
রাত্রিকালীন ডিউটি ছিল। ডিউটি শেষে অফিস থেকে বের হতে হতেই সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেল। বাসে করে সৈনিক ক্লাব এলাম। এরপর হাতের ডান পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে ফুটওভারব্রিজ; ব্রিজ পেরিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি মোড়ে দাঁড়াতেই দেখলাম এক অন্ধ বৃদ্ধা রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে তাকে রাস্তা পার করে দিলাম। এর মাঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবেন’?
উনি বললেন, ‘সড়ক ভবনে যাব’।
‘সড়ক ভবন তো পার হয়ে এসেছেন।’
‘গাড়িওয়ালাকে বলেছি সড়ক ভবনের সামনে নামাতে। কোথায় নামাল?’
আমি বললাম, ‘গাড়ি টান মেরে একটু বেশি চলে এসেছে। অসুবিধে নেই। চলুন আমি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি’।
আমার যাওয়ার রাস্তা ছিল চেয়ারম্যান বাড়ির ভেতর দিয়ে। ভেবেছিলাম সেলুন থেকে দাড়ি কামিয়ে বাসায় গিয়ে সিনান করে একটা ঘুম দেব। আজ রাতেও আবার ডিউটি আছে। রাত্রিকালীন ডিউটি থাকলেও শেষরাতের দিকে একটু ঘুমানোর সুযোগ থাকে। অন্যদের যখন নাইট ডিউটি থাকে তারা ঘুমায়। কিন্তু সেসময় দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। কখন কোন ডাক পড়ে যায়! যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস হয়! আজও নির্ঘুম রাত কেটেছে।
যাহোক, সড়ক ভবনের দিকে হাঁটছি বৃদ্ধাকে সাথে নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কাজ সেখানে’?
‘একটা জমির কাজ আছে’।
‘আপনার বাড়ি কোথায়’?
‘বাড়ি মাদারীপুর। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সাভারে আছি’।
‘আপনার স্বামী-সন্তান’?’
‘স্বামী সৌদি আরবে আছে। বিয়ের পরপরই চলে গেছে। আর সংসার হয়নি’।
‘অন্ধ হলেন কবে’?
‘সাত বছর হলো’।
‘চলেন কেমনে? আয়-রোজগার কেমনে’?
‘আমার বোনেরা আছে। সরকারিভাবে কিছু টাকা পাই। এছাড়া একটা চক্ষু হাসপাতাল করেছি (ছাপড়ার মতো ঘর তুলে)। এ দিয়ে চলে যায়’।
কথায় কথায় উনি জানালেন, মাস্টার্স পর্যন্ত পড়েছেন। অবাক হলাম না যদিও। কারণ কথাবার্তায় উনাকে সম্ভান্ত ঘরের নারী এবং উচ্চশিক্ষিত মনে হয়েছে।
আমি বললাম, ‘আমি যে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনার মনে হয় না আমি আপনাকে বেচে দেব? অথবা আপনার ব্যাগে কী আছে, তা নিয়ে দৌড় দেব’?
উনি হেসে বললেন, ‘তেমন মনে হয়নি। আর অন্ধ মানুষের প্রতি এত নির্দয় কে হবে’?
মনে মনে বললাম, ‘হয়তো দুষ্টলোকের পাল্লায় পড়েননি। মানুষ এখন কসাইয়ের চেয়েও নির্মম। আপনি চিকিৎসার জন্য টাকা নিয়ে যাবেন, সেই টাকা মারার জন্য কতজন ওঁত পেতে থাকে! বেকারদের চাকরি দেওয়ার নামে কত কত প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে’!
