দুপুর রোদে তেতে ওঠা কংক্রিটের রাস্তাটা পেরিয়ে চুপিচুপি পায়েপায়ে সামনে এগিয়ে যায় নোভা। তারপর উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিক। নিজেকে হঠাৎ মনে হচ্ছে দুপুরবেলা ঘর পালানো গোল্ডিলকস। ঠিকঠাক বুঝতে পারলোনা ঠিক কোথায় এখন সে। সামনে খোলা সবুজ প্রান্তর। বুক ভরে লম্বা এক শ্বাস টেনে নেয় নোভা। আহ! ভালোলাগা এক সবুজ শ্যামল হাওয়া বয়ে যায় ওর ছোট্ট বুকটা জুড়ে। । প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে।
নোভার মনটা হঠাৎই আবার খারাপ হতে শুরু করে। হয়তোবা এই ঘনহরিৎ প্রান্তরই হঠাৎ কোনো অজানা বেদনায় তার মনটা খারাপ করিয়ে দেয়। ছোট্ট নোভা তার পুরো হৃদপিন্ডটা দিয়ে অনুভব করলেও বুঝতে পারেনা ঠিকটাক যে কিসের অপ্রাপ্তিতে এই অব্যাক্ত হাহাকার তার ভেতরটা ঘিরে। স্কুল আর বাসা, বাসা আর স্কুল আর তার বাইরে গানের টিচার, নাচের টিচার, আর্ট স্কুল ছুটির দিনেও এত টুকু হাফ ফেলবার নেই অবসর। আর সপ্তাহ জুড়ে রয়েছে ইংরেজী, বাংলা আর ম্যাথ টিচার। বারো বছরের এত টুকু জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা নোভাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে যেন ঐ সবুজ খোলা প্রান্তর। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে দিতেই একরাশ হিম হিম ভালোলাগা ঘিরে ধরে তাকে। আবেশে চোখ মুঁদে আসে।
চোখ মেলতেই ভুঁইফোঁড় এক অট্টালিকা। কোথা হতে উদয় হলো এই সুদৃশ্য অট্টালিকা! ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতেই ধীরে ধীরে সে পা বাড়ায় ভেতর। বিশাল সিংহদূয়ার পেরিয়ে, সুসজ্জিত কক্ষের পর কক্ষ পার হয়ে যায়। হীরা মনি মানিক্যে সজ্জিত রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায় যেন। জানালার বাইরে স্থির হয়ে আছে ঝলমলে রাজ-উদ্যান। সরোবরে হংসমিথুনের জলকেলী। সব যেন এক একটি জলরঙে আঁকা বা স্টিল ক্যামেরায় তোলা স্থির চিত্র। কোথাও কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। এই মৃতনগরীতে একা একা একটু একটু হিমেল ভয় গ্রাস করতে থাকে এবার তাকে।
এ যেন সেই স্লিপিং বিউটি ফেইরী টেলসের বই এর পাতা থেকে উঠে আসা ছবির পাতা। ঘোড়াশালে ঘোড়া , হাতীশালে হাতি, পাইক, পেয়াদা বরকন্দাজ, দাস দাসী সবাই যে যার কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই। সারাদিনের কাজ আর এগোয়নি। সময় গড়িয়েছে কিন্তু কাজ এগোয়নি এক ফোঁটা। নোভা এ ঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়। স্থির দাড়িয়ে, বসে বা শুয়ে থাকা রুপকথার মানুষ গুলোর গা ছুঁয়ে ছুয়ে দেখে। কারো সম্বিত ফেরাতে পারেনা।
নোভার একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায়। কিছুই করার নেই তার। রাজ প্রাসাদের টেবিল ভরা খাবার । কত রকম বিরিয়ানী পোলাও, কালিয়া কোপ্তা, নানা রকম মেঠাই, ফলফুলুরী। সেসব খাদ্য সামগ্রী থেকে সুঘ্রান ভেসে আসছে । কিন্তু স্পর্শ করেই নোভা বুঝতে পারে সেসব খাদ্য খাবার অযোগ্য। মৃত নগরীর জীবনমৃত মানুষগুলোর মত সেসব খাদ্য হতেও প্রান কেড়ে নিয়েছে কেউ।
