ঢং ঢং ঢনং ঢনং! বেজে চলেছে ছুটির ঘন্টা। হই হই রই রই করে পুরো স্কুল বাড়ি কাঁপিয়ে, টিচার্স রুম, লাইব্রেরী রুম, খেলার মাঠ লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে গেটের পানে ছুটে চলেছে ছেলের দল। গেটের বাইরে জটলা করে কেউ কেউ এরই মধ্যে চালতা বা কুলের আঁচার, হাওয়াই মিঠাই, বুট চানাচুরমাখা, বাদামভাজা পরম সুখে মুখে চালান করে দিয়ে কুড়ুর মুড়ুর চাবাতেও আরম্ভ করেছে।
শুধু শিপলু ওরফে হাবলু ভীষন মন খারাপ করে, চুপচাপ গালে হাত দিয়ে, ক্লাস সিক্সের ডি সেকশনের ক্লাসরুমটার লাস্ট বেন্চে, কোনার দিকের দেওয়াল ঘেষে বসে আছে। তার মুখে হাসি নেই, মনে নেই কোনো আনন্দ। অন্যান্যদিন ছুটির ঘন্টা ঢং করে বেজে উঠবার আগেই গেটের বাইরে এক লাফে পৌছে যায় যে, সে আর কেউই নয় তার নাম শিপলু ওরফে হাবলু। সারা দিনের পড়া না পারার বেদনা আর সে কারণে সকল টিচার ও ক্লাসমেটদের নানা রকম লাণ্ছনা গণ্জনা, ব্যাঙ্গ উপহাসের সব দুঃখ ভুলে সে তখন উড়ে যায় মুক্ত বিহঙ্গের মত স্কুলের চৌহদ্দীর সাদা রঙ দেওয়ালটার বাইরে। এই দেওয়ালটা পেরুলেই বুঝি তার মুক্তি। সারাদিনের আটকে রাখা শ্বাসটুকু বুক ভরে টেনে নিতে পারে সে কেবলি তখন কিছুক্ষনের জন্য।
কিন্তু আজ ছুটির ঘন্টা বেঁজে বেঁজে থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষন হলো। তবুও শিপলু ওরফে হাবলু এক পা বাড়ায়নি ক্লাসের বাইরে। মুখখানা হাড়ি করে বসে আছে সে। তার চোখের পানিতে শার্টের বুকের কাছটা, বেন্চের উপর রাখা বই খাতার বেশ খানিকটা, ডেস্কের এক পাশটা ভিজে গেছে। বার বার জামার হাতা দিয়ে নাক ও চোখের পানি মুছে মুছে সেটার অবস্থাও ভিজে জবজবে ও সপসপে। হাবলুর এই মন খারাপের দৃশ্যে স্বয়ং বিধাতারও বুঝি বুক ফেটে যায়।
পড়ালেখায় ভীষন রকম দূর্বল হওয়ায় আর বার বার পরীক্ষায় ফেইল করায় সহপাঠীরা তার নাম দিয়েছে হাবলু। কেউ কেউ আবার এক কাঁঠি বাড়িয়ে গাবলু বা গোবলু বলেও ডাকে। বলতে গেলে বন্ধু বলতে কেউই নেই তার। সচরাচর দেখা যায়, পড়ালেখায় ভীষন রকম লাড্ডুগুড্ডু ছাত্রদের বন্ধু হয় বরং অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী। পড়ালেখায় সেরা না হলেও দুষ্টুমীতে তারা হয় সকলকে ছাড়িয়ে আর তাই তাদের নানারকম অত্যাচারের ভয়েই হোক বা তাদের মধ্যে ভালোমানুষী না দেখাবার প্রবণতা অথবা পৃথিবীর কোনো নিয়মকেই তোয়াক্কা বা পরোয়া না করবার মত সাহসী চরিত্রের কারণেই হোক না কেনো সবাই তাদেরকে বিশেষ সন্মান করেই চলে।
