(সুদীর্ঘ ৩০০ বছরের পুরাতন সুপ্রসিদ্ধ ও বিরল গ্রন্থ মাক্কামাতে মাযহারী হতে ):
মকতুব―১৪
আপনি প্রশ্ন করেছেন, ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আরবের মুশরিকদের মতো মূলহীন ধর্মের অনুসারী, নাকি তাদের ধর্মের কোনো মৌলিকতা ছিলো, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। এ ধর্মের অনুসারীদের সম্পর্কে কীরূপ ধারণা রাখা উচিত।
যথার্থতা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হচ্ছে৩৪। জেনে রাখা উচিত যে, হিন্দু ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থাবলী থেকে যা জানা যায়৩৫ তা হচ্ছে− মানব জাতি সৃষ্টির প্রথম লগ্নে রহমতে এলাহি মানুষের দুনিয়া ও পরবর্তী জগতের সংশোধনের জন্য বেদ নামক একটি কিতাব বারহামা নামক এক ফেরেশতার মাধ্যমে প্রেরণ করে, যা দুনিয়ার সবকিছু সৃষ্টির ওসিলা। এ কিতাবটি চার দফতরে সন্নিবেশিত ছিলো। তার মূলে ছিলো আদেশ নিষেধের বিধান এবং অতীত ও ভবিষ্যতের সংবাদ। এজতেহাদকারীগণ ওই কিতাব থেকে দু’টি মাযহাব বেরকরেছিলেন। গ্রন্থখানি ছিলো আকায়েদ সংক্রান্ত উসুলের ভিত্তি। তাঁরা পুস্তকটির নাম দিয়েছিলেন ধর্মশাস্ত্র যা ঈমান সংক্রান্ত বিষয়। মূলতঃ এলমে কালামের বিষয়ে পুস্তকটিতে আলোচনা করা হয়েছে। মানব জাতিকে তাঁরা চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন এবং চার শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ করেছিলেন চারটি মাসলাক (মূলনীতি)।
শাখা-প্রশাখার আমলও তাঁরা নির্ধারণ করে দেন। গ্রন্থটির নাম দেন কর্মশাস্ত্র। অর্থাৎ আমল বিষয়ক গ্রন্থ, যাকে এলমে ফেকাহ্ বলা হয়। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা যেহেতু ধর্মীয় বিধান পরিবর্তনের বিষয় অস্বীকার করে, অথচ প্রত্যেক যুগের জ্ঞানীগণের স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন অপরিহার্য, তাই তারা দুনিয়ার দীর্ঘ আয়ুকে চার ভাগে বিভক্ত করে এবং প্রত্যেক ভাগের নামকরণ করে যুগ। প্রত্যেক যুগের জন্য চার দফতর থেকে আমল নির্ধারণ করে। শেষ যুগের হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা ধর্মে যে পরিবর্তন সাধন করে, তা অগ্রহণযোগ্য। এক সময় এ হিন্দু ধর্মের চার শ্রেণীই আল্লাহ্তায়ালার তওহীদের উপর একমত ছিলো। তারা দুনিয়াকে আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্টি বলে জানতো। দুনিয়া ধ্বংস হওয়া, ভালো ও মন্দ আমলের প্রতিদান, হাশর ও হিসাব নিকাশকে স্বীকার করতো। আকলী ও নকলী এলেম, রিয়াজত ও সাধনা, কাশফ ও মারেফত প্রভৃতি বিষয়ে তাদের যথেষ্ট দখল ছিলো। তাদের পণ্ডিতগণ মানব জীবনকে চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। প্রথমভাগে
রয়েছে এলেম শিক্ষা, দ্বিতীয় ভাগে জীবিকা উপার্জন ও সন্তান উৎপাদন, তৃতীয় ভাগে আমল সংশোধন এবং নফসের বিশুদ্ধতা অর্জন, আর চতুর্ ভাগে নির্লিপ্তি অর্জন, যা মানবীয় পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়। বৃহৎ মুক্তি তার উপরই নির্ভর করে, তাদের ভাষায় যাকে বলা হয় মহামুক্তি। বহু পূর্বে এ ধর্মের বিধি বিধানের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ জীবনশৃংখলা ছিলো। এটি ছিলো একটি গ্রহণযোগ্য ধর্মমত, যা বর্তমানে রহিত হয়ে গিয়েছে। শরীয়তে অবশ্য ইহুদি ও নাসারা ধর্ম রহিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম রহিত হওয়ার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। অথচ এই দু’টি ধর্ম ছাড়া
আরও অনেক ধর্ম রহিত হয়েছে। অনেক ধর্ম জন্ম নিয়েছে এবং শেষও হয়ে গিয়েছে। কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ওয়া ইম্মিন উম্মাতিন ইলা খালাফীহা নাযীর’ ৩৬ (এমন কোনো সমপ্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি) এবং ‘ওয়ালিকুলিউম্বমাতির রসূল’ ৩৭ (প্রত্যেক জাতির জন্য আছে একজন রসুল)। রসুল প্রেরণের বিষয়ে আরও আয়াত আছে। এ সকল আয়াতের আলোকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতবর্ষেও নবী রসুলগণের আগমন ঘটেছিলো। তাঁদের সম্পর্কে তাঁদের আপন আপন গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ধর্মে বিদ্যমান আমলসমূহ থেকেও প্রকাশ পায় যে, ওই সকল ধর্মের অনুসারীরা পূর্ণতার স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। এ বিশাল দেশ থেকে ধর্মের রীতি নীতি ও মানবীয় ৩৮ বিষয়াবলীর কথা মানুষ ভুলে যায়নি। একটি বিখ্যাত উক্তি ৩৯ রসুলেপাক স. এর আর্বিভাবের পূর্বে প্রত্যেক কাওমের জন্য পয়গম্বর
