somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যাবর্ত বিভাস

১৩ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১

মস্তিস্কের কোষে কোষে, প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভোতা, অসহনীয় অনুভুতি ও কন্ঠনালী জুড়ে মেডিসিনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের মিশ্র তিক্ত কটু আস্বাদ। ভারাক্রান্ত আখিপল্লব টেনে তোলার আপ্রান চেষ্টা। বেডের চারিপার্শ্বে ডক্টর নার্সদের মৃদুস্বরে কথাবার্তা, বিভিন্ন মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির টুংটাং,ঘ্যাস ঘস দানবীয় শব্দ। অসহ্য অসস্থিকর পরিবেশ।

সবকিছু তুচ্ছ করে, হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে চললাম অশরীরি এই আমাকে। হাসপাতালটির অলিগলিতে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। ভিজিটর'স রুমের অগুনিত ভিজিটরদের মাঝে সবার মুখে মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে চললাম। হয়তো কোনো প্রিয় মুখের প্রত্যাশায়। এককোনে পেয়েও গেলাম কিছু প্রিয়মুখ, আমার আপনজনদের ছোট খাটো জটলাটিকে। কিন্তু হোঁচট খেলাম একখানে এসে। অদূরে ম্লানমুখে বসে আছে তিন্নি। ওর দুচোখ জুড়ে ক্লান্তি ও একটু যেন উদ্বিগ্নতার ছায়া। খুব অবাক হলাম! এ অবস্থাতেও একটু চমকালাম আমি। পাশে গিয়ে বসলাম ওর। মেয়েটার দৃষ্টি বা অবস্থানের কোনোরকম পরিবর্তন হলোনা।একমনে মেঝের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে মেয়েটা।

নিশ্চিৎ হলাম। হতাশও হলাম একটু। দেখতে পাচ্ছেনা আমাকে সে। দেখবে কি করে? আমি তো এখন কায়াহীন। আমার দেহখানা ফেলে এসেছি এ হাসপাতালের সি সি ইউ সেকশনের তিন নং বেডে। সেখানে আর্টিফিসিয়্যাল ভেন্টিলেশনের লাইফ সাপোর্টে পড়ে রয়েছে আমার নীরব নিথর দেহ।

আহা মেয়েটাকে কতদিন এতকাছ থেকে দেখিনি। কতদিন একটু ভালো করে চাইনি ওর মুখের দিকে। সেই ছোট্ট চন্চল প্রজাপতির মত ছটফটে মেয়েটাকে প্রথম দেখার দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো । দুচোখের পাতা ভিজে উঠলো আমার। যাহ! কি সব ভাবছি! নিজেই হাসলাম মনে মনে চোখই নেই এখন আমার। যা কিছু দর্শন সবই এখন আত্মায়। তিন্নি মলিন মুখে গালে হাত দিয়ে বসে বসে কি যে ভাবছে! ও কি ওর বাবার কথা ভাবছে? আমার কথা ভাবছে? আমার জন্য কি ছিঁটেফোটা ভালোবাসা আজও ওর মনের কোনো এক কোনাতেও বিদ্যমান আছে ?

সে যাইহোক, প্রথম পিতৃত্বের স্বাদ তো এই পুচকে মেয়েটা হতেই পাওয়া আমার। অনেক অনেক আদর আর ভালোবাসায় মুড়ে দেবার বাসনা নিয়েই তো তাকিয়েছিলাম ওর ছোট কচি মুখপানে একদিন।সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটা। সদা চন্চল ছোট্ট প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ানো ও মুখে কথার খই ফোটানো মেয়েটা , হঠাৎ এমন বদলে গেলো। নিজের ভালো বুঝলোনা । আমি যে মনেপ্রাণে ওর ভালো চাই সেটাও সে মানলোনা। অকারণ অভিমানে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো নিজেকে । অনেক দূরে !

হঠাৎ ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো তিন্নি। আহা ওর আশে পাশে কেউ নেই কেনো? কেউ ওকে থামাচ্ছেনা কেনো? চারিদিকে তাকালাম। চিৎকার করে ডাকলাম । কে কোথায় আছো? কেউ আমার ডাকে সাড়া দিলোনা । কারন আমার কোনো অস্তিত্ত দেখতে পাচ্ছেনা এখন আর কেউই।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। আহা কাঁদিস না মা। কি এত দুঃখ তোর? একবার যদি এ জীবনটায় আবার ফিরে যেতে পারতাম। জেনে নিতাম তোর দুঃখটাকে মামনি। খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার ওপর সব অভিমান কি শেষ হয়েছে ওর? বিধাতার কাছে নিজের জীবন ভিক্ষে চাই আমি। শুধু একটাবার। একটাবার আমাকে এদের কাছে ফিরিয়ে দাও প্রভু।


০২
শেষ পর্যন্ত আমার আপ্রাণ ইচ্ছেটুকুই বুঝি ২২ঘন্টা পর আমাকে ফিরিয়ে আনলো এই মায়াময় ধরিত্রীতে। চোখ মেলে চাইলাম আমি।আমার চারিদিক ঘিরে প্রিয় সব মুখ, ব্যাথাতুর কিন্তু ফিরে পাবার আনন্দে হাস্যজ্জল সে সব মুখগুলো যেনো। সবার মাঝে খুঁজে পেলাম তিন্নীকেও। ব্যাথাতুর ম্লানদৃষ্টি ভরা মুখটুকু। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে, যেন আমার প্রত্যাবর্তনের আনন্দের ছটা।