কিন্তু ভীষন রকম গোবেচারা হওয়ায় আর খুব ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর নতুন মা আর বাড়ির সকলের নানা রকম আদেশ, উপদেশ আর অতি অতি উৎসাহী কিছু মানুষের আদিখ্যেতা ও অবহেলার কারণে হাবলুর মাথার ভেতর সবকিছু যেন তালগোল পাঁকিয়ে গেছে। পড়ালেখা বা তার করণীয় কাজকর্ম, নিয়মকানুন গুলো কেমন যেন সব জট পাঁকিয়ে যায়। পড়ালেখা কিছুতেই মাথায় ঢোকেনা তার। পড়তে বসলেই বই এর কালো কালো লেখাগুলো সব জ্যান্ত ডেয়ো পিঁপড়ে হয়ে কিলবিল করে নড়তে থাকে তার চোখের সামনে। ভয়ে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যায় ওর। আর তারপর পড়ার টেবিলের উপর মাথা রেখেই কখন যে চলে যায় ঘুমের দেশে, তা সে নিজেও জানেনা।
রাত বাড়লেও কেউ তাকে খেতেও ডাকেনা। খাবার টেবিলে ঢাকা দেওয়া ঠান্ডা ভাত তরকারী আরও ঠান্ডা হতে হতে কড়কড়ে হয়ে এতটাই খাওয়ার অযোগ্য হয়ে ওঠে যে পিঁপড়ে, টিকটিকি ও রাতের নিশাচর পোঁকামাকড়ও তা ছুঁয়েও দেখেনা । ঘুমের রাজ্যে গাবলু দেখা পায় ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা তার ভালোবাসার একমাত্র আশ্রয়স্থল, তার পরম মমতাময়ী মা এর কোমল মুখটার। মা তাকে একটুও বকে না। তার এত রকম বোকামী কর্মকান্ড, প্রতি বছর পরীক্ষায় ফেইল করা এসব নিয়ে কিচ্ছু বলেন না তাকে। মায়ের মুখটা সব সময় হাসি হাসি হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে । ওর স্বপ্নের মাঝে মা কোনো কথা বলতে পারেননা। তবুও মায়ের বোবা চেহারাটাই যা একমাত্র সারাদিন শেষে ঘুমের রাজ্যে সস্তি দেয় ওকে। ভোর না হতেই আবার সেই চেঁচামেচি, তার সকল দোষ আর অন্যায় অপরাধের বিচার আচার, বকাঝকা। তার বোকামী আর তার সাথে বাড়ির সকলের মান সন্মান ডোবানোর কারণে প্রায়ই বাবার হাতে বেশ ভালো রকম উত্তম মধ্যম জোটে তার কপালে।
ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষার বৈতরনী সে কোনোমতেই পার হতে পারেনি। পর পর তিনবার একই ক্লাসে ফেইল করবার পর এবারের হাফ ইয়ার্লী পরীক্ষাতেও সে অংকে ডাবল জিরো পেয়েছে। আজ একটু আগেই গনেশ স্যার জোড়া বেত দিয়ে পিঠের উপর বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে গেছেন। শিপলু ওরফে হাবলু বসে বসে ভাবছে বাড়ি ফিরলে আজ আর রক্ষা নেই তার। পরীক্ষার খাতা বাবাকে দিয়ে সিগনেচার করাতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর। বাবার শখের মোটা কালো তেল চকচকে ছড়িটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার। হাবলু কি করবে ঠিক বুঝতে পারেনা।
একে একে স্কুলের সব স্যার ম্যাডামরা বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। স্কুলের দপ্তরী রমিজভাই ক্লাসরুমে তালা লাগাতে এসে হাবলুকে দেখে অবাক!
