পাবনা শুনলেই আমাদের মনে কেনো জানি চলে আসে পাগলাগারদ আর হেমায়েতপুর এর নাম। আমার দেশ পাবনা। কাউকে এটা বলা মাত্রই তার মুখে মুচকি হাসি দেখা যায়। ওহ তাই নাকি?? তো হেমায়েতপুরের কোন দিকে?? এটা থাকে পরের প্রশ্ন। আমিও বলি আরে আমরা তো পাগলপ্রুফ। যারা পাগল তাদের চিকিতসা করি। তাই পুরা বাংলাদেশ এর বাকি সব পাগলেরা এখানে আসে।
যাই হোক।
একবার শখ হল যাই পাগলখানা দেখে আসি। তখন ক্লাস ১ এ পড়ি। গেলাম। আমি যেন এর থেকে বড় মজাদার নাটক আর দেখিনি।
অনেক দিন কেটে গেল এরপর। পাবনায় যাওয়া হয় কিন্তু পাগলাগারদ আর দেখা হয়না। যখন মেডিকেলে ২য় বর্ষে পড়ি তখন মনে হল আবার দেখে আসি কি অবস্থা ওখানকার। গেলাম আবার হেমায়েতপুর পাগলা গারদে। ছোটবেলায় একবার দেখা সেই মজাদার নাটকের পিছনের একেকজনের চোখের জল, বিপন্ন মানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা সব তখন দেখতে পাচ্ছিলাম। ছোট বেলায় যে ভাষা আমি বুঝিনি তা তখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতব সত্য হয়ে সামনে দাড়াচ্ছিল।
প্রথমে গেলাম পুরুষদের সাধারন ওয়ার্ডে। ওখানে পায়ে শিকল বেধে কোরবানীর গরুর মত আটকে রাখা হয়েছে কতকজনকে(মানুষ বলব কিনা জানিনা, কারন এরা যে জীবন পার করছে তা মানুষের জীবন হতে পারে না)। ডাক্তার বলে ভিতরে ঢুকতে চাইলাম। কিন্তু মেল ওয়ার্ডে ফিমেল ডক্টরের সিকিউরিটি প্রবলেম হতে পারে বলে পারমিশান দিলনা। তবে বাইরে থেকে পেশেন্টএর সাথে কথা বলা যাবে। প্রথমে একজনকে জিগেস করলাম কি হয়েছে আপনার?ছেলেটার বয়স ২২ -২৩ হবে। জবাব দিল আমার কিছু হয় নাই। আমাকে এখানে আটকায়ে রাখছে। জমি জমা নিয়ে বিরোধ করে আমার চাচা আমাকে এখানে আটকানোর ব্যবস্থা করছে? আমার মা কে কোথায় রাখছে কে জানে? আমার মায়ের আমি ছাড়া কেউ নাই.।আমি ও এখানে থেকে বের হতে পারতেছিনা বলে মায়ের খোজ নিতে পারতেছিনা.।বলে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করল।পাশে থেকে দারোয়ান বলল এই চুপ থাক্ উলটা পালটা কথা বললে দিব একটা মাইর। আমি হতবাক!! এর পরে আরেক জন জানালার পাশে থেকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকল। কাছে যেতেই ২ টাকা র একটা নোট দিয়ে বলল আমার ঠিকানা বলতেছি আমার বাসায় জানাতে পারবেন আমি বাচতে চাই না। আমি অবাক হলাম। কিছু জিগেস করব তার আগেই দাড়োয়ান বলল- দেখছেন পাগল কি বলে??
