somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্কিন বুজুর্গের বাংলাদেশ সফর...

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিরান বাগানে ফুলের বাহার

জন্ম ইন্ডিয়ানার নিউক্যাসলে। ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের ভূমি হিসেবে পরিচিত ইন্ডিয়ানার আলো-হাওয়াতেই কাটে কৌতূহলী শৈশব। দূরন্ত কৈশোর পেরুনোর প্রাক্কালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ধর্ম পালটে মুসলমান হন।

কেনটাকির পাহাড় মালিকের বংশধর গ্যারি লি এডওয়ার্ডস এর নতুন নাম হয় শেখ নাঈম আব্দুল ওয়ালী।

পতঙ্গবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করতে না করতেই আরো পালটে যায় জীবন ভাবনা। ইসলাম শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে মহাদেশীয় সীমানা পেরিয়ে উত্তর আটলান্টিক পাড়ি গিয়ে যান সৌদি আরবের হিযরতনগরী মদিনায়।

মদিনার আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়েস-সুবিধা আর জাঁকজমক ছেড়ে ফের পথে নামেন পথের খোঁজে। ইসলামের ইতিহাস আঁকা জর্দান, সিরিয়া হয়ে এশিয়া-ইউরোপের সেতুবন্ধক দেশ তুরস্কে গিয়ে টানা দশ বছর নেন প্রথাগত শিক্ষা আর আধ্যাত্মিকতার তালিম।

তারপর ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ নগর ইংল্যান্ড, উত্তর আমেরিকার জেলেভূমি কানাডা ও ওশেনিয়ার দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে এখন তার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য টেক্সাসের সুগার ল্যান্ডে এক স্কুলের রেসিডেন্ট শিক্ষক।

মাতৃভাষা ইংরেজি ছাড়াও প্রাচীন ভাষা আরবী, অটোমানসহ তুর্কি ও জার্মানটা রপ্ত করেছেন বেশ। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা, নরওয়ে, ত্রিনিদাদ, চিলি, ভারতসহ পাঁচ মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষা ও জাতির ৭০ জন মুরিদ হয়ে আধ্যাত্মিক গুরু মেনেছেন তাকে।

সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর হয়ে অগণিত আউলিয়ার ভূমি ভারতে হযরত মোজাদ্দেদে আলফেসানী রহ. এর জন্ম স্মৃতিবিজড়িত সেরহিন্দ ঘুরে বাংলাদেশেও এসেছিলেন এই মুসলিম মিশনারি। ৩ কি ৪ দিন কাটিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ে, হাকিমাবাদের খানকায়ে খাস মোজাদ্দেদীয়ায়।

এরপর সিঙ্গাপুর হয়ে টেক্সাসে ফিরে গেছেন নকশবন্দিয়া তরীকার এ বুজুর্গ।

বিশ্বায়ন আর ভূ-রাজনীতির মতো সমসাময়িক বিষয়াবলীও নখদর্পণে তার। জাতিগত অগ্রগতির তুলনামুলক বিশ্লেষণেও আছে নিজস্ব চিন্তা।

বাংলাদেশের সমস্যাগুলোও বেশ বুঝে গেছেন মাত্র দিন তিনেকের সফরে।

তাই বলেন, বড্ড ভিড়-ভাট্টা। সবাই ঢাকার দিকে আসছে। মানুষের ভিড়ে নাভিশ্বাস ওঠে। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া জীবনযাত্রার ঝক্কি থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল।

এরপর যেন পর্যবেক্ষকের ঝাঁপি খুলে বসেন শেখ ওয়ালী। ইংল্যান্ডের পত্রিকায় মহানবী সা. কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের উদাহরণ টেনে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যে খারাপ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু তেমন কাজ কেউ করলে তার প্রতিবাদে জ্বালাও পোড়াও হয় বাংলাদেশে। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। কিন্তু বাঙালি ও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন্ হয়।

এ দেশে পশ্চিমা অনুকরণ প্রবণতাও বেশ ধরা পড়েছে শেখ নাঈমের চোখে। পশ্চিমা বেশবাশের প্রভাবও নজর এড়ায়নি তার। বাংলাদেশের মানুষকে তাই তার অকপট পরামর্শ, চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর পথে উন্নতি করা যাবে না। এ দেশের সম্পদ সীমিত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আর পরিবেশ আলাদা। তাই সব কিছুতে উন্নতদের ফলো করার দরকার নেই।