অক্সিজেন মাস্কের ভেতর দিয়ে কথা বলা দুঃসাধ্য, তাছাড়া দুর্বল শরীর কোনোমতেই সায় দিচ্ছিলোনা। কিন্তু অনেক কথা জমে আছে যে আমার। অনেক কথা বলার আছে। আমি জানি আমার সময় কত কম। বিধাতার কাছে ক্ষনিককাল চেয়ে এসেছি আমি।

সবার কুশল বিনিময় পর্ব শেষে, যখন তিন্নির পালা এলো, নিশব্দে এগিয়ে এলো সে আমার বেডের পাশে। চুপিচুপি জিগাসা করলাম " তিন্নি , মা ভালো আছিস? আমার উপর কি এখনও রাগ করে আছিস?"
তিন্নি উত্তর দিলোনা। অঝরে কাঁদতে লাগলো।

ওকে আমার বলা হলোনা যে আমার সময় কত কম। আমি বিধাতার কাছে শুধুই একটাবার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম। ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ক্ষমা করেছিলো কিনা সে আমাকে। বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিলো আমার। প্রচন্ড বুকে ব্যথায় আবার অচেতন হলাম আমি।

আবার ডক্টর নার্সদের দৌড়াদৌড়ি, ব্যস্ততা, যন্ত্রপাতির ধাতব গর্জন, মগজের প্রতিটি শিরা উপশিরা ছিড়ে নিয়ে যেতে লাগলো। হৃদপিন্ড খুড়ে ফুড়ে ঢোকানো হলো অজানা অচেনা সব মেশিন পত্তর। আমি নিশ্চল যন্ত্রমানব হয়ে আবারও নীথর হলাম হাসপাতালের বিছানায়।

০৩
আমি তিন্নী। দুহাত দুরত্বে হাসপাতাল বেডে শুয়ে থাকা মানুষটি জামিরুল হক। আমি যাকে একদিন বাবা বলে ডেকেছিলাম । সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার শেষে ঘরে ফেরা যে মানুষটির একটিমাত্র ডাকের অপেক্ষায় সারাটা বিকেল ঘর বারান্দা করতাম আমি। ছোট্ট সেই আমি। কত স্মৃতি, কত কথা গুমরে মরছে আমার এই পাষান হৃদয়টি জুড়ে এ কটাদিন। সেই জাদরেল মানুষরটির এমন অসহায় অবস্থা কিছু তেই মেনে নিতে পারছিনা আমি।

মনে পড়ে যায় সেই ছোট্ট আমার কথা। তার কলমটার উপর দারুণ লোভ ছিলো আমার। সোনার নিব লাগানো সে কলম দিয়ে আঁকিবুকু আঁকার গোপন ইচ্ছেটুকু কখনও সম্বরণ করতে পারতাম না আমি আমার সে ছোট্ট ছেলেবেলায়।

শত চোখরাঙানি, শাষন বারন শেষে কোনো কূল কিনারা না পেয়ে শেষে উনি কিনে দিলেন তার কলমটার মত দেখেতেই কিছুটা তবে কমদামী নিব লাগানো লাল টুকটুক পেন।
মনে পড়ছে স্কুলে যাবার সেই প্রথম দিনটির কথা। অদ্ভুত সুন্দর নরম তুলতুলে সেই চামড়ার ব্যাগটা। যার স্পর্শে আমি সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে পরীর দেশে ভেসে যেতাম। অবাক হয়ে ভাবতাম এত সুন্দর এমন একটা স্কুলব্যাগ উনি কোথা থেকে খুঁজে আনলেন আমার জন্য? আমার ক্লাসে আর কারো ব্যাগই তো এমন সুন্দর না। কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়, ভালোলাগায় আমার ছোট্ট বুকটা ভরে উঠতো।
হায়রে আমার নানা রঙের দিন গুলি!

স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষা, অংক ভুল করে আর তারপর তার বকা খেতে খেতেই তো অংককে যমের মত ভয় পেতে শুরু করলাম।
মনে পড়ে আমার প্রিয় খাবারগুলো হাতে কলেজ হোস্টেল গেইটে তার দাড়িয়ে থাকবার কথা। । এই যে জীবনের ছোট ছোট আনন্দ-বেদনাগুলো আমি তো ভুলতেই বসেছিলাম। কি এক অভিমানের মেঘ গ্রাস করলো আমাকে। সব ভালোলাগা ভালোবাসা ভাসিয়ে নিয়ে গেলো । অনেক দূরে সাগেররে লোনা জলে । কতদিন বাবা বলে ডাকিনি। কতদিন একটু পাশে বসিনি।

বাবা আজ বলছি, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? বা ঐ যন্ত্রচালিত হৃদয়টা দিয়ে অনুভব করতে পারছো? আমি ঠিক ঠিক কি বলতে চাইছি তোমাকে? বাবা, ক্ষমা করে দিও আমাকে তুমি। জানোই তো আমার ভেতরে বাস করে এক অকারন ক্রোধ আর জেদের করাল দানব। যা আমাকে অনেক অনেক বারই ডুবিয়েছে, পুড়িয়েছেও। কিন্তু কি আর করা বলো? আমি এমনি তো। অবোধ অবুঝ। ভালোবাসা সহ্য হয়না আমার।

০৪

বাবা ক্ষমা করেছিলো কিনা তা আর জানা হলোনা।
আর আমি, মেন্টাল ডিপ্রেসনে ভুগছি আজ বেশ কয়েকটা দিন যাবৎ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:৫১
১৬০টি মন্তব্য ১৬০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×