: কি ব্যাপার তুমি বাড়ি যাওনি কেন বাবা? কি কারণে যেন এই মায়াদয়াহীন নিঠুর পৃথিবীতেও খুব দু একজন মানুষের অকারণ স্নেহও ঠিক ঠিক বুঝতে পারে গাবলু। রমিজভাই তাদের মাঝে একজন।
: কি হইছে বাবা? পরীক্ষা ভালো হয় নাই? কম নাম্বার পাইসো? যাও যাও উঠো উঠো। বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়া মন দিয়া পড়ালেখা কইরো অহন থেইকা। এরপরবার ইনশাল্লাহ তুমি ফার্স্ট হইবা দেইখো।
শিপলু নিরুত্তর। রমিজ ভাই এর কথামত মন দিয়ে পড়ালেখা করা আর তার চাইতে জলে পাথর ভাসানোও অনেক সহজ তার কাছে। অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে দাঁড়ায় সে। বাড়ির পথে পা বাড়ায়। স্কুল ছুটি হয়েছে সাড়ে ৪ টায়। সম্ভবত ঘন্টাখানেক পার হয়েছে। শীতের বিকেল। চারিদিকে এরই মাঝে ঝিম ধরা ভাব। হাবলু ওরফে শিপলুর মতই যেন প্রকৃতিতে খেলা করছে বিষন্নতার প্রহর।
খুব ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরছে শিপলু। ইচ্ছে হচ্ছে পালিয়ে যায় কোথাও। যেখানে কেউ তাকে আর খুঁজে পাবেনা কখনও। কিন্তু যাবেটা কোথায়? ওর যে যাবার কোনো জায়গাই নেই। ভাবছে কেনো যে তার মাথায় অংক, বিজ্ঞান, ইংরেজীর মত বিষয়গুলো কিছুতেই ঢোকেনা? বই খুললেই কেনো পাটীগনিত, বীজগণিতের অংকগুলো ভয়ংকর সব সরিসৃপ হয়ে ওকে কামড়াতে আসে? খটমট ইংরেজী শব্দগুলো কেন কটমট করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে? বিজ্ঞানের বই খুললেই মাথা ঘোরা ঘোরা, অজ্ঞান অজ্ঞান লাগে কেনো? কিছুতেই মাথায় ঢোকেনা পড়াগুলো। বার বার ফেইল করায় বন্ধুদের দেওয়া নাম "হাবলু" ক্রমে ক্রমে স্কুল ছাড়িয়ে চাউর হয়েছে পাড়াপড়শী, আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত । ঘরে বাইরে সবখানেই ওকে সবাই এখন হাবলু নামেই চেনে। এমনকি সেদিন বাবার কাছে আসা একজন আগন্তক পর্যন্ত বলে বসলেন,
: এটা কি হাবলুদের বাসা? তুমি কি হাবলু? তোমার বাবাকে একটু ডেকে দাও তো বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর নিজের অজান্তে বুকের ভেতর থেকে। ও যেন নিজেই ভুলতে বসেছে আজ ওর নিজের নাম। দুঃখে, অপমানে হাঁটতে হাঁটতে ফের ওর চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে শুরু করে।
বাড়ি ফিরতেই শিপলুর সৎমা চিলচিৎকার দিয়ে ওঠেন,
:কোথায় ছিলি এতক্ষন বাঁদর? সেই কখন স্কুল ছুটি হয়েছে আর তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো এই ভরসন্ধ্যায়? আসুক তোর বাবা আজ।
ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো শিপলু। হঠাৎ নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে ওর। কেনো যেন সকল বিপদ আপদ, দুঃখ কষ্টের সময়গুলোতে মায়ের মুখটাই সামনে এসে দাঁড়ায় ওর । সেই হাসি হাসি নির্বাক মুখ। কিচ্ছু বলেন না কখনও। কোনো সান্তনা না, কোনো তিরষ্কার না, শুধুই বুঝি অভয় দেন ওকে। বুকের ভেতরটা আরও একবার মুচড়ে ওঠে ওর।
