somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুমপুরীর এক রাজকন্যার গল্প

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব অবাক হয়ে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে নোভা! চারিদিক শুনশান নীরবতা, কোনো কোলাহল নেই। সব কিছু স্থির, অনড়, অটল। মনে হচ্ছে এ নগরীর দালান-কোঠা, ঘর-বাড়ি, ইট-কাঠ-পাথর, বাস, ট্রাক, রিকশা সব কিছুরই যেন শেকড় গজিয়েছে। স্থবির, নিশ্চল চারিদিক। যে যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে । এক ধরণের ঝিম ধরা ভাব পুরো শহরটা জুড়ে। এমনকি সামনের বাড়ির ছাঁদে রোদে শুকুতে দেওয়া লাল নীল ছোট বাচ্চাদের জামা, হলুদ সালো্যার কামিজ, বেগুনী শাড়ি সেসবও যেন পিন দিয়ে আটকানো রঙ্গীন প্রজাপতির মত নিথর হয়ে শুন্যে বিঁধে আছে। একটু ও নড়ছেনা, দুলছেনা। মনে হচ্ছে পুরো শহরটাই এক স্থির জলচিত্র।

দুপুর রোদে তেতে ওঠা কংক্রিটের রাস্তাটা পেরিয়ে চুপিচুপি পায়েপায়ে সামনে এগিয়ে যায় নোভা। তারপর উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিক। নিজেকে হঠাৎ মনে হচ্ছে দুপুরবেলা ঘর পালানো গোল্ডিলকস। ঠিকঠাক বুঝতে পারলোনা ঠিক কোথায় এখন সে। সামনে খোলা সবুজ প্রান্তর। বুক ভরে লম্বা এক শ্বাস টেনে নেয় নোভা। আহ! ভালোলাগা এক সবুজ শ্যামল হাওয়া বয়ে যায় ওর ছোট্ট বুকটা জুড়ে। । প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে।

নোভার মনটা হঠাৎই আবার খারাপ হতে শুরু করে। হয়তোবা এই ঘনহরিৎ প্রান্তরই হঠাৎ কোনো অজানা বেদনায় তার মনটা খারাপ করিয়ে দেয়। ছোট্ট নোভা তার পুরো হৃদপিন্ডটা দিয়ে অনুভব করলেও বুঝতে পারেনা ঠিকটাক যে কিসের অপ্রাপ্তিতে এই অব্যাক্ত হাহাকার তার ভেতরটা ঘিরে। স্কুল আর বাসা, বাসা আর স্কুল আর তার বাইরে গানের টিচার, নাচের টিচার, আর্ট স্কুল ছুটির দিনেও এত টুকু হাফ ফেলবার নেই অবসর। আর সপ্তাহ জুড়ে রয়েছে ইংরেজী, বাংলা আর ম্যাথ টিচার। বারো বছরের এত টুকু জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা নোভাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকে যেন ঐ সবুজ খোলা প্রান্তর। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে দিতেই একরাশ হিম হিম ভালোলাগা ঘিরে ধরে তাকে। আবেশে চোখ মুঁদে আসে।

চোখ মেলতেই ভুঁইফোঁড় এক অট্টালিকা। কোথা হতে উদয় হলো এই সুদৃশ্য অট্টালিকা! ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতেই ধীরে ধীরে সে পা বাড়ায় ভেতর। বিশাল সিংহদূয়ার পেরিয়ে, সুসজ্জিত কক্ষের পর কক্ষ পার হয়ে যায়। হীরা মনি মানিক্যে সজ্জিত রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায় যেন। জানালার বাইরে স্থির হয়ে আছে ঝলমলে রাজ-উদ্যান। সরোবরে হংসমিথুনের জলকেলী। সব যেন এক একটি জলরঙে আঁকা বা স্টিল ক্যামেরায় তোলা স্থির চিত্র। কোথাও কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। এই মৃতনগরীতে একা একা একটু একটু হিমেল ভয় গ্রাস করতে থাকে এবার তাকে।

এ যেন সেই স্লিপিং বিউটি ফেইরী টেলসের বই এর পাতা থেকে উঠে আসা ছবির পাতা। ঘোড়াশালে ঘোড়া , হাতীশালে হাতি, পাইক, পেয়াদা বরকন্দাজ, দাস দাসী সবাই যে যার কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই। সারাদিনের কাজ আর এগোয়নি। সময় গড়িয়েছে কিন্তু কাজ এগোয়নি এক ফোঁটা। নোভা এ ঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়। স্থির দাড়িয়ে, বসে বা শুয়ে থাকা রুপকথার মানুষ গুলোর গা ছুঁয়ে ছুয়ে দেখে। কারো সম্বিত ফেরাতে পারেনা।