বাংলাদেশিদের তিনি বলেন, তোমাদের দেশে সহজে ফসল ফলে। তোমরা অনেক বড় জনগোষ্ঠী। তোমরা নিজেদের কথা ভাবো। তোমরা তোমাদের মতো হও।

সৃষ্টিকর্তা তো আর নতুন গ্রহ দেবেন না বলে বাস্তবতার ওপরে স্বপ্নের ভিত রচনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, নিজেদের পরিবেশ, ঐতিহ্য নিয়ে সাসটেইনেবল কমিউনিটি গড়ে তোলো। মনে রেখো মানুষের পা একজোড়া। এক জোড়া জুতা থাকলেই হয়।

এমন নির্ভেজাল পরামর্শের পাশাপাশি প্রবাহমান বিশ্ব রাজনীতির দূরদর্শী ভাবনাও স্বচ্ছ হয়ে ফুটে ওঠে শিক্ষার আলো ছড়াতে বারবার ভৌগোলিক সীমারেখা-মহাদেশ-মহাসাগর পেরুনো মার্কিন মুলুকের এ বুজুর্গের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, পৃথিবী চলছে তেলে। কিন্তু এ সম্পদ সীমাবদ্ধ। শিগগিরই হয়তো শেষও হয়ে যাবে। তাই শক্তিশালী দেশগুলো অমূল্য এ সম্পদ আয়ত্তে রাখতে শক্তি প্রয়োগ করবে। এমন শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছেও।

এমন ভাবনা থেকে অত্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় দূরদর্শী এক প্রশ্ন ছোঁড়েন শেখ ওয়ালী। তাহলে বৈশ্বিক রাজনীতির ওমন প্রেক্ষাপটে কি করবে বাংলাদেশ বা ইথিওপিয়ার মতো অশিক্ষা ও দারিদ্র্য জর্জরিত রাষ্ট্রগুলো?

সঙ্গে মুক্তির পথটাও বাতলে দেওয়ার ঐকান্তিক অভিপ্রায়ে অনেকটা যেন বিবেকের ভূমিকা নিয়ে বলেন, পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে কিছু প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। প্রস্তুত করতে হবে নিজেদের। আর এ প্রস্তুতিটা যেন সামর্থ আর সক্ষমতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।

পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তার বক্তব্য, এ মুহূর্তে ওয়েস্টে মুসলিম বা ইসলাম সম্পর্কে কেউ শুনতেও চায় না। অথচ ২০ বছর আগেও এমনটা ছিল না।

তিনি বলেন, রিচার্ড ডকিন্স কিংবা স্টিফেন হকিংয়ের মতো নাস্তিক ও তাদের অনুসারীরা ভাবছেন- আমরা তো নিজেরাই বিশ্ব তৈরি করতে পারি। ভূ-গর্ভে বিগ ব্যাঙ বিস্ফোরণের মহড়া দিয়ে মানুষের ক্ষমতাকে অসীম করার প্রচেষ্টাও চালানো হচ্ছে। ঈশ্বরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে মানুষ। আর কার শ্মশ্রু বিধিবহির্ভূত অথবা কার চলন-বলন কেমন তা নিয়ে তর্ক করে সময় কাটাচ্ছে মুসলমানরা। বিশ্বজুড়ে মুসলমানে-মুসলমানে দ্বন্দ্ব। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না।

মুসলিমদের আরো যে সমস্যাটি তার চোখে ধরা পড়েছে তা হলো- মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম শিক্ষার বিষয়টিই নেই। তাই ইসলামের দর্শনটাও গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে পিছিয়ে থাকছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।

এজন্য আল্লাহর আদেশ ও পয়গম্বরের ঐশী প্রজ্ঞার প্রতিফলিত ছায়ায় নিরলস মানবীয় প্রচেষ্টাকেই মুক্তির পথ মনে করেন তিনি।

ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বা নিশ্চয়ই আল্লাহর দিকে এবং আল্লাহর নিকটই প্রত্যাবর্তনশীল আয়াতটি তার প্রিয় উদ্ধৃতি।

ওসামা বিন লাদেন ও সাম্প্রতিক আলোচিত সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ‘ব্যাড মুসলিম’ হিসেবে অভিহিত করেন ওয়ালী। তার মতে, এমন ব্যাড মুসলিম যতো কম হয় ততই মঙ্গল।