চুপচাপ হাতমুখ ধুঁয়ে মুখ নীচু করে খাবারঘরে গিয়ে ঢোকে। থালায় ঢাকা শুকনো কড়কড়ে ভাত আর ঠান্ডা তরকারী কোনোমতে নাকেমুখে গুঁজে খেয়ে উঠে বাগানের দিকে এগুতেই বাঁধা পায়। ফের সৎমা চিৎকার করে ওঠেন,
: আবার কোথায় বের হোস নবাবজাদা? সারাদিন পার করে এতক্ষনে ভাত গিলে আমাকে উদ্ধার করলেন উনি? খবরদার বাসা থেকে বের হবিনা।
বাসা থেকে কোথাও বের হলে যদি বাবা বাড়ি ফেরামাত্রই হাবলুর নামে সদ্য পাওয়া সময়মত বাড়ি না ফেরার গুরুতর অপরাধের জবাব বেতের বাড়িতে হাবলুর পিঠের উপর দিতে সামান্যতম দেরীও হয়ে যায়, সেই ভয়েই বুঝি সৎমা চাইলেন হাবলু যেন বাড়ির বাইরে এক পাও না নড়ে।
পরম ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করে তার বিরুদ্ধে মায়ের করা অভিযোগমাত্র বাবার দেয় পুরষ্কারের।
মায়ের তিরষ্কারের কোনো রকম জবাব না দিয়ে মা একটু আড়াল হতেই চুপি চুপি সে চলে যায় বাড়ির পেছনের এক টুকরো সব্জী বাগানের দিকে। উদ্দেশ্য বাড়িফেরার পথে লুকিয়ে রাখা অংক পরীক্ষার খাতাটা বাগানের কোনায় মাটি খুড়ে ভালো মত চাপা দিয়ে আসা।
বেশ কিছুদিন পর একদিন এক ছুটির দিনে শিপলু একা একা ডাংগুলি খেলার জন্য একটা যুৎসই গাছের ডাল বাগানের এদিক ওদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, বাগানের কোনে ভারি সুন্দর ধপধপে দুধসাদা,একটু একটু লালচে আভা মিশেল দেখতে এক চারাগাছ। বাতাসে দুলে দুলে গাছটা যেন ঠিক তারই দিকে চেয়ে হাসছে। ঠিক এখানটাতেই যে সে সেই ভয়ংকর দুইশূন্য পাওয়া অংক খাতাটা লুকিয়ে রেখেছিলো তা কিন্তু সে ভোলেনি। এর মাঝে খাতা হারিয়ে ফেলার অপরাধে পিঠের ওপরে বাবার মোটা লাঠিটা ভেঙ্গে ফেলার পালা সাঙ্গ হয়ে গেছে। বাবা তাকে খুব করে শাসিয়েছেন, এরপর পরীক্ষার খাতা ও বাসার রাফখাতা বা স্কুলের খাতা যে কোনো খাতাই শিপলু যদি আর কোনোদিন হারায় তবে সেই খাতার এক একটি পাতার বদলে শিপলুর পিঠের এক একটি হাড় তিনি ভেঙ্গে নেবেন। এত সুন্দর গাছটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে এ জীবনের পাওয়া সকল দুঃখ বেদনাই বুঝি ভুলে যায় সে।
এরপর রোজ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর পরই শুরু হলো তার সেই একরত্তি চারাগাছটার যত্ন নেওয়া। কিছুদিন যেতেই শিপলু অবাক হয়ে খেয়াল করলো গাছের পাতাগুলো কেমন চেপটা চেপটা । কিছুটা খাতার পাতার মত চৌকোনা চৌকোনা। আরও কিছুদিন যেতে সেই পাতাগুলো পুরোপুরিই এক একটা খাতার পাতার মত রুপ ধারণ করলো। শিপলু তো অবাক! গাছে পাতার বদলে ধরেছে খাতা। বাড়ির লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই অবাক! এমন আজব ঘটনা ত্রিভুবনে কোথায় ঘটতে শোনেনি তারা, দেখেওনি।
