somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেরা

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ছবি গুগল সূত্রে)

''নিয়ে যাবি? আমাকে নিয়ে যাবি?''
হুম নিয়ে যাব।

বাবারা সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছি তেমন মনে পড়েনা। এমন কোন দৃশ্য চোখে ভাসাতে চাইলাম, আসলনা। এমন কোন স্মৃতি নেই বাবার হাত ধরে বেড়াতে গেছি। দু'চারটা ছবি ভেসে উঠল সেসব হল বাবার সাথে বাজারে যাবার দৃশ্য।

আমরা দুই ভাইবোনকে সাথে করে বাজারে নিয়ে গিয়েছিল সেটা মনে পড়ে। বাবার বাজার করার ধরণ ছিল পরিচিত কিছু ব্যাসায়ী যাদের সাথে বাবার একটা মনস্তাত্বিক মিল আছে তাদের কাছ থেকে কিনবে, সেটা মাছ, মাংস, আলু, দুধ, ডিম যাই হোকনা কেন। তাছাড়া ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি বাবা বাকীতে কেনে একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে। বিশেষ করে মুদি দোকানের জিনিসপাতি। দুধ, চাপাতা, চাল-ডাল, তেল এসব। গিয়ে লিষ্ট দিয়ে দেবে ওরা ওজন করে প্যাকেট করে থলেতে ভরে রাখবে। বাবার কিছু থলে থাকে সবুজ কালার এর। বাবা দর্জী দোকানে গিয়ে নিজের সাইজ মতো সেসব বানাবে। সবসময় দেখে আসছি সেসব থলেগুলো হবে সবুজ কালার কাপড়ের থলে। বাবা সকালে যখন অপিষে যাবে তখন সেই থলে প্যান্ট এর পকেটে ভাজ করে ঢুকিয়ে দেবে। অপিষ শেষ করে যখন বাজারে যাবে তখন বের হয়ে আসবে সবুজ থলে। একটা দিয়ে রাখবে মুদি দোকানে। কাগজে লেখা লিষ্ট অথবা মুখে বলে দেবে আইটেম, ওরা সেগুলো সবুঝ থলেতে ভরে রাখবে। বাবা বাজার সেরে একটা রিকশা নেবে তারপর থলেটা নিয়ে বাসায় ফিরবে। দোকানদার খাতায় লিখে রাখবে কতো আসল। বাবাকে শুধু মোট এমাউন্টটা শুনিয়ে দেবে। বাবা কখনো খাতা চেক করবেনা। মাস শেষে বেতন পেলে পরিশোধ করে দেবে। তারপর পরের মাসের নতুন হিসেব।

আমরা ভাইবোন বাবার সাথে বাজারে আসলে একটা মুশকিলে পড়ি। বাবা কোন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে। হয়তো দেখা গেল সন্ধ্যার দিকে কোন লইট্যা ইচা মাছ (ছোট লটিয়া ও চিংড়ি মিক্স) ওয়ালার পাশে দাঁড় করিয়ে দিল আর বলল দাঁড়া আমি বাজার করে নিই। আমরা দাঁড়িয়ে থাকি আর মানুষ দেখি। সন্ধ্যার ঝাপসা অন্ধকার তখন পুরো রাত হয়ে আসে। লইট্যা ইচা মাছ ওয়ালা একটা চেরাগ জ্বালিয়ে খাচির মাঝখানে মাছের উপর বসিয়ে দেয়। বাজারের মানুষের ভিড় তখন পুরোদমে। আমরা একটু ইতস্তত হই, বাবা আসছেনা কেন? অথবা আমাদের জন্য মাছ ওয়ালার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা ভেবে মনটা একটু গুটিয়ে আসে।