ইসলামকে ‘ঐশ্বরিক যোগাযোগের সর্বোচ্চ মাধ্যম’ আখ্যা দিয়ে তিনি এও বলেন, ইসলামে আধ্যাত্মিকতা আছে। সব পথই এসে মিশেছে ইসলামে। ইসলামই যুগ যুগ ধরে শ্রেষ্ঠ।

তার বিশ্বাস, কোরআন এক ঐশী গ্রন্থ। মানুষের জন্য পবিত্র আদর্শ। জান্নাতের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। আর আশার প্রতীক।

কোন বিশেষ কারণে বাংলাদেশে আসা জানতে চাইলে নকশবন্দিয়া তরীকার এই সাধক ‘নকশবন্দিয়া তরীকার মূলধারা অতীব দুর্লভ’ জানিয়ে বলেন, মুসলমান হওয়ার পর শরফুদ্দিন মানার নামে এক বাঙালির ‘হান্ড্রেডস লেটার’ বইটি পড়ে সুফিজমের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তার তিন দশক পর এরশাদ আলম নামে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আর এক বাঙালির কাছে জানলাম, বাংলাদেশে বিরল বিশুদ্ধ নকশবন্দিয়া তরীকার চিরন্তন প্রবাহ বাস্তবিকই জারি আছে। তাই তারই আমন্ত্রণে হাকিমাবাদে এসে তার মোর্শেদ মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের মেহমান হই।

বস্তুত হজরত মুহাম্মদ সা. ও তার সাহাবাদের একনিষ্ঠ অনুসারী আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের গুরুত্বপূর্ণ এক সিলসিলায় মধ্য এশিয়ার প্রাচীন শহর বোখারার বুজুর্গ ইমাম বাহাউদ্দিন নকশবন্দ রহ. প্রজ্জ্বলিত করেন নকশবন্দিয়া তরীকার আলোকবর্তিকা, যা পূর্বাপর সব সময়ে নেসবতে সিদ্দিকি নামে সম্যক পরিচিত। যা বর্তমানে খাছ মোজাদ্দেদীয়া তরীকা নামে আরও পরিণত রূপে সমাদৃত।

তরীকা মানে পথ। ইসলামের ঐতিহ্য প্রকাশক এই তরীকার ভিত্তিতেই পরবর্তীতে দীন সংস্কারের পর্বতপ্রমাণ দায়িত্ব সম্পন্ন করেন দ্বিতীয় হাজার বছরের সংস্কারক শায়েখ আহমদ ফারুকি সেরহিন্দী (রহ.)। শ্রেষ্ঠ, সহজ ও যুগোপযোগী এ তরীকার পরিণত রূপ নিয়ে বইছে খাস মোজাদ্দেদীয়া তরীকা।

নকশবন্দিয়া তরীকার প্রবর্তক ইমাম বাহাউদ্দিন নকশবন্দ রহ. এর জন্মক্ষণ স্মরণে মোহাম্মদ মামনুর রশীদ তার ‘সোনার শিকল’ সনেট গ্রন্থে লিখেছেন, ‘.... বিরান বাগানে দিলে ফুলের বাহার/ বেখবর মানুষের মিনারে আজান/ জীবনের জয্বায় বাগ বোখারায়/ ছুটালো জাহান জুড়ে প্রেমের তুফান ....’

এমনই স্বর্গীয় প্রেমের টানে হাকিমাবাদ খানকা শরীফে এসে শেখ ওয়ালীর জায়গা হলো নির্মীয়মাণ মাদ্রাসা ভবনের দোতলার এক ঘরে।

মক্তবে শিশুদের নিয়মিত বিদ্যাচর্চা, খানকায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অনবরত আসা-যাওয়া, সাদামাটা মেহমানদারি ও আয়োজন গভীর দাগ কাটলো মনে।

তার মনে হলো, ইসলাম তো এমন অনাড়ম্বর জীবনের কথাই বলে।

খানকার ছোট্ট পুকুরটিতে জিয়ল মাছের ঘাঁই, পুকুর পাড়ের পাঠাগার, রাতজাগা ঝিঁঁিঁঁঝঁর একটানা সুর আর শেষ অগ্রহায়ণের শিশিরের সঙ্গে বেশ মিতালি হলো তার।

সবচেয়ে বেশি দেখলেন মানুষ।

হাই-টেক সভ্যতার মার্কিন মুলুক থেকে এসে শেখ নাঈম কিন্তু এদেশীয় সাদা-মাটা পরিবেশে ফকির-দরবেশের খানকায় বেশ মানিয়ে নিলেন নিজেকে। খানকার সহজ সরল পরিবেশ ও জীবন তাকে আরো বেশি আকৃষ্ট করলো।

