আমি যেই জবটা করি সেটা শিক্ষকের জব নাকি এক মজার খেলা সে আমি নিজেই বুঝতে পারিনা আসলেই। খুব ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টু দুষ্টু পরীর মত এক একটা বাচ্চাকে যখন রোজ সকালে দেখি মনে হয় যেন স্বর্গ থেকে নেমেই এসেছে এক ঝাঁক পরী বাচ্চা। তারাও ঠিক আমার ছোটবেলার টিচারদের মত আমাকে দেখে না। তারাও ভাবে আমি একজন তাদেরই বন্ধু তাদেরই মতন কিন্তু শুধু একটু সাইজে বড় সড় এই যা। আর আমি ভুলেই যাই আমার বয়স যে বাড়ছে। আমি ওদের মতই খেলি, ওদের মতই ভাবি, ওদের মত করে নিজেকে ভাবাই এবং শেখাই আর আমি তাই ওদের মতই ওদের বয়সেই আটকে থাকি। হা হা .......
এইভাবেই ভালোই চলছিলো আমার হেসে খেলে আনন্দে। আমার ক্লাসের বাচ্চাদের এইজ লেভেল চার থেকে পাঁচ বছর আর তাই আমার কাজ শুধুই খেলা ছলে অক্ষর আর নাম্বার লেখা শেখানো আর নানান রকম মজার মজার গল্প কবিতা নাচে গানে দিন দুনিয়ার নানা বিদ্যা শেখানো। কাজেই সেই খেলা ছলে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভালোই আনন্দে আর হাসি গানে কাটছিলো দিন।
হঠাৎ কোথা থেকে এক অদৃশ্য দানবের করাল গ্রাসে বন্ধ হয়ে গেলো আমার হেলা খেলা সারাবেলা খেলা খেলা মজার জবটার নানা রকম বিদ্যাবুদ্ধি। নতুন করে ভাবতে হলো। নতুন করে সব বুঝতে হলো। মনিটরের মাঝে দিয়ে একদম অজানা অচেনা নতুন এক ঝাঁক বাচ্চাদের সাথে পরিচিত হতে হলো। তাই আমার বশীকরণ যাদু কাঁঠিটাও নানা রকম রঙে ঢঙে সাজাতে হলো। সেই কাজ করতে গিয়ে আমার দিন রাতের ঘুম হারাম হলো -
লিটিল মিস মাফেট স্যাট অন আ টাফেট, ইটিং হার কার্ডস ......
কখনও আমি নিজেই হ্যাট মাথায় লাল টুকটুক জামা পরে হয়ে যাই রেড রাইডিং হুড বা কখনও দই আর বাটি চামচ নিয়ে নেচে গেয়ে ওদেরকে শুনাই আর সাথে সাথে শেখাই লিটল মিস মফেট স্যাট অন আ টাফেট.... আবার কখনও কখনও লাল নীল রং গুলিয়ে গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে ঢেলে বানাই নানা রকম ফলের জ্যুস।
লাল নীল হলুদ সবুজ রঙে বানিয়ে ফেলা আমার সব রকম ফ্রুটস জ্যুস
চা বানিয়ে টিপট আর টি কাপ নিয়ে বসি। বাচ্চারা হা করে তাকিয়ে থাকে। দৌড়ে নিয়ে আসে তাদের হ্যাট। মাথায় পরে গান গায় আমার সাথে।
আই এ্যাম আ লিটল টি পট শর্ট এন্ড স্টাউট.......