প্রেরণ করা হয়েছিলো এবং প্রত্যেক কাওমের জন্য কেবল তাদের পয়গম্বরের আনুগত্য করা ওয়াজিব ছিলো। অন্য কাওমের পয়গম্বরের নয়।আমাদের নবী মোহাম্মদ মোস্তফা স. যিনি খাতেমুল মুরসালীন এবং সকল মানুষের নবী, তাঁর আবির্ভাবের পর সকল মাযহাব এবং পূর্ব পশ্চিমের সকল ধর্ম রহিত হয়ে গিয়েছে। দুনিয়া যতদিন বিদ্যমান থাকবে, ততদিন তাঁর নাফরমানী করার কোনো সুযোগ কারো নেই। রসুলেপাক স. এর মহাআবির্ভাবের পর আজ
পর্যন্ত একহাজার একশ (কিতাব রচনার কালে) আশি বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যে এ ধর্ম গ্রহণ করেনি, সে কাফের। কিন্তু ইসলাম আত্মপ্রকাশ করার পূর্বের লোকদের অবস্থা এরকম নয়। ‘মিনহুম মান কাসাসনা আ’লাইকা ওয়া মিনহুম মাললাম মাক্বসুস আ’লাইকা’ (আমি তাদের কারও কথা তোমার নিকট বিবৃত করেছি এবং কারও কারও কথা তোমার নিকট বিবৃত করিনি)― এই আয়াতের আলোকে দেখা যায়, শরীয়ত অধিকাংশ নবীর বিষয়ে বর্ণনা করা থেকে নিরবতা অবলম্বন করেছে। সুতরাং ভারতবর্ষে নবী রসুল আগমনের বিষয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। কোনো নবী যদি আগমন করেও থাকেন, এখন আমাদের সে নবীর অনুসরণ না করাতে কুফুরীর ও ধ্বংসের একীন করা লাজেম নয় এবং তাঁর অনুসরণ করলে নাজাত পাওয়া যাবে― এমন একীন করাও ওয়াজিব নয়। এ বিষয়ে কেবল ভালো ধারণা পোষণ করতে হবে। কোনোক্রমেই বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ৪১
শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নয়, পারস্য দেশ এমনকি সকল দেশের মানুষের জন্যই― যারা রসুলে পাক স. এর মহাআবির্ভাবের পূর্বে গত হয়ে গিয়েছে, শরীয়ত তাদের বিষয়ে নীরব। তাদের বিধি-বিধান ও জীবনধারা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনপ্রণালীর অনুকূলে ছিলো− এরকম আকীদা রাখাই উত্তম। আর অকাট্য দলিল ছাড়া কাউকে কাফের বলা উচিতও নয়। ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তিপূজার প্রকৃত তত্ত্ব হচ্ছে― তারা মনে করে কতিপয় ফেরেশতা (দেবতা) আছে, যারা আল্লাহ্তায়ালার হুকুমে পৃথিবীতে সৃষ্টি ও ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে। অথবা তারা মনে করে, কিছু কিছু কামেল লোকের আত্মা দেহ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও পৃথিবীতে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম।
আবার কিছু কিছু লোক এমন আছেন, যাঁরা খিজির আ. এর মতো জীবিত আছেন। তারা তাঁদের প্রতিকৃতি বানিয়ে সে গুলোর দিকে আত্মিক মনোযোগ নিবদ্ধ রাখে। এমনি আত্মিক মনযোগের মাধ্যমে কিছুদিন পর মূল ব্যক্তিটির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নেয় এবং উক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়োজন পূরণ করে থাকে। তাদের এই আমলটি জিকিরে রাবেতার সাথে বাহ্যতঃ সাদৃশপূর্ণ যা মুসলমানদের সুফী সম্প্রদায় করে থাকেন। যেমন তাঁরা নীরবে সুরত
খেয়াল করে তা থেকে ফয়েজ লাভ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের সঙ্গে এই জিকিরে রাবেতার কোন মিল নেই। কারণ তাঁরা পীরের মুর্তি তৈরী করেন না। ভারতের হিন্দু ধর্মবলম্বীদের সঙ্গে আরবের মুশরিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। আরবীয়রা তাদের প্রতিমাগুলোকে স্বয়ং ক্ষমতাবান ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী মনে করতো। আল্লাহ্কে তারা কুদরত বা ক্ষমতার মালিক মনে করতো না। তারা প্রতিমাসমূহকে জমিনের খোদা আর আল্লাহ্তায়ালাকে আসমানের খোদা মনে
করতো− যা সুস্পষ্ট শিরিক।
হিন্দুরা যে সেজদা করে তা সম্মানের সেজদা, ইবাদতের সেজদা নয়। তাদের ধর্মে পিতা-মাতা, পীর ও উস্তাদকে সালামের স্থলে এ রকম সেজদা (প্রণাম) করতে হয়। তাদের ধর্মীয় পরিভাষায় একে ভনভুত বলা হয়। আর শুধু তানাসুখ (পুনর্জন্ম)৪২ বাদে বিশ্বাস রাখাতে কুফরী লাজেম হয় না। ওয়াস্ সালাম।
মাক্বামাতে মাযহারী
শাহ্ গোলাম আলী দেহলভী র.
অনুবাদ
মাওলানা মুমিনুল হক
সম্পাদনা
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ
প্রকাশক
হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