এখানে যারা আসছেন তাদের কেউ আমলা, কেউ সেনা জওয়ান, কেউবা প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আসছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও। কিন্তু কারো পোশাক দেখে কিচ্ছুটি বোঝার জো নেই। সবার পরনেই সাদা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, একই পোশাক। সবার আচরণে যেন বিনয়ী হওয়ার অলিখিত কোন প্রতিযোগিতা।

সবচেয়ে বড় কথা সবাই তৃপ্ত।

তার ভাষায় -দিন শেষে একদল মানুষের পরিতৃপ্ত মুখ দেখি। এর চেয়ে বড় শান্তি আর কি হতে পারে।

সন্ধ্যায় দিনের ক্লান্তি নয়, প্রশান্তি খেলা করে এমন একটা মুখই সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে ওঠে ওয়ালীর ভাবনায়।

১৮১৬ সালে ১৯তম রাজ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গীভূত হওয়া ইন্ডিয়ানার নিউ ক্যাসলে ১৯৬৪ সালের ২৫ জুন জন্ম শেখ নাইমের। পিতা জে বি এডওয়ার্ডস ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ানার দক্ষিণ সীমানা ঘিরে রাখা কেনটাকি রাজ্যের পর্বত এলাকায় জন্ম নেন। সেখানে বনেদি এডওয়ার্ড বংশের বসতি দীর্ঘ দিনের। এডওয়ার্ড পরিবারের নামে পাহাড়ও রয়েছে কেনটাকিতে। যার নাম এডওয়ার্ড মাউনটেইন।

ইন্ডিয়ানার দক্ষিণ-পূর্বে ওহিও’র ওপারের রাজ্য পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কয়লা শ্রমিক নানার নাতী এডওয়ার্ডস ১৯৮২ সালে গ্রাজুয়েট হন নিউ ক্যাসল ক্রিসলার হাই স্কুলে। ওই বছরই মুসলমান হন তিনি। পতঙ্গবিজ্ঞান পড়ার জন্য ১৯৮৭ সালে স্নাতকে ভর্তি হন ইন্ডিয়ানা আর নটরডেমের মতোই খ্যাতনামা পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু কোন কিছুতেই ঠিক থিতু হতে পারছিলো না অনুসন্ধিৎসু মন। কেবল মনে হচ্ছিলো সুফিজম মানে আলাদা কিছু। তাই চালিয়ে যেতে থাকেন আধ্যাত্মিকতার নিরন্তর অনুসন্ধান।

৮০ দশকের শেষ ভাগে মদিনা থেকে একটি দল আসে নও মুসলিমদের স্কলারশিপ দিতে। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খবর পেয়ে তার কাছে আসে ওই প্রতিনিধি দল।

ইসলামী শরিয়ত ও আরবি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালে সৌদি আরবের প্রাচীন শহর মদিনা যান শেখ ওয়ালী।

কিন্তু জমিয়াতুল ইসলাম ইন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা করতে গিয়ে তার মনে হয়, প্রচলিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আধ্যাত্মিকতা পরিপন্থি ইসলামী শিক্ষায় মগজ ধোলাইয়ের কারখানা। দু’বছরের ডিপ্লোমা কোর্সটাও ঠিকঠাক শেষ করা হয় না তার।

ওই সময়ে মাহমুদ উসতা ওসমানোগলু (মাহমুদ এফেন্দি) নামে এক বুজুর্গ এলেন মদিনায়। তার সাহচর্যে বিশেষ মানসিক পরিবর্তন ঘটে ওয়ালী’র। এফেন্দি চলে যাওয়ার পর তাই মন আর টিকলো না মদিনায়।

১৯৯৩ সালে তাই মদিনা ছেড়ে মুসাফির হয়ে পথে নামলেন শেখ নাঈম। দু’দিনের ক্লান্তিকর বাসযাত্রায় জর্দান-সিরিয়া হয়ে তাসাউফের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুল গেলেন। মুরিদ হলেন মাহমুদ এফেন্দির। গ্রিক, পারসিক, রোমান আর আরবদের আগমনধন্য হিউটাইট ভূমিতে টানা দশ বছর নিলেন ইসলামী শরিয়ত, আরবি ভাষা তত্ত্ব ও তাসাউফ শিক্ষা।