সড়ক ভবনের তিন তলায় উঠলাম। বৃদ্ধার হাত ধরে আছি। লোকজন সালাম দিচ্ছে। কোন রুমে যেতে হবে, কেউ কেউ তা দেখিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধা জানালেন, এখানকার সবাই তাকে চেনে।
শাহনাজ নামে এক ম্যাডামের রুমে গেলাম। ওঁর বয়স ২৮-৩০ এর মতো হবে মনে হয়। বোরখা পরা। মুখ ঢাকা, শুধু চোখ দেখা যায়। আন্তরিকতার সাথে উনি আমাদের বসতে বললেন। আমি বৃদ্ধার কেউ হই কি না জানতে চাইলেন। বৃদ্ধা বললেন, ‘কেউ হয় না। আমার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে’।
বৃদ্ধা কিছু কাগজপত্র শাহনাজ ম্যাডামকে দেখালেন। ওঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। কিছু কিছু বুঝলাম, বেশিরভাগই বুঝলাম না। জমি-জিরাতের হিসেব তেমন বুঝি না। নিজের কতটুকু পৈতৃক জমি আছে, দাম কেমন; সেসব সম্পর্কেও মৌলিক ধারণাটুকুও নেই আমার। ভবিষ্যতে কপালে খারাপি আছে।
যতটুকু বুঝলাম, তা হলো- মহিলা সরকারি একটা জমি বনায়নের আওতায় লিজ নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেটা বুঝে পাচ্ছেন না। পনেরো বছর ধরে উনি এখানে আসছেন। সাভারের সে জায়গায় এতদিনে জনবসতি ঘরে উঠেছে। সেখানে বনায়নের জন্য সরকারিভাবে লিজ দেওয়া সম্ভব না। সংশোধনি কাগজে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নামও লেখা দেখলাম। বনায়ন না হওয়ায় সম্ভবত সেখানে আবেদন করার কথা বলা হয়েছে।
শাহনাজ ম্যাডাম আমাকে বললেন, ‘উনি ওই জায়গাটা বনায়নের আওতায় লিজ নিয়ে সেখানে নাকি হাসপাতাল করবেন’।
‘সম্ভব কি না’? আমি জানতে চাইলাম।
‘সেটা এখন সম্ভব না। সরকার উনাকে মানবিক কারণে সেখানে থাকতে দিয়েছে’।
বৃদ্ধাকে উনি বললেন, ‘আপনি সেখানে কোনো ভবন তুলতে পারবেন না। আপাতত যেমনে আছেন থাকতে থাকেন’।
বৃদ্ধা তো নাছোড়বান্দা। উনি আধাঘণ্টা যাবত কথা চালিয়ে গেলেন। শাহনাজ ম্যাডাম সব শুনলেন; বললেন, ‘আপনার উদ্দেশ্য অবশ্যই ভালো। অন্ধদের জন্য কিছু করতে চাচ্ছেন। সেটা গ্রামেও করতে পারতেন’।
বৃদ্ধা বললেন, ‘গ্রাম ছেড়েছি বহু আগে। এখন সব অচেনা। এখানেই ব্যবস্থা করে দিন’।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা একটা অফিস থেকে লিখিত আনতে বলা হলো। বৃদ্ধা চাচ্ছিলেন কেউ গিয়ে জমিটা মেপে আসুক। কিছু করা যায় কি না দেখুক। আশপাশের লোকজন উনাকে জ্বালাতন করছে খুব।
শাহনাজ ম্যাডাম বললেন, ‘উপর থেকে লিখিত আনুন। হুট করে তো জমি মাপতে যাওয়া যায় না। আগেও একবার যাওয়া হয়েছে। এখন লিখিত আদেশ লাগবে’।
আমি বৃদ্ধাকে কী বোঝাব, বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটুকু বুঝিতে পেরেছি, উনার কাজ হবে না। আমৃত্যু এভাবে আসা-যাওয়া করতে হবে। আমি নিজে কিছু করতে পারব না; এটা ভেবেও অস্বস্তি লাগছিল। বৃদ্ধাকে বললাম, ‘আমার মনে হয় আপনার এই আশা বাদ দেওয়া উচিত’। পরক্ষণে মনে হলো, মহিলা যে পনেরো বছর ধরে এখানে আসছেন, হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিলে উনি যে আশায় বেঁচে আছেন, সে আশা তো শেষ হয়ে যাবে। যদিও এটা আশা না, মরীচিকা।
মহিলা বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আমাকে আগে থেকেই না করত। এতদিন ঘুরলাম’।
বৃদ্ধাকে নিয়ে ভবনের নিচে একটা বেঞ্চে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু খাবেন কি না’? উনি কিছু বললেন না। সাথে পাউরুটি ছিল। প্যাকেট খুলে দিলাম দুটো টুকরো। গোগ্রাসে গিললেন। মনে হলো উনি খুব ক্ষুধার্ত।
আমি বললাম, ‘ভাত খাবেন’?
‘না, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে’।
তাকে নিয়ে আমি রাস্তার পাশে এলাম। তেজগাঁও যেতে হবে। আমি তাকে নাবিস্কোর একটা বাসে তুলে দিলাম। বললাম, ‘সেখানে নেমে রিকশায় উঠবেন’।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি চিনি’।
গাড়ি চলতে লাগল। আমি দেখলাম গাড়ির হেল্পার মহিলাকে হাতে ধরে সিটে বসাচ্ছেন।
ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


