৪ নভেম্বর ২০০৮। শিকাগোর ইলিনয়ের গ্রান্ট পার্ক। এক কৃষ্ণাঙ্গের কথা শুনতে জড়ো হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। শুধু সরাসরি শ্রোতারাই নয়, বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষ টেলিভিশনের সামনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে এই অসাধারণ বাগ্মী লোকটির কথা। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ একসাথে শোনা ও একাধিকবার শোনার জন্য এ বক্তৃতাটি একটি অন্যতম জায়গা দখল করে থাকবে। আর এমন অনেক ইতিহাসের জন্ম দেয়া এ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটি প্রথমবারের মত সমসাময়িক পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনটি নিজের দখলে করে নেয়ার পর কি বলেছিলেন-
‘আজরাতে, আমরা যা করতে পেরেছি, এই নির্বাচনের মাধ্যমে, এই অসামান্য সময়ে, পরিবর্তন ইতোমধ্যেই আমেরিকায় চলে এসেছে। আমাদের পথ অনেক দীর্ঘ, আমাদের অতিক্রম করতে হবে অনেক বাধা, আমরা হয়ত এক বছরের মধ্যে গন্থব্যে পৌছাতে পারবোনা, হয়তো এক মেয়াদেও নয়, কিন্তু আমি কথনোই আজ রাতের চেয়ে বেশি আশাবাদী হয়নি যে আমেরিকা একদিন সে গন্থব্যে পৌঁছাবেই।‘
ওবামার এ আবেগঘন বক্তৃতা, তার এই আশাবাদি অঙ্গিকার, তার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি সেদিন হাজারো মানুষকে একত্রিত করেছিল উচ্চাশা নামের এক ছাতার তলায়। কথার ভাঁজে অশ্রুসিক্ত করেছিল অনেককেই, সেলিব্রেটির নিয়ন আলো ছেড়ে গণমানুষের কাতারে নেমে এসে চোখের জল ফেলেছিলেন অপরাহ উইনফ্রে ও জেসি জ্যাকসন।
যে আশা আর আবেগের ফানুসে চড়ে ওবামা ক্ষমতায় এসেছেন, তার গরম বাতাস যে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হবেনা, তা হয়তো ওবামা নিজেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই হয়তো তিনি তার বক্তৃতায় ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন যে, খুব বেশি পরিবর্তন তিনি এক মেয়াদে নাও আনতে পারেন। কিন্তু আমেরিকার ভোগবাদি ও হলিউডি দ্রুত পরিবর্তনকামী জনগণ কি তা মেনে নিতে পেরেছে। অথবা বারাক ওবামাই বা তার বাগ্মীতার কতটুকু অংশ বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন?
বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই অনেকের মোহভঙ্গ হওয়া শুরু করে। কমতে শুরু করে তার জনপ্রিয়তা। এক বছর পূর্তি হবার পর জনমত জরিপে দেখা যায়, অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকানরা মনে করে তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ওবামার প্রথম তিন মাসের পর তার কার্যক্রম সমর্থন করেছেন শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ, কিন্তু তারপরেই তা কমে শতকরা ৫৩ ভাগে দাঁড়ায়। আর রিপাবলিকানরা যে তার নীতি পছন্দ করবেন না তাতো জানা কথাই। রিপাবলিকানরা তার নেয়া স্বাস্থ্যনীতির কারণে তাকে নাৎসি বলতেও দ্বিধা করেনি। আমেরিকানদের শত্রু হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর সাথে ভাল সম্পর্ক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ও গুয়ান্তানোমো বে কারাগার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়ে ওবামা আমেরিকাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিমত দিয়েছে ফক্স নিউজ।
এমনকি যারা ছিল ওবামার নির্বাচনের সময়কার সবচেয়ে বড় সঙ্গী, তারাও অনেকে ওবামার নীতির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান হাওয়ার্ড ডিন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ওবামার স্বাস্থ্যসেবা বিল অনুমোদনের যোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন তিনি। এই বিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ইনশ্যুরেন্স ফার্মগুলোর জন্য এক ধরণের উপহার এবং এর মাধ্যমে আমেরিকার লাভের চেয়ে ভবিষ্যতে ক্ষতিই বেশি হবে বলে মনে করেন ডিন।