মাহমুদ এফেন্দিসহ বেশ ক’জন শায়েখ ও প্রথাগত আলেমের অধীনে শিক্ষা নিয়ে পান প্রথাগত এলেমের সনদ। কাঁধে বর্তায় শরীয়ত ও তরিকত শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব।

২০০২ সালে তুরস্ক ছাড়েন। চলে যান ইংল্যান্ড।

দেশে ফিরে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য অ্যারিজোনায়। ২০০৬ সালে ফের পাড়ি দেন দেশের সীমানা। ২০০৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় কাটিয়ে ফেরেন মাতৃভূমি যুক্তরাষ্ট্রে। এবার দক্ষিণে মেক্সিকো সীমান্ত ও মেক্সিকো উপসাগর উপকূলের রাজ্য টেক্সাসের সুগারল্যাণ্ডে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে মেক্সিকো থেকে স্বাধীন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হওয়া টেক্সাসে ফিরে এক কোম্পানিতে চাকরি নেন শেখ নাঈম। কিন্তু মন বসাতে পারেন না। স্থানীয়দের সহযোগিতায় সুন্নাহ ইনস্টিটিউট নামে এক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নেন রেসিডেন্ট শিক্ষকের চাকরি।

সেখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি নাহু, সরফ, বালাগাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন শেখ ওয়ালী।

মকতুবাদ শরীফের অনলাইন আলোচনা মাহফিল তার অন্যতম আয়োজন। এছাড়াও নওমুসলিমদের উৎসাহ ও অনুপ্রাণিত করে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিয়ে থাকেন শেখ নাঈম।

বর্তমানে আরবি ও তুর্কি (অটোমানসহ ) ভাষা থেকে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ইংরেজীতে অনুবাদ করছেন শেখ ওয়ালী।

তার এক ভাই এলেন (৪৯), এক বোন টেরেসা (৫১)। তিন ছেলে আহমেদ (১৭), ওমর (সাড়ে ১৩) ও জুবায়ের (১০)।

চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে ভারতের পথে ওড়েন ওয়ালী। ২৯ নভেম্বর সিঙ্গাপুর আসেন তিনি। সেখানে ১ ও ২ ডিসেম্বর সুলতান মসজিদ অডিটোরিয়ামে লেকচার দেন। ৩ ডিসেম্বর আসেন ভারত। ঘোরেন দিল্লি ও সেরহিন্দ শরীফ। সেখান থেকে ১০ ডিসেম্বর আসেন বাংলাদেশে।

মেহমান হন হাকিমাবাদ খানকায়।

গত ১৪ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন মার্কিন মুলুকের এই বুজুর্গ। ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর মকতুবাদ শরীফ আলোচনা ও ইবনে আতাল্লাহুর ইবনে হিকাম আলোচনা করে ১৭ ডিসেম্বর ইউএস ফেরত যান তিনি।

জন্মভূমে একটি কাজ এখনো বাকি আছে তার।

নানা কারণে ছেলেবেলায় এড়িয়ে চলতেন বাবাকে। কিন্তু মুসলমান হওয়ার পর তার মধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে থাকে। পিতার হক সম্পর্কে সচেতন হন।

বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। এড়িয়ে চলার নীতি পাল্টে নেন কাছে থাকার সিদ্ধান্ত। ছেলে হিসেবে বাবার প্রতি দায়িত্বপালনে মনোযোগী হন।

ভাই-বোনের পারিবারিক আর সামাজিক সমস্য নিয়ে মা-বাবা অসন্তুষ্ট, উদ্বিগ্ন। কিন্তু তাদের এডওয়ার্ডের জীবনযাপনে সন্তুষ্ট তারা। তার পরিবর্তিত আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে এরই মধ্যে সস্ত্রীক মুসলমান হয়েছেন তারই এক ভাগ্নে।

শেখ নাঈমের আশা, বাবা-মাকেও ইসলামে আনতে সক্ষম হবেন তিনি।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ মুসলিম হলেও ৬৫ লক্ষাধিক জনসংখ্যার ইন্ডিয়ানায় এখন মুসলমানের অনুপাত ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এ সংখ্যা আগামীতে আরো বাড়বে বলেই মনে করেন শেখ নাঈম। এক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও ইন্ডিয়ানার মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ ধর্মহীন মানুষের অনেকেই ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে ধরা পড়েছে তার পর্যবেক্ষণে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, [email protected]
(বাংলানিউজ২৪.কম)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:৫৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×