আমার বাবা, চাচা, মামারা কেউই সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন নি, সেই হিসেবে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন। এবং আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই। তবে রাজাকারের ঔরসজাতও না। এটা হয়তো আমার দুর্ভাগ্য, কোন পক্ষেই নেই আমি। অথচ আমি শুনেছি আমার বাবার কাছে, চাচাদের কাছে যুদ্ধের সময়কার কথা। একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে থাকার গল্পগুলো, কখনো বা নৌকাতেই রাত্রিযাপনের গল্প। কিভাবে সিন্দুকভরতি টাকা মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো, গর্ত (ব্যাঙ্কার) তৈরী করে বিমানের শব্দ শুনে একযোগে সবার ভিতরে প্রবেশ করার সময়ের কথা। নিশ্চয়ই সেই সময় গুলো আনন্দের ছিলো না। প্রতিনিয়ত ছিলো ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। দিনের পর দিন আত্মীয়ের বাড়িতে থাকা খাওয়া সহ সবকিছু। কত রাত যে শুধু ডাল ভাত খেয়ে পোহানো হয়েছে তা কেবল আল্লাহই বলতে পারবেন। রাত গভীর হলে পুরুষরা ঘরে এসে ঘুমাতো আর সারাদিন বনে জঙ্গলে থাকা লাগতো। সেইসব দিনগুলো মোটেই রোমাঞ্চকর ছিলোনা বরং চরম অনিশ্চয়তায় কাটতো এক একটা দিন। আমার বাবাকে সিলেট বর্তমান বিমানবন্দরের কাছে অনেকের সাথে চোখ বেঁধে সার বেঁধে রেখেছিলো পাকিস্থানী আর্মি। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বেঁচে ফিরেছিলেন সে যাত্রা।
প্রথাগত চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধা বলতে বুঝি, যারা সরাসরি যুদ্ধের মাঠে পাকিস্থানী হানাদারের বিপক্ষে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করেছিলেন। এবং যুদ্ধ শেষে একটা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছিলেন। অন্ততঃ বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমার কাছে কেবল তাদেরই মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা। (এখানেও কথা আছে! শুধু সার্টিফিকেট থাকলেই হবে না বরং, কার শাসনামলে, মানে কোন সরকারের সময় ঐ সার্টিফিকেট ইস্যু হয়েছে সেটাও বিবেচ্চ বিষয়।)
যেহেতু আমার বাবার কোন সরকারের আমলেরই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই, সেই কারনে আমি সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে মুক্ত! আমার বয়স ত্রিশ বছর একদিন মানেই সরকারি চাকরির বয়স শেষ। আমার জন্য কোন কোটাও নেই। আর কেবল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান (৫/৬ জন সন্তানও যদি কোন মুক্তিযোদ্ধার থাকে তাহলেও সবাই এই সুযোগগুলো পাবে) হবার কারনে মেধা কম থাকলেও সমস্যা নেই। তাদের জন্য রয়েছে ত্রিশ পারসেন্ট কোটা আর বত্রিশ বছর পর্যন্ত চাকুরিতে প্রবেশের সময়সীমা। এটা কি সাম্যতা হলো? মুক্তিযুদ্ধ কেনো হয়েছিলো? তা কি অসাম্যতা, অন্যায্যতা, অবিচার, শোষন আর মিথ্যার বিরুদ্ধে ছিলোনা? তবে এখন কেনো সেই একই অন্যায়? একজন যথেষ্ট মেধাবী হবার পরেও সে চান্স পাচ্ছে না। আর কেউ শুধুমাত্র কারো সন্তান হবার কারনেই পেয়ে যাচ্ছে অবারিত সুযোগ। আর তাও যদি বুঝতাম সেই সার্টিফিকেটগুলো সবকয়টি নির্ভেজাল আর সঠিক। তাও না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বছরের পর বছর চাকরী করে গেছে আর যুদ্ধ না করেও তাঁর সন্তানেরাও পাচ্ছে সকল সুবিধা। কয়টা প্রমান লাগবে? একশত প্রমান হাজির করতে পারবো শুধু পেপার কাটিং দিয়েই।
যাদের লাশ বনে-জঙ্গলে, হাটে-বাজারে, নদীর ধারে পড়ে ছিলো আর চিল-শকুনের খাবার হয়েছিলো, যাদের পরিবার কখনোই জানেনি প্রিয়জন তাদের কই হারিয়েছে। ত্রিশ কিংবা তিন লাখ অথবা সংখ্যার হিসেবে যতই হোক, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যাদের বাড়িতে খেয়েছিলেন, রাত কাটিয়েছিলেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন, তথ্য আদান প্রদান করতেন, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? কেবল একটি সার্টিফিকেট থাকলেই বুঝি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়! আহারে যদি আমার বাবা চাচারা জানতেন, এরকম সময়ও আসবে তবে আর যাই হোক একটা সার্টিফিকেট অন্তত হাতে নিয়েই বাড়িতে ফিরতেন। কারন এরকম প্রভাব প্রতিপত্তি সেই সময় তাদের ছিলো।
আমি মনে করি, একান্ত ভাবেই নিজের অভিমত হলো, সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের আর আর জাতির শ্রেষ্ট সন্তান। তাঁরা যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন জীবন নিয়ে ফিরবেননা এরকম মনোভাব নিয়েই যুদ্ধে গেছেন। সরকার থেকে কখনো কিছু পাবেন এই চিন্তায় কখনো তাঁরা যুদ্ধ করেন নি। তারপরও যেহেতু আমরা যুদ্ধে জয় পেয়েছি। সেজন্য যুদ্ধ ফেরত আহত, নিহত কিংবা সুস্থ যারাই ছিলেন তাদের কে উপযুক্ত সম্মান দেয়ার বিরোধী কোন স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারে না।কেবল তাদের জন্য সর্বচ্চো যা করা যেতে পারে, যা বরাদ্ধ দেয়া যেতে পারে তাই তাঁদের দেয়া হোক আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁদের সন্তানরা আর যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন নি তাঁদের সন্তানরা সমান। একই রক্তে মাংসে একই দেশের সমান নাগরিক। শুধুমাত্র বাবার মুক্তিযোদ্ধের কারনে তাঁদের সন্তানরা অতিরিক্ত সুবিধা আদায় গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। যদি করা হয় তবে সেটা হবে মারাত্মক পর্যায়ের Discrimination। আর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেই অন্যায় অবিচার যেনো আবার ফিরে না আসে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৩