন শিক্ষক যখন প্রশংসা করতেন, উৎসাহ পেতাম। যা পড়তে প্ররোচিত করত।
এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। এর আগে কোচিং করি ময়মনসিংহে গিয়ে। যাহোক, সুবিধা করতে পারিনি তেমন। শেষমেশ একটা প্রত্যন্ত গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়। আগ্রহ ছিল না ভর্তি হওয়ার। কারণ, এখানে থেকে নিজের খরচ নিজে চালাতে পারব না মনে হচ্ছিল। কিন্তু কী করব? ঢাকার কোথাও তো চান্স হলো না।
পরীক্ষা দিয়েছিলাম দুই ইউনিটে। মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ব্যবসায় প্রশাসনের একটা বিষয় পেলাম। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা। অন্য ইউনিটে বাংলা দিল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। নবম শ্রেণিতে উঠার পর ব্যবসায় শিক্ষা নিয়েছিলাম বোনের পরামর্শে। নিজে বুঝতে পারছিলাম না কী নেব। এবারও একজন পরামর্শ দিল ব্যবসায় প্রশাসনে ভর্তি হতে। ভর্তি হলাম হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে, মানে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায়। লোকজন বলাবলি করছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টা প্রথম। চাকরিতে সুবিধে করা যাবে। সবার পরামর্শে প্ররোচিত হলাম। এরপর একসময় বুঝলাম কী ভুল করেছি।
এ সংশ্লিষ্ট আরেকটা লেখা: প্রেম করলাম কার লগে আর বিয়া করলাম কারে?
আসলে আমার পছন্দের বিষয় ছিল ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি। মাধ্যমিকে ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে এগুলো নিয়ে চর্চা করতে পারতাম। তখন তো পড়ালেখা অল্প ছিল, পড়তে কোনো সমস্যা হয়নি। এখন তো অকূল পাথারে পড়লাম! উপলব্ধি করলাম, জোর করে আর যাহোক পড়ালেখা হয় না। ভুলের মাশুলও দিলাম। ফলও হলো যাচ্ছেতাই।
পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারাটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। আমার খুব আফসোস হলো এটা ভেবে যে, কেন বাংলায় ভর্তি হলাম না। বলা হয়েছিল, চাইলে ইংলিশে ভর্তি হতে পারব। আমি কী দুর্ভাগা; এমন একটা সুযোগ হেলায় ফেললাম।
ব্যবসায় প্রশাসন আমার কখনও ভালো লাগেনি। যদিও পড়ালেখাটাই একসময় বিরক্ত লাগত। কিন্তু তবুও হাইস্কুল-কলেজে অতটা খারাপ হয়নি। অল্পবিস্তর যাই পড়তাম, কুলিয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম, এখানে পেছনের বেঞ্চে বসা ছেলেটাও ভালো করছে। আমি নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলাম।
কোনোমতে অনার্স শেষ করলাম। জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে পুরোপুরি অপ্রস্তুত আমি। চাকরিবাকরি বা কোনোকিছুর জন্যই উপযুক্ত হতে পারিনি। তবুও ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়ি। আমার অর্থোপার্জন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঠাঁই হলো না কোথাও। দুনিয়ায় যোগ্যতা-দক্ষতা ছাড়া টেকা যায়? কোথাও ঠাঁই না পেয়ে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাই। মাস্টার্সটা শেষ করা দরকার। যদি চাকরি পেয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো মাস্টার্স করতাম না।
একসময় মাস্টার্সটা শেষ করি। এরমধ্যেই একটা স্কুলে ঢুকে পড়ি। পাশাপাশি টিউশনি চলতে থাকে।
ছবি: বিবিসি
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৩৬