কি হতে পারে একটা মানুষের জীবনে যার জন্য মানুষ বাচতে চায় না!! কি অমানুষিক যন্ত্রনা যখন মৃত্যুও যন্ত্রনার অবসান ঘটাতে পারেনা। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল তার কষ্টের কথাগুলো শুনি। কিন্তু সম্ভব হলো না দাড়োয়ান এর কারনে।দাড়োয়ান আরেক পাগল কে ডাকল....এই এদিকে আয় ইনাদের গান শুনায়ে যা। উনি এসে গান শুনাতে শুরু করল। আমি উনার দিকে চেয়ে রইলাম।
কিন্তু কি কষ্টকর এই যে জীবন। ভালবাসার অভাবে অনেকে পাগল হয়। পাগলা গারদে এদের বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু কেন?? ভালবাসার কতটা অভাব এদের! কেউ কি নেই পৃথিবীতে এদের কে ভালবেসে কাছে টেনে নেয়ার। কেউ কি ছিলনা তার মানসিক বিপর্যয়ের সময়ে তার পাশে থাকার!! এত টাই কি সে হতভাগা। পৃথিবী কি এতটাই ভালবাসাহীন হয়ে গেছে যে ৫০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে সে একজন ও মানুষ পায় নি যে তাকে আপন করে নেবে? মা , বাবা, ভাই বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী, সন্তান , বন্ধু কেউ কি নেই? মানুষের নিষ্ঠুরতা কোন পর্যায়ে পৌছালে ভাইয়ের সন্তানকে শুধু মাত্র জমি র জন্য.....কিছু টাকা র জন্য এখানে পশুর মত বন্দী করে রাখে। কতটা অমানুষ হলে এটা সম্ভব?হয়ত এই মানুসটিই যেদিন জন্মেছিল সেদিন এই চাচাই ছিল সবচেয়ে আনন্দিত মানুষের দলে। হয়ত এই ভাতিজাকেই সে বাচ্চা কালে কোলে নিয়ে ঘুরেছে, কাধে চড়িয়ে বেড়িয়েছে। তারপরে কি হল?? ভালবাসা কি এত তারাতারি এই এক জীবনেই শেষ হয়ে গেল!! এই জীবন দেখার থেকে তাদের কে মেরে ফেলা ভাল। চাচা তুমি পারলে এসে একে মেরে ফেলে রেখে যাও। মৃত্যুর চেয়েও বেশী যন্ত্রনাদায়ক বেশি কঠিন এই জীবন।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তারাতারি বের হব। আমার ওখানে পুরা দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি কি দেখছি এখানে?? কি দেখতে এসেছি??
ফিমেল ওয়ার্ডে যেতে চাইলাম। ফিমেল ওয়ার্ড সেদিন যে কোনো দর্শনার্থী ঢোকা নিষেধ । এক ফিমেল পেশেন্ট যে কিনা গত ৪-৫ বছর ধরে এখানে বন্দী সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। কেউ দোষ দেয় ডাক্তার কে, কেউ ওয়ার্ড বয় কে, কেউ দাড়োয়ান কে, কেউ মালিকে, কেউ বাবুর্চিকে। ফিমেল পেশেন্টের এখানে কিছু বলবার ই নেই। কারন সে পাগল। আল্লাহ পৃথিবী এত কঠিন কেন??
আমি চলে আসলাম। আর ভাল লাগলনা।
আমি আর পাগলা গারদে যাইনি কোনোদিন। দীর্ঘ্য সাত বছর পার হয়ে গেছে এরপর। আর যেতে ইচ্ছা করে না ওখানে। আমি মেডিকেলে পড়েছি, কাজ করেছি। অনেক অনেক অসুস্থ মানুষ দেখেছি। কিন্তু অসুস্থ মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন আর কি কোথাও দেখেছি? হা দেখেছি। ওটা অন্য কোনোদিন বলা যাবে।
যাই হোক। আমার জীবনে এরপর থেকে একটা পরিবর্তন এসেছে। আমার পাগলা গারদ নাম শুনলে হাসি পায় না। হেমায়েতপুর নাম শুনলে মুখ বাকা হয়ে যায় না। দুঃখ কষ্ট বেদনার নিস্থুরতার কত গল্প ওখানে জমা হয়ে আছে কে জানে!! আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়! ওদের কাছে গিয়ে ওদের কে ওখান থেকে মুক্ত করতে খুব ইচ্ছা হয়। কবে ওদের মুক্তি মিলবে?? আদৌ কি কোনো দিন ওরা খোলা আকাশ দেখতে পাবে? কি হবে?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১১ সকাল ১০:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