আমাদের ভয় তখন উচ্চাঙ্গে উঠে। বাবা আসবেতো? আমরা হারিয়ে যাবোনাতো? অনেক পরে বাবা আসে হাতে সবুজ থলে বাজার ভর্তি। শাক, মাছ, ইচা শুটকি আর সাথে খাবার আইটেমও থাকে, যেমন ঘইস্যামলা, কাউয়ার ঠেং বগার ঠেং এই টাইপ।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বায়না ধরেছিলাম একটা ব্যাডমিন্টন কিনে দেবার জন্য। অনেক অনুরোধে বাবা রাজি হল। বাজার করার সময় সাথে নিয়ে গেল। দোকানে গিয়ে একটা নেড়েচেড়ে ধরেও দেখেছিল। আচ্ছা রাখুন বলে আবার রেখে দিল। আমি শুধু তাকিয়ে আছি কিছু বলছিনা, আমার কোন চয়েজ নাই, বাবা যেটা দেবে সেটাই ব্যাষ্ট। দোকান থেকে বের হয়ে চলে আসলো বাজার সারার জন্য। করতে করতে রাত। তারপর বাজার করে আমরা চলে আসলাম। ব্যাট আর কেনা হলনা। আমিও আর কিছু বলিনি। বয়সে ছোট হলেও আমাদের মনস্তত্ব এসব বিষয় এর জন্য প্রস্তুত ছিল। সবকিছু পেতে হয়না। বাবার সামর্থ নেই। থাকলে অবশ্যই দিত। সেসব আমরা ছোট বেলা থেকেই বুঝে বড় হয়েছি।

বাবার যেটা বদভ্যাস ছিল সেটা হল খুব বদ মেজাজী। কিছু হলেই ধুম ধাড়াক্কা। আমাদের সাথে মিশতনা। আমরা সবসময় বাবাকে দেখেছি ভয় আর হুংকার এর চোখে। বিকেলে যখন খেলতাম। বাবা যখন নাম ধরে ডাক দিত শুনে ভয়ে বুক কাঁপতো। কোন কারনে কোন ভুল করিনাইতো? সেটা ভাবার চেষ্টা করতাম আগে। কারন বাসায় গেলে আগে চলবে ধুম ধাড়াক্কা। তারপর মারতে মারতে বলবে কেন মারছে। এমনও দিনে গেছে অপিষ থেকে বাসায় আসার পথে শুনেছে অমুকের ছেলেরা ঝগড়া করেছে, দাত-মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করবে সেখানে ছিলাম কিনা, আমি অংশগ্রহণ করেছি কিনা সেটা বিবেচ্য নয়, আমি সেখানে ছিলাম কিনা সেটাই বিবেচ্য। যদি বলি ছিলাম তবে আমি মারামারি করিনাই তবুও দুই ঘা বাদ যাবেনা। কেন ছিলাম সেখানে, শুরুতে কেন চলে আসলামনা।

ছোটকাল থেকেই বাবার সাথে একটা দুরূত্ব চলে আসে বাবার এই বদ মেজাজ এর কারনে আর বাবা ছোটদের আদর করতনা। দূর থেকে দেখতো কিন্তু কোলে নেয়া, আদর করা এসব ছিলনা। আরো অনেক পরে বড় হয়ে যখন একদিন শিপু আপার ( বাবার এক সিনিয়র বন্ধুর মেয়ে) বাসায় গেলাম, আপা আমাদের গল্প শোনাল বাবার। তোমার বাবা আমাদের খুব আদর করত। গল্প করত। আমাদের খুব প্রিয় ব্যাক্তিদের মাঝে তোমার বাবা ছিল একজন। শুনে অবাক হলাম আর সন্দেহ হতো বাড়িয়ে বলছেনাতো?