একদিকে যেমন রিপাবলিকানরা বলছেন ওবামা শত্রুদেশগুলোর সাথে ভালো সম্পর্ক করতে গিয়ে আমেরিকাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন অন্যদিকে লিবারেলরা আফগানিস্তানে নতুন করে সেনা পাঠানোর জন্য ওবামার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ৯ ডিসেম্বর ২০০৯ আ্ফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেন ওবামা। তবে এর সাথে সাথে ১৮ মাসের মধ্যে সেনা অপসারণ করা হবে বলেও জানান। তা সত্বেও ওবামার অনুগত হিসেবে পরিচিত হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার ন্যান্সি পেলোজি আফগানিস্তান ইস্যুতে ওবামার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকিও দিয়েছেন। বুশের জনপ্রিয়তাই ধ্বস নামাতে বিখ্যাত ডকুমেন্টারি ফারেনহাইট নাইন এলেভেন এর একটা ভাল ভূমিকা রয়েছে। ফারেনহাইট নাইন এলেভেনের নির্মাতা ও ওবামার আর একজন বড় সমর্থক মাইকেল মূরতো বারাক ওবামার নামই দিয়ে ফেলেছেন ‘নতুন যুদ্ধংদেহি প্রেসিডেন্ট’। এদের মত অনেকেই ওবামার পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতির অপমৃত্যু ঘটেছে বলে মনে করেন। নির্বাচনের আগে ওবামা যেন ছিলেন একটি ফাঁকা স্লেট। ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, রিপাবলিকরা ও যারা সেরকমভাবে কোন দলের সমর্থক নয় তারাও এই ফাঁকা স্লেটে নিজেদের আশা আর আকাঙ্খার চক দিয়ে নানা স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন, পরিবর্তনের অঙ্গিকার ঢুকে গিয়েছিল তাদের অস্থিমজ্জায়। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই উচ্চাশা থেকে নিরাশায় পর্যবসিত হয় তাদের স্বপ্ন। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদটির যে কি উত্তাপ তাও টের পেতে শুরু করেছেন বারাক ওবামা। অনেকেই এমন আশঙ্কা করছেন যে তিনি জিমি কার্টারের মত এক মেয়াদেই প্রেসিডেন্ট থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা অভিষিক্ত হন ২০ জানুয়ারি, ২০০৯ এ। প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই ইরাক থেকে সেনা অপসারণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে নির্বাহী আদেশ ও প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরান্ডা জারি করেন তিনি। জানুয়ারি ২০১০ সালের মধ্যে গুয়ান্তানামো বে কারাগার বন্ধের নির্দেশও দেন তিনি। ইরাক নিয়ে বারাক ওবামার দেয়া প্রথম ভাষণ অনেকেরই বেশ পছন্দ হয়েছিল। তিনি শর্তহীনভাবে সেনা অপসারণের ঘোষণা দিয়ে বলেন ছয় মাস বা এক বছর নয়, এখন থেকেই সেনা অপসারণ শুরু হবে। ইরাক থেকে সেনা অপসারণের এ ঘোষণা শুনতে খুবই ভালো শোনায় কিন্তু কাজে পরিনত করতে যে কি সমস্যা তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ওবামা। এ ঘোষণা মার্কিন সেনাবাহিনীর অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি, এ ধরণের ঘোষণা সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়ে সেনাদের হতাশ করে দেয় বলে উচ্চপদস্থ এক সেনা কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।(Michael J. Gerson, Washington Post, March 5, 2008)। এছাড়া মিশর, সৌদি আরবের মত সুন্নীপ্রধান মার্কিন মিত্রদেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্য থেকে পরাজিতের মত মার্কিন সেনাদের চলে যাওয়ার ঘোষণাকে ভালো চোখে দেখেনি। মার্কিন সেনারা চলে গেলে এসব দেশ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে ইরান অনুগত গেরিলা দলগুলোর রোষের মুখে পড়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকবে বলে অনেকেই মনে করেন। বারাক ওবামা এখনই সেনা সরানো হবে বলে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে ‘এখন’ এর সময়সীমা আগস্ট ২০১০ এ গিয়ে ঠেকেছে। এমনকি এর পরেও ইরাকি সেনাদের ট্রেনিং ও সহযোগিতা করার নামে ২০১১ পর্যন্ত সেনা রাখার ঘোষণা দিতে ইতোমধ্যেই বাধ্য হয়েছেন ওবামা। এ ঘোষণা অনুযায়ি ৩৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার মার্কিন সেনা ২০১১ এর শেষ পর্যন্ত ইরাকে অবস্থান করবে।