নোভার একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছে। কিন্তু সে নিরুপায়। কিছুই করার নেই তার। রাজ প্রাসাদের টেবিল ভরা খাবার । কত রকম বিরিয়ানী পোলাও, কালিয়া কোপ্তা, নানা রকম মেঠাই, ফলফুলুরী। সেসব খাদ্য সামগ্রী থেকে সুঘ্রান ভেসে আসছে । কিন্তু স্পর্শ করেই নোভা বুঝতে পারে সেসব খাদ্য খাবার অযোগ্য। মৃত নগরীর জীবনমৃত মানুষগুলোর মত সেসব খাদ্য হতেও প্রান কেড়ে নিয়েছে কেউ।

অবশেষে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে সে রাজকন্যার কক্ষে। অবাক হয়ে চেয়ে দেখে ঠিক ঠিক রুপকথার সেই সোনারকাঁঠি রুপোর কাঁঠি গল্পের মত সোনার পালংকে মাথা আর রুপোর পালংকে পা রেখে ঘুমিয়ে আছে ঘুমপূরীর রাজকন্যা। শিয়রে তার সোনার কাঁঠি, পায়ের কাছে রূপোর কাঠি। বুয়ার মুখে শোনা রুপকথার গল্পটির মতই নোভা রাজকুমারীর কাঁঠি দুটি অদল বদল করতেই, নোভাকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে চোখ মেলে জেগে উঠে বসে রাজকন্যা কঙ্কাবতী। মুহূর্তের মাঝে সচল হয়ে ওঠে পুরো মৃত নগরী। বাইরে থেকে ভেসে আসে মানুষের হৈ হট্টগোল। চারিপাশে লোকজন, পশুপাখি, পথচারী যেন প্রাণ ফিরে পায়। বাস ট্রাক মোটর সাইকেল রিক্সার প্যা পো শব্দে মুখর করে তোলে জনপথ। রাজপথে যানবাহনগুলো সব অজগরের মত হেলেদুলে চলতে শুরু করে।

চোখ মেলে উঠে বসে নোভা। বিলাস বহূল গাড়ির ক্লক স্ক্রিনে চোখ চলে যায় তার। স্কুল ছুটি হয়েছে সেই দুপুর ১টায় আর এখন বাজে বিকাল ৪:৩০। গুলশান ২ এর নোভাদের স্কুল হতে বনানীর মোড়টুকু পর্যন্ত প্রচন্ড জ্যামের কারণে পেরুতে পারেনি এতক্ষনে নোভাদের গাড়িটা। প্রায় প্রতিদিনই এমন হচ্ছে। এখনও অনেকখানি পথ বাকী। ক্লান্ত দৃষ্টিতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় নোভা। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর। শম্বুকগতির রাজপথ তাতে ভ্রুক্ষেপও করেনা।


অকারণ অভিমানে নোভার চোখ জলে ভোরে ওঠে। বুয়া কোলে টেনে নেয় ওকে। মায়ের মমতায় চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

নোভার কি খুব ইচ্ছে করে চুপি চুপি এই শহর ছেড়ে চলে যেতে, দূর বহুদূরে, কোনো অজানায়? ধুলোবালি ক্লান্তির এই নগর কোলাহলের সব ব্যাস্ততা, প্রতিযোগীতা থেকে পালিয়ে যেতে কোনো সবুজ ঘাসের দেশে?। যেখানে কাকচক্ষু জলে সাঁতরে বেড়ায় উদ্দাম শৈশব, যেখানে জীবন অবাধ বাঁধাহীন, এ নগরীর মত বিদিকিচ্ছিরি জ্যাম যেখানে কারো গতিরোধ করায় না। মৃতনগরীর খাদ্যদ্রব্যের মত যেখানে নিস্প্রাণ, বিষযুক্ত খাবার কেউ ধরে বেঁধে খাইয়ে দেয় না। যেখানে ঘুমপূরীর রাজকন্যার মত কোনো নোভাকে একা একা সারাদিন বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে হয়না।


কিন্তু এসব কিছুই বলতে পারেনা নোভা। শুধু হতাশা, নিরাশা আর ক্লান্তিকর একঘেয়ে শৈশব নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবার আশায় সংগ্রামী যোদ্ধার মত কঠোর ক্লান্ত ও মলিন মুখে অপেক্ষা করতে থাকে।


(বেশ কিছুদিন যাবৎ আমাদের পাশের বাসার ছোট্ট মেয়ে নোভাকে শুকনো মুখে, পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরতে দেখে মনে হলো আমার ফেলে আসা সেই রঙ্গীন শৈশবের সাথে বর্তমান শৈশবের কিছু বৈষম্য।:()




সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৫:১৪
১০৯টি মন্তব্য ১১২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×