somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’

২০ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার জনৈক ছাত্র একবার জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনি কি কখনও গালমন্দ করেছেন?’
আমি বললাম, ‘রাগ হলে করি তো।’
‘কী কী?’ সে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল।
আমি বললাম, ‘এই ধরো বদমাশ, হারামজাদা ব্লা ব্লা ব্লা।’

সে হাসতে লাগল। হাসির কারণ জানতে চাইলে বলল, ‘এগুলো কোনো গালি হলো?’

তৎক্ষণাৎ মনে হলো, আসলেই তো। এগুলো তো কোনো গালিই না। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দেখতাম সহপাঠীদের অনেকে একে-ওকে হুটহাট গালাগাল করছে। মা-বাপ তুলেও গালি দিচ্ছে। আর ওরা এগুলো স্বাভাবিক ভাবেই নিত। আমার গা রি রি করত। এ জন্য বোধহয় দুই-চারজন ছাড়া বন্ধু জোটেনি তেমন। আমার ঘনিষ্ঠরা আমার মতোই। সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের সাথে যখন তুমি সম্বোধন করে কথা বলি, অনেকে তো বলে বসে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নাকি!

গাজীপুরে থাকতে দেখতাম গালির আরও আধুনিক ভার্সন। আট-দশ বছরের পোলাপানও মা-বাপ তুলে গালি দেয়। কী বিচ্ছিরি কাণ্ড। ঢাকায় আসার পর দেখলাম এখানে আরও আধুনিক ভার্সন। চালক গাড়ি ছাড়তে দেরি করলে তাকেও মা-বাপ তুলে গালি দেয় শিক্ষিতদের অনেকে। রিকশাওয়ালা-সিএনজিওয়ালারা তো গালি ছাড়া কথাই বলে না।

মোটামুটি আমিও কিছু গালি রপ্ত করেছি। তবে বাস্তবে প্রয়োগ তেমন করতে পারি না। গাজীপুরে প্রয়োগের চেষ্টা করেছি। পরিচিতরা গালি শুনে হাসে। বলে, ‘এগুলো হয় না।’ কয়েকদিন আগে বাড়ি গেলাম। মা কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমার ছেলে গালাগাল করেনি কখনও।

অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। মনে হলো, নতুন শেখা গালিগুলো ঠিকমতো প্রয়োগ করা হবে না। যদিও মনে মনে বা বিড়বিড় করে গালাগাল দিতেই হয়।

দুই
স্কুলের শিক্ষককে রাস্তায় বা বাজারে দেখলে দূর থেকে দৌড়ে পালাতাম। আর সামনে পড়ে গেলে আদাব-সালাম দিয়ে কোনোমতে পগারপার। দিন বদল হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের গায়ে হাতও তুলে। কোনো ছাত্রকে একটা ধমক দিলে স্কুলে মা-বাপ নিয়ে আসে। পরীক্ষায় নম্বর পর পেলে শিক্ষকের ওপর খবরদারি করে। জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনাও ঘটে। অথচ আমাদের শিক্ষকেরা অন্যায়ভাবে মারধর করলেও কখনও প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তাও করতে পারতাম না।

তিন
আপনি পিতৃসম একজনকে গালমন্দ করলেন। আপনার ভাই-ভাতিজা-ছেলে সেটা দেখল। তারাও আপনার সাথে অংশীদার হলো। আপনি মনে করলেন জিতে গেলেন। আরেকদিন বাগে পেয়ে সেই লোক আপনাকে অপমান করল, তার ছেলেপেলেরাও সঙ্গ দিল। ফলাফল ১-১? তাই না? মোটেই না। একটি প্রজন্ম তৈরি হলো, যারা বড়দের মান্য করে না। সমাজে ধ্বংসের শুরু। একজন খুনিকেও আপনি খুন করতে পারেন না। এতে দু’জনই অপরাধী হয়ে গেলেন। এ জন্য আইন আছে। আইন সচল না থাকলে সচল করতে হবে, সভ্য জগতে কোনোভাবেই নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া যাবে না। 

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক কারণে অনেকে এসব প্রশ্রয় দেয়। যেমন প্রশ্রয় দেয় মব বায়োলেন্সে। ফলাফল তো চারপাশে দেখাই যাচ্ছে। যে যাকে পাচ্ছে পেটাচ্ছে। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়েরও চেষ্টাও করে না।

চার
মা কারখানায় কাজ করেন। ভালোমন্দ রান্না করেছেন দু’জনের জন্য। এরপর নাইতে গেলেন। এসে দেখলেন খাবার সাবাড়। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, আমার জন্য রাখলি না?’
‘খাবার মজা ছিল খেয়ে ফেলেছি।’

অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের এমন উত্তরে মা বাকরুদ্ধ। কিন্তু এ দায়টা কি মায়েরও নয়? ছেলের মধ্যে মানবিকতা জাগানোর চেষ্টা তো থাকা উচিত।

অনুরূপ ঘটনা। ছেলের টাকা লাগবে। মায়ের কাছে বললে মা অপারগতা জানালেন। ছেলের টাকা লাগবেই লাগবে। কী দরকার? বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে। এই ছেলেটা বড় হয়ে কী হবে? মোটরসাইকেল কেনার জন্য মা-বাবার কাছে টাকা চাইবে অথবা নেশার টাকার জন্য মা-বাবার গায়ে হাত তুলতে পিছপা হবে না।

পাঁচ
একজন প্রকাশক সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন বইয়ের ব্যবসায় মন্দা। উনি কোনোভাবেই পেরে উঠছেন না। এটা আজকের ঘটনা না। বই না পড়া প্রজন্ম গত দুই দশক ধরেই বেড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ফেসবুক আসার পর থেকে। বিশাল এক অংশ বই না পড়েই জ্ঞানী। ফেসবুক থাকতে অন্য বুক পড়ার তাগিদও নেই। মা-বাবাও চান না শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে সন্তান পড়ে থাকুক। সন্তান ডাক্তার-প্রকৌশলী হোক। মানুষ হওয়ার কী দরকার?

ছয়
আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া ভেবেছিলাম,
যার উদ্দেশে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ
প্রশস্তি লিখেছিলাম;
গতকাল বলাইবাবু বললেন, ‘ঐটি বানরলাঠি গাছ।’
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বকলস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম,
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্‌ পেন হয়ে গেছে,
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন;
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।

আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে
-তারাপদ রায়
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ১২:৫২
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×