গুয়ান্তানামো বে কারাগার নিয়েও ওবামার সিদ্ধান্ত সমালোচনার মুখে পড়েছে। ওবামা তার নিজ রাজ্য ইলিনয় এর একটি ছোট কারাগারে গুযান্তানামো বে কারাগারে বন্দী ২১০ জনকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে অপ্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন রিপাবলিকানরা। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, এর ফলে মূল সমস্যার কোন সমাধান না করে বন্দীদের শুধু ঠিকানার পরিবর্তন ঘটানো হল। জানুয়ারি ২০১০ সালের মধ্যে কারাগারটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার যে প্রতিশ্রুতি ওবামা দিয়েছিলেন, তাও তিনি রাখতে পারেননি। জানুয়ারি ২০১০ এ কারাগারটিতে রয়ে যায় ১৯৩ বন্দী।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম বক্তৃতায় বারাক ওবামা বলেছিলেন, শত্রুদের সাথে আলোচনা করতে যেকোন মূল্য দিতে, যেকোন বাধার মুখোমুখি হতে ও যেকোন দূরত্ব অতিক্রম করতে তিনি প্রস্তুত। ওবামা প্রথমেই দেখা করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সাথে। শর্তহীন আলোচনার প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করলেও তা বাস্তবে আসলে কতটুকু কাজে দিয়েছিল তা নিয়ে অনেকেরই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে দেশের মধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। ওবামা- আহমাদিনেজাদের হ্যান্ডশেকের ছবি দিয়ে ‘আত্মসমপর্নের বৈঠক’ শিরোনামে খবর ছাপে নিউইয়র্ক পোস্ট। আমেরিকার অন্যতম মিত্র ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীও এ বৈঠকের কারণে জনসম্মুখে ওবামার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলোর মধ্যেও গাত্রদাহ শুরু হয়।
ক্ষমতায় আসতে না আসতেই মন্দার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ ওবামা ৭৮৭ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দেন। এ প্যাকেজ অনুযায়ি স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষাখাত সহ লোকসানি অনেক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দেয়া হয়। এ ব্যবস্থা নেয়া সত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বাড়তে থাকে, যা গত ২৬ বছরের মধ্যে সবোর্চ্চ শতকরা ১০.১ ভাগে গিয়ে দাঁড়ায়।
মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বারাক ওবামা তুরস্কের আঙ্কারায় যে বক্তৃতা দেন তা আরব বিশ্বের অনেকেই প্রশংসা করেন। মিশরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে ইসলামিক বিশ্বের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এক নবযাত্রা শুরুর ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের সাথে তার এ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না আমেরিকার প্রভাবশালী অনেক শক্তি। অন্যদিকে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কোন মাইলফলকও ওবামা তার দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারছেননা। তাই ঘরে বাইরে বেশ চাপের মুখেই আছেন পরিবর্তনের আশা দেখানো এই মানুষটি।
তবে ওবামার জন্য আমেরিকান জনগণ পুরোটাই যে অম্ল তা নয়, কিছুটা মধুরও। পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনুগত ভোটাররা এখনও তাদের নেতার প্রতি আস্থা হারাননি। এদের মধ্যে শতকরা ৮৪ ভাগই মনে করেন বারাক ওবামা বেশ দক্ষভাবেই দেশ চালাচ্ছেন, আর মডারেট ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ওবামার প্রতি সমর্থন শতকরা ৬৯ ভাগ। এটা নিসন্দেহে ওবামার জন্য ভাল খবর, কিন্তু খারাপ খবরটি হচ্ছে গর্ভপাত, অস্ত্র নিয়ন্ত্রন ও বৈশ্বিক উষ্নয়ন ইস্যুতে ওবামার নেয়া অনেক সিদ্ধান্তের সাথে খোদ ডেমোক্র্যাট ভোটারদের অনেকেই একমত নন, অনেকে আবার বিরোধীতায় বেশ উচ্চকন্ঠ। তাই হোয়াইট হাউজে বাস করা এই ব্ল্যাক প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত কালিমাময় যুদ্ধবাজ নীতির বাইরে গিয়ে কতটা শুভ্র থাকতে পারেন তাই এখন দেখার বিষয়।
সাইমুম পারভেজ। প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




