নগরীতে পানি সংকট স্থায়ী রূপ নিতে চলেছে। বর্ষা মৌসুমেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির জন্য হাহাকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা নগরীতে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার কথা বললেও বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজধানীতে প্রতিদিন পানির ঘাটতি রয়েছে প্রায় ২০ কোটি লিটার। আর এই ঘাটতিকে কেন্দ্র করে পানি বিক্রির রমরমা বাণিজ্য চলছে। নগরবাসীকে জিম্মি করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ জন্য প্রতিদিনই নগরীর কোন না কোন স্থানে সংকট লেগেই আছে। পানির দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন হচ্ছে হরহামেশাই। ওয়াসা বলছে, আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে পানির সংকটের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত ঘাটতি, অকেজো টিউবওয়েল, পুরনো টিউবওয়েলের উত্পাদন ক্ষমতা হ্রাস, জেনারেটর ও বিদ্যুতের ডুয়েল ফেজ ব্যবহার না করা। ভুক্তভোগী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা নগরীর পানি সংকটের নেপথ্য কারণ হিসাবে ওয়াসার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন। তারা আরো বলেছেন, ওয়াসায় দক্ষ কর্মকর্তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ওয়াসার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, প্রতি বছর নানা প্রকল্পের কথা বলে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। একইভাবে পানি বিক্রির নামেও লাখ লাখ টাকা লুটপাট হচ্ছে। সরকারিভাবে এক গাড়ি পানির মূল্য ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা ৮০০ থেকে ১০০০ এমনকি ১২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ড. তাকসিম এ খান ইত্তেফাককে বলেন, পানির গাড়ির কিছু চালক এই দুর্নীতির সাথে জড়িত। যেসব এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয় সেখানে ওয়াসার নির্ধারিত মূল্যে চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে পানি বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
পানির সংকটের বিষয়ে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইত্তেফাককে বলেন, পানির মূল উত্স নষ্ট হওয়ায় পানি সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। তিনি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগসহ রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো রক্ষা করে চলমান পানি সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসার টপ মেনেজমেন্টে যারা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগে আসেন তারা টেকনিক্যাল ম্যান না হওয়ায় ও নগরীতে পানি সংকট ক্রমাগতভাবে ঘনীভূত হচ্ছে। তারা মাঠ পর্যায়ে কোন খোঁজ-খবর রাখেন না। সমস্যা উপলব্ধি না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ, দুর্নীতি ও মতলববাজদের কথায় তারা পরিচালিত হন। এই দুর্নীতিবাজেরা সময়-সুযোগ বুঝে মাঝে-মধ্যেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সংকট দেখিয়ে ঐসব অসাধু প্রকৌশলী প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্ব্বেও ঢাকা ওয়াসার অপারেশন এন্ড মেনটেনেন্স উইংয়ে দীর্ঘ ৩ বছর যাবত্ ডিএমডির পদ খালি রয়েছে। মাঝে চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে দেয়া হলেও তিনি দীর্ঘদিন যাবত্ আমেরিকায়। ওয়াসার এমডি সম্পর্কে ঐ কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসা সম্পর্কে তার টেকনিক্যাল ধারণা খুব কম। তার চাকরির মেয়াদ আগামী অক্টোবরে শেষ হবে। তিনি নগরবাসীর পানি সংকটের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন চাকরির মেয়াদ বাড়ানোকে। পেশাগত দক্ষতাকে প্রাধান্য না দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব নিয়োগ হওয়ায় ওয়াসা একটি মাথাভারী প্রশাসনে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, পানি সংকটের জন্য ঢালাওভাবে বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংকে ওয়াসা দায়ি করলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পাম্প হাউজগুলোতে ৪৯০টি জেনারেটর বসানো হয়েছে। প্রতি মাসে জেনারেটর চালনা বাবদ তেল খরচ দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। অথচ বিদ্যুত্ চলে গেলে সিংহভাগ জেনারেটরই বন্ধ রাখা হয়। প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার তেল চুরি হচ্ছে । টপ ম্যানেজমেন্ট সব কিছু জেনেও রহস্যজনক কারণে বিষয়টি বেমালুম এড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব অনিয়ম নিয়মের মধ্যে আনা হলে নগরীর পানি সংকট নিরসন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, নগরীতে পানি সংকটের জন্য ওয়াসার কিছু সিবিএ নেতাও দায়ী। তারা পানি বিক্রি ও জেনারেটরের তেল চুরিতে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের ইন্ধন যুগিয়ে থাকেন।
ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রহমতুল্লা ইত্তেফাককে বলেন, ওয়াসার কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে একথা সত্যি, তবে ওয়াসার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ঢালাও অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকার পানির সরবরাহ কমিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়। তবে এতে কোন এলাকায়ই পানি সরবরাহ বন্ধ থাকার কথা নয়। আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়াসা নগরীতে পানির চাহিদা পূরণে সফল হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা ইত্তেফাককে বলেন, পানি চুরি, তেল চুরি ইত্যাদি পুরনো ব্যাপার। ওয়াসার ৩০ শতাংশ পানি সিস্টেম লস হচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে ঘাটতিজনিত কারণে কোথাও পানি সরবরাহ একেবারে বন্ধ থাকার কথা নয়। এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন
সূত্র : ইত্তেফাক

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