শিপুলুর জীবনে আর খাতার চিন্তাই রইলো না। এমনকি তাদের পাড়া পড়শী, দুঃখী দরিদ্র সকলেরও আর খাতা কেনার কোনো ঝামেলা নেই। দরকার পড়লেই শিপলু ঠাস করে একটা খাতা ছিড়ে আনে গাছ থেকে। তারপর তাতে ছাতা মাথা যা খুশী লিখে ফেলে বা এঁকে ফেলে। আশে পাশে চারিদিকে গরু বাছুর, জীবজন্তু যা দেখে তাই এঁকে এঁকে বাড়িঘর বোঝাই করে। বাংলা বই খুলে তা থেকে দেখে দেখে ছড়া, কবিতা, রচনা লেখা শুরু করে। এমনকি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসেও সে পাটী গনিত, বীজ গনিতের সমাধান করে ফেলে মাথা খাঁটিয়ে। মোট কথা এখন শিপলুর একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান ঐ খাতার গাছ। সেই তার বন্ধু, সেই তার খেলা, সেই তার সকল ভালোলাগা ও ভালোবাসার স্থল। পাড়া প্রতিবেশীরাও ছেলেমেয়েদের খাতা দরকার পড়লেই তাদের বাড়িতে আসে আজকাল। শিপলুও তাদের অকাতরে বিলিয়ে দেয় খাতার পাতা। যতই বিলোয় ততই সে গাছ ছাপিয়ে ফুলে ফেপে বেড়ে ওঠে খাতার পর খাতা। শিপলু আর শিপলুর খাতার গাছ সারা দেশেই বেশ সাড়া জাগিয়ে ফেললো কয়েকমাসের মধ্যেই।
এ বছর শিপলু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। স্কুলের বন্ধু বান্ধব, শিক্ষক শিক্ষিকা থেকে শুরু করে রমিজভাই, স্কুলের ক্লিনার মথুরাদা পর্যন্ত সবাই খুশী ও ভীষন রকম অবাক আজ শিপলুর এই সাফল্যে। হেডস্যার যখন অবাক হয়ে জিগাসা করলেন, হঠাৎ এ কয়েকমাসের মধ্যে শিপলুর এমন অভাবনীয় ভালো রেজাল্টের রহস্য কি? কি অধ্যবসায়ের কারণে এত ভালো ফলাফল করলো সে, সকলের সাথে তা শেয়ার করতে? শিপলু অনেকক্ষন ভেবে মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিলো,
: স্যার আগে যা করতাম তা থেকে আমি তো বিশেষ কিছুই করিনি। শুধু খাতার গাছ জন্ম নেবার পর থেকে তার পরিচর্যা করেছি মন দিয়ে । খাতার পাতা নিয়ে খেলেছি, ছবি এঁকেছি, অংক কষেছি, ছড়া লিখেছি.......মাঝে মাঝে টিভি দেখে দেখে ছোটবোনের জন্য এ্যরোগামী রকেট, নৌকা, ঘুড়ি বানিয়েছি কাগজ দিয়ে।
সেটা শুনে স্যার একটু মুচকি হেসে শিপলুর এত বড় সাফল্যের জন্য বিশেষ পুরষ্কার ঘোষনা করলেন। তার বুঝতে আর বাকী রইলোনা যে ঠিক কি রহস্য আজ শিপলুর এই ভালো ফলাফলের কারণ। তিনি আরও জানালেন, পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি সকলকে জানাবেন, শিপলুর এত ভালো ফলাফলের অজানা রহস্যের কারণ।
তোমরা কি ভাবছো যে, সেই সেদিন তাদের স্কুলের দারোয়ান রমিজভাই এর দোয়াতেই শিপলু এ বছর পরীক্ষায় ফার্স্ট হলো? তা কিন্তু সবটুকু সত্যি নয়। রমিজভাই এর দোয়ার সাথে সাথে শিপলুর আজব খাতার গাছ তাকে শিখিয়েছে একটু বেশী সময় নিয়ে চর্চা ও একটু মন দিয়ে লেখালিখি, পড়াশোনাগুলো করে ফেললেই হাবলুর মত একদিন কিচ্ছু মাথায় না ঢোকা ছেলেদের কাছেও অংক বিজ্ঞান বা ইংরেজীর মত কঠিন বিষয়গুলোও পানির মত সহজ হয়ে যায়।