টি - টাইগার
সেদিন শেখাচ্ছিলাম নানা রকম ভেজিটেবলসের নাম তো আমি যখন দেখাচ্ছিলাম আমার ফ্রিজ থেকে বের করে আনা লাল টুকটুক টমেটো বা সবুজ কচকচে শশা তখনই মায়েরা তাদের হাতে এনে দিলো বেগুন, গাজর, আলু। আমি তো মহা মুগ্ধ! অনলাইন ক্লাসে শুধু বাচ্চারাই না মায়েরাও এনজয় করছে তারাও কো অপারেট করছে। আমি মায়েদের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম।
কত্ত রকম ভেজিটেবলস
এর মাঝে ছিলো আমার জন্মদিন। সেদিন মায়েরা বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিলো বড় বড় পোস্টার কার্ড বেলুন। ঠিক টিভিতে দেখা ঐ এডটার মত আমিও মুগ্ধ হলাম।
সবচাইতে অবাক করা ব্যপারটাই ঘটলো কালকে।
হ্যাপী টিচার্স ডে........ গিফ্টস ফ্রম মাই বিলাভড সটুডেন্টস
কাল ছিলো টিচার্সডে। ঠিক সন্ধ্যার আগে ভাগে বাসায় একটা নয় দুটো নয় তিন তিনটা পার্সেল এলো। সেই পার্সেলের আকার এবং আকৃতি দেখহে নীচে তো গার্ড আর ড্রাইভাররা একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। তো তখনই এক প্যারেন্টস ফোন করে জানালো। তারা সব্বাই মিলে তাদের প্রিয় টিচারের জন্য টিচার্সডে তে পাঠিয়েছে সেই অমূল্য গিফ্ট। আমি অনেকগুলো বছর জব করছি। প্যারেন্টস এবং বাচ্চাদের ভালোবাসাও পেয়েছি অনেক। কিন্তু অনলাইনের এই নড়বড়া সময়ে যে এত ভালোবাসা পাবো তা কখনও ভাবিনি। আমি আপ্লুত হলাম।
মনে পড়লো ছোট্টবেলার আকতার স্যারকে। যে আমাকে শিখি্যেছিলো ছবি আঁকার মজা। নিজের আর্ট বুকটাই দিয়ে দিয়েছিলো আমাকে।
মনে পড়লো বুলি আপাকে। যেই বুলি আপার জন্য আমি শিখেছিলাম বাংলা গ্রামারের নানান কৌশল। মনে পড়লো কামরুল স্যারকে আমার আজন্ম ভীতির বিষয় অংককে কি করে আমার মাথায় ঢুকিয়ে ক্লাস ফাইভ এবং এইটে বৃত্তি পাইয়ে ছেড়েছিলেন তিনি। কত শত জনের কত শত অবদান। আমার সঙ্গীত শিক্ষার ছোট্টবেলার টিচার রুহুল কুদ্দুস। যে পরম মমতায় আমার গলায় গান তুলে দিয়েছিলেন সে মমতা কি আর কোথাও পাবো? কোথাও পাওয়া যায়? সব কিছুর পরেও চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, যখন মনে পড়ে রুহুল কুদ্দুস স্যারের শীত গ্রীস্ম বর্ষায় পরে থাকা একই কালো কোটটার কথা। মনে পড়ে যায় কামরুল স্যারের সেলাই করা চটিটির কথা। একদিন আমরা বুলি আপার বাসায় গিয়েছিলাম। ছোট্ট সুন্দর ফুলের বাগান ঘেরা নিরিবিলি সেই মায়াময় বাসা। আবু জাফর স্যারের ন্যায় অন্যায় জানিনে করে আমাকে বিশেষ ভাবে স্নেহ বা প্রশ্রয় দেবার কথাও মনে পড়ে যায় আমার। কোথায় আছেন কেমন আছেন তারা? জানা হয় না আমার......
ছোট্টবেলার সেই মানুষ গড়ার কারিগরদেরকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। কিন্তু আজকালকার মায়েরা তা হতে দেবে না।তারা চির স্মরনীয় করে রাখতে টিচার আর বাচ্চাদের ছবি বাঁধিয়ে রেখেছে। এবং সাথে সাথে দিয়েছে আমাকেও। যতদিন বেঁচে থাকবো চোখ পড়ে যাবে সেই স্মৃতিতে। মধুময় স্মৃতি। বাচ্চাগুলো বড় হয়ে যাবে। অনেক অনেক বড় বড় মানুষও হবে তারা কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলো বাঁধা থাকবে আমার এই ফ্রেমটির মাঝে।
গতবছর আমি গিয়েছিলাম প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সন্মাননার একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে দূর দুরান্ত থেকে কি অসাধারণ সব শিক্ষকেরা এসেছিলেন। তাদেরকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। তাদের কৃতকর্মগুলিও জানবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেখানে দেখানো ডকুমেন্টারী ইউটিউবে খুঁজে পেলাম।
আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০১৯
আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা
সকলেরই মনে হয় মনে পড়ে গেলো ছেলেবেলার প্রিয় শিক্ষকদের মুখগুলি......
সবাইকে শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা। আর গ্রামে গঞ্জে দেশে ও বিদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল শিক্ষকেরা ভালো থাকুক। আর কিছু না হোক অন্তত একটু ভালোবাসায়.........
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:৫৯