আরো অনেক ভেবে যেটা পেলাম সেটা হলো আমাদের বড় সংসার। আর্থিক অনটন ছিল নিত্য সংগী। তায় বাবার মন যেটা চাইতো সেটা কখনো হয়ে উঠেনি। এইযে আমাদের ছোটখাট বিষয়গুলো পুরণ করতে পারছেনা সেসব বাবাকে ভাবাতো খুব বেশী কিন্তু তার প্রকাশতো উল্টো। ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা।

বাবা কখনো নিজের গল্প বলেনি আমাদের। মাও চাপা স্বভাবের। মা মৃত্যুর আগে কিছু কিছু বলে গেছেন। বাবা যখন ঘর থেকে বের হয়ে যায় একটা লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে তখন প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। দাদা ছিলনা। জেঠার হাতে সংসারের ভার। জেঠাকে বলেছিল হালচাষ ভাল লাগেনা পড়তে চায়। জেঠা বলেছিল সামর্থতো নেই কী করে পড়াবো? বাবা বলেছিল সেটা আমি দেখবো শুধু অনুমতি চাই। সেইযে বাবা ঘর ছাড়া আর যাওয়া হয়নি গ্রামে। শহরে চলে আসল। নিজেনিজে লজিং থেকেছে সেই প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। পরে যখন চাকরী জীবনে ঢুকল বাবার ইচ্ছে হয়েছিল গ্রামে একটা স্কুল করবে। ছুটিতে গ্রামে গিয়ে স্কুল এর ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েওছিল। নিজের ঘরের চেয়ার টেবিল পর্যন্ত স্কুলের জন্য বরাদ্দ করে ফেলেছে। কিন্তু গ্রামের কিছু মাতব্বর থাকে। তাদের অসহযোগীতায় কাজটা হলনা। বাবা খুব ব্যাথা পেয়েছিল মনে। চলে আসল শহরে রাগ করে। বছর খানেক বাদে মাকেও নিয়ে আসল। আর যায়নি গ্রামে। একটা ক্ষোভ নিয়ে থেকে গেছে সারা জীবন।

আমরা গিয়েছি গ্রামে মাঝেসাজে কোন উপলক্ষ্য থাকলে। আমাদের ঘরটাতে মেঝ জেঠারা থাকতো, ওরা আমাদের বলত এটা তোদের ঘর, আমরা ব্যবহার করছি, তোর বাবা থাকতে বলেছে। মাটির ছোট্ট ঘর। নিজেদের ভেবে কেমন একটা তৃপ্তি পেতাম। শহরে থাকলেও সেটাতো ভাড়া বাসা। নিজেরতো আর না।

এসব অনেক আগের কথা। বাবা এখন ঘর বন্দী। রিটায়ার্ড করেছে। বয়েস বাড়ছে। বই পড়ছে, পেপার পড়ছে। মসজিদে নিয়মিত যেতে পারছেনা আজকাল। বেশী কিছু মনে রাখতে পারছেনা ইত্যাদি।

গ্রাম থেকে খবর আসল আমাদের জমিজমা নিয়ে একটু ঝামেলা যাচ্ছে। সেখানে যেতে হবে সেইসব চুকাতে। বাবা আমাদের কখনো এসব জমিজমা নিয়ে কথা বলেনি। বাবার সাথে কখনো গ্রামেও যাইনি। আমরা জানিনা আমাদের জমিজমা কী আছে না আছে। সেসব বস্তুগত বিষয় নিয়ে বাবা ভাবেনি কখনো। তবুও নিজেদের বলে কথা। ঝামেলা যখন হচ্ছে সেটা চুকিয়ে আসাটাই ভাল হবে। তাছাড়া দেখেও আসা যাবে আমাদের জমিগুলো। সেখানে হয়তো চাষ হয়, নিজেদের জমির ধান ক্ষেত দেখতে পেলে ভালই লাগবে।

বাবা শুনেছে আমি যাচ্ছি গ্রামে। বাবার আজ গ্রামে যেতে মন চাইল। কিন্তু একা যাবার সামর্থ নেই বাবার। হাঁটা চলায় একজনের সাহায্য লাগবে। আমাকে বলল, ''নিয়ে যাবি? আমাকে নিয়ে যাবি?'' হয়তো ভেবেছে আমার ঝামেলা হবে ভেবে, 'না' করে দেব। বললাম, হুম নিয়ে যাব।

আমি আর বাবা চললাম। গ্রামের পথে.....
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×