হেডস্যারও সে উদাহরণটাই দিলেন সেদিন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। তিনি বললেন, প্রাকটিস ইজ দ্যা কী অফ সাকসেস। এ কথাটা শিপলু প্রমান করেছে। শিপলু খাতার গাছ নিয়ে খেলার ছলে খাতার পাতায় দিনের পর দিন পড়ালেখার চর্চা করেছে। সে নিজেও জানতে পারেনি, নিজেরই অজান্তেই মনের আনন্দ নিয়ে সে কঠিন কঠিন অংকগুলো শিখে ফেলেছে। শিখেছে ইংরেজী, বাংলা বা বিজ্ঞানের মত কঠিন বিষয়গুলো। কাজেই শিপলু প্রমান করলো চর্চায় অসাধ্য সাধনও সম্ভব।
শিপলুকে এখন সবাই ভালোবাসে। কেউ তাকে আর হাবলু বলে ডাকেনা। হাবলু নামটা সে সবাইকেই ভুলিয়ে দিয়েছে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। সব বিষয়ে ভালো ফলাফলের সাথে সে হয়ে উঠেছে একজন ভালো আঁকিয়েও। ওদের গ্রামে কোনো ছেলেমেয়েদেরই এখন খাতার অভাব নেই। শিপলু সবাইকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিস্তা দিস্তা খাতা সরবরাহ করে। শুধু সমস্যা হয় বর্ষাকালে। সারাদিনমান বৃষ্টিতে খাতা ভিজে ভিজে জবজব করে। সেই খাতায় না যায় লেখা না আঁকা যায় ছবি।
তাতে কি? আষাড় আর শ্রাবন মাত্র তো দুইটা মাস। তারপরই শুস্ক শুস্ক খাতার পাতায় গাছ ভরে ওঠে। সবাই মজা করে খাতা নিয়ে লেখা পড়া করতে বসে।শিপলুর মত এমন খাতার গাছ কি এই বিশ্বে আর কারো বাড়িতে আছে।!
আর তাই গিনেস বুকে নাম লেখাবার কথাটা চিন্তা ভাবনা করছে শিপলু আর তার পরিবারের মানুষগুলো।
লেখাটা উৎসর্গ করছি আমার অনেক অনেক প্রিয় একজন মানুষ আমার ভাত ভাইয়াকে তার একটা লেখাতেই কমেন্ট করতে গিয়ে আমি এই লেখাটা লেখার গ্রেট আইডিয়াটা পাই। তারপরপরই আমার স্কুলের ক্রিয়েটিভ রাইটিং কম্পিটিশনের এক্সাম্পল হিসাবে আমি বাচ্চাদেরকে শুনাই আমার এই গল্পটা। কেউ হয়তো বিশ্বাসও করবেনা এ যুগের বাচ্চারাও কি পরিমাণ মজা পেয়েছে খাতার গাছের মত এমন একটা আজগুবী কাল্পনিক গল্পটা শুনে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিলো তারা যতক্ষন গল্পটা বলেছি ততক্ষন আমার মুখের দিকে। গল্পের শেষে তাদের জন্য একটা মজার ইনফরমেশন ছিলো তা নিশ্চয় বুঝতে তাদের আর বাকী নেই। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ভাইয়া। অনেক ভালো থেকো সারাজীবন এমনি ভালো মনের একটা মানুষ হয়ে। কতখানি বড় মনের মানুষ তুমি আর কে কে জানে জানিনা তবে আমি তো জানি। সাথে তোমার লেখাটার সেই নায়ক এলাহীভাইয়াটার জন্যও রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা আর শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১২ সকাল ৮:৩৮