অবশেষে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে সে রাজকন্যার কক্ষে। অবাক হয়ে চেয়ে দেখে ঠিক ঠিক রুপকথার সেই সোনারকাঁঠি রুপোর কাঁঠি গল্পের মত সোনার পালংকে মাথা আর রুপোর পালংকে পা রেখে ঘুমিয়ে আছে ঘুমপূরীর রাজকন্যা। শিয়রে তার সোনার কাঁঠি, পায়ের কাছে রূপোর কাঠি। বুয়ার মুখে শোনা রুপকথার গল্পটির মতই নোভা রাজকুমারীর কাঁঠি দুটি অদল বদল করতেই, নোভাকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে চোখ মেলে জেগে উঠে বসে রাজকন্যা কঙ্কাবতী। মুহূর্তের মাঝে সচল হয়ে ওঠে পুরো মৃত নগরী। বাইরে থেকে ভেসে আসে মানুষের হৈ হট্টগোল। চারিপাশে লোকজন, পশুপাখি, পথচারী যেন প্রাণ ফিরে পায়। বাস ট্রাক মোটর সাইকেল রিক্সার প্যা পো শব্দে মুখর করে তোলে জনপথ। রাজপথে যানবাহনগুলো সব অজগরের মত হেলেদুলে চলতে শুরু করে।
চোখ মেলে উঠে বসে নোভা। বিলাস বহূল গাড়ির ক্লক স্ক্রিনে চোখ চলে যায় তার। স্কুল ছুটি হয়েছে সেই দুপুর ১টায় আর এখন বাজে বিকাল ৪:৩০। গুলশান ২ এর নোভাদের স্কুল হতে বনানীর মোড়টুকু পর্যন্ত প্রচন্ড জ্যামের কারণে পেরুতে পারেনি এতক্ষনে নোভাদের গাড়িটা। প্রায় প্রতিদিনই এমন হচ্ছে। এখনও অনেকখানি পথ বাকী। ক্লান্ত দৃষ্টিতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় নোভা। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর। শম্বুকগতির রাজপথ তাতে ভ্রুক্ষেপও করেনা।
অকারণ অভিমানে নোভার চোখ জলে ভোরে ওঠে। বুয়া কোলে টেনে নেয় ওকে। মায়ের মমতায় চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
নোভার কি খুব ইচ্ছে করে চুপি চুপি এই শহর ছেড়ে চলে যেতে, দূর বহুদূরে, কোনো অজানায়? ধুলোবালি ক্লান্তির এই নগর কোলাহলের সব ব্যাস্ততা, প্রতিযোগীতা থেকে পালিয়ে যেতে কোনো সবুজ ঘাসের দেশে?। যেখানে কাকচক্ষু জলে সাঁতরে বেড়ায় উদ্দাম শৈশব, যেখানে জীবন অবাধ বাঁধাহীন, এ নগরীর মত বিদিকিচ্ছিরি জ্যাম যেখানে কারো গতিরোধ করায় না। মৃতনগরীর খাদ্যদ্রব্যের মত যেখানে নিস্প্রাণ, বিষযুক্ত খাবার কেউ ধরে বেঁধে খাইয়ে দেয় না। যেখানে ঘুমপূরীর রাজকন্যার মত কোনো নোভাকে একা একা সারাদিন বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে হয়না।
কিন্তু এসব কিছুই বলতে পারেনা নোভা। শুধু হতাশা, নিরাশা আর ক্লান্তিকর একঘেয়ে শৈশব নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবার আশায় সংগ্রামী যোদ্ধার মত কঠোর ক্লান্ত ও মলিন মুখে অপেক্ষা করতে থাকে।
(বেশ কিছুদিন যাবৎ আমাদের পাশের বাসার ছোট্ট মেয়ে নোভাকে শুকনো মুখে, পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরতে দেখে মনে হলো আমার ফেলে আসা সেই রঙ্গীন শৈশবের সাথে বর্তমান শৈশবের কিছু বৈষম্য।)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৫:১৪