পাহাড় আমাকে কখনও হতাশ করে নাই। তবে বান্দরবানে যতটা সুন্দর ঝর্ণা দেখা হয় নাই কিংবা সুন্দরবনে যতটা ঘনবনে হাঁটা হয় নাই, শ্রীমঙ্গলের অখ্যাত এক ঝর্ণার পথে সব হয়ে যাবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই।
ধন্যবাদ দিতেই হয় গালিব ভাই-সজীবদেরকে। ওরা আগে থেকেই প্ল্যান করছিল, শেষ মূহুর্তে কী ভেবে আমিও যোগ দিলাম। খালি জানলাম এটা একটা ঝর্ণা, আর পথে সাপ আছে। জানতাম না কী চমক অপেক্ষা করছে!
শ্রীমঙ্গল পৌছানোর পর দেখি এলাকার মানুষ হামমামের নাম কস্মিনকালেও শোনেও নাই! তাই সকাল বেলা ক্যাপ্টেন গালিব ভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম আমরা। তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দিলেন যে ঝর্ণাটির অস্তিত্ব আছে, স্থানীয় নাম নাকি শীতপা! উপর্যুপরি তিনি ব্যাপক গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে একটি নাতিদীর্ঘ(!) লেকচার দিলেন (উনি পেশায় লেকচারার :প)। ভাইয়া জানালেন যে ঝিরি পথে পানি কোথাও কোথাও বুক সমান গভীর। এবং জোক, মশা তো আছেই....এখানে নাকি সত্যি সত্যি কিং কোবরা আছে, ইহা ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সত্যমিথ্যা জানি না, শুনে বেশ মজাই লাগছিল, তবে দেখি অভি বেচারা খুব ভয় পেয়ে গেছে (বেচারা তখনো জিআরই তে ১৪২০ পাওয়ার আফটার শক(!) সামলাতে পারে নাই, এরপর আবার এইটা?)। যাহোক, নাস্তা করে রওনা দিতে দিতে বেশ দেরী হয়ে গেল (ট্যুর গোল্লায় যাক, খাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজী নেই)। সাড়ে দশটার দিকে ২টি সিএনজি সহযোগে রওনা দিলাম আমরা ৮জন, গন্তব্য কলাবনপাড়া। যেতে লাগে কমবেশী দেড়ঘন্টা, বলে রাখি এই পথটাও বেশ সুন্দর। পথের পাশে বিস্তীর্ণ চা-বাগান, পাহাড়, লাউয়াছড়া....বেশ ভালো লাগার কথা। শুধু শেষদিকে কলাবনের আগে মাটির রাস্তা, বাকীটুকু পিচঢালা। কলাবনপাড়া পৌছে একজন গাইড ঠিক করে নিতে হবে। এরপর শুরু পায়েচলা, আসল অ্যাডভেঞ্চার!
বগালেকের মতই হামমাম যাবার দুইটা পথ আছে, একটা প্রায় পুরোটাই ঝিরিপথ, আরেকটা প্রায় পুরোটাই পাহাড়ী। আমাদের গাইড শুরুতে ঝিরিপথ বেছে নিলেন। দুপুর বারোটায় হামমাম অভিমুখে যাত্রা শুরু হল। এবং যাত্রা শুরুতেই বিনা নোটিশে ঘনবন, সাথে গভীর কাদা। ডালপালা এতই ধারালো যে আমরা স্বেচ্ছায় পথের কাদায় পা ঢুকিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু ভুলেও গাছপালার কাছে যাচ্ছি না। আর ভাবছি কিং কোবরা কোথায়? বেশী ভাবতে হল না, সামনেই কাদাভরা ঝিরি পার হতে গিয়ে বুঝলাম - কিং কোবরার অনুপস্থিতিতেও সবাই সুস্থ সালামতে ফিরে আসতে পারলে সেটাই বেশ খুশীর ব্যাপার হবে। ঝিরিপথকে তো আগে কত ভালোবাসতাম, কিন্তু এত কাদা আর ঘোলা পানি দেখে শুরুতেই উচ্ছাস ঝিমিয়ে গেল।
তবে আস্তে ঝিরির রূপ বদলে গেল, কাদার বদলে পাথর শুরু হল, পানি পরিষ্কার হয়ে এল এবং আমরা......মাটি ছেড়ে পানি ঠেলে হাটা শুরু করলাম, বাকী প্রায় পুরোটাই। বুকপানি না হলেও কোথাও কোথাও মাজাপানি তো বটেই! ঝিরি রাস্তা বা পাহাড় কি তা জেনেশুনে রূপালি জুতা টাইপ কিছু না পরে কেডস পরে আসছি বলে নিজেকে গাল দিতেছি, জুতার ভেতরে পুরো অ্যাক্যুরিয়াম হয়ে আছে, খালি মাছ ছাড়া বাকী। অভি আর সজীব এর মধ্যে সাপ দেখে ফেলেছে। আর জোক জলেস্থলে সর্বত্র অদৃশ্যভাবে কিলবিল করছে, এ কথাটি যে জোক ছিল না তাও হাড়ে হাড়ে বুঝে ফেলেছি। যাহোক, এভাবে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় বেশ অনেকদূর চলে গেলাম, ঝিরিপথের কিছু বাঁক সত্যিই চমৎকার ছিল।
ঝর্ণা যখন পৌনে একঘন্টা দূরে, তখন দৃশ্যপটে পাহাড় এসে উদয় হলেন। তা এটাই বা বাকী থাকে কেন? প্রায় ৬০ডিগ্রি স্লপ বেয়ে উঠতে গিয়ে কারো কারো চিৎপটাং হবার দশা। পাহাড়টা ছোট, ২০০ ফিটের বেশী উচু না, কিন্তু সবসময় যা হয়, মনে হল কমসে-কম ১০০০ফিট উঠে গেছি! আর পাহাড়ি রাস্তায় জন্মে এত ঘনবন দেখি নাই, অডোমসের অভাব এই প্রথম অনুভব করলাম। উৎরাই বেশ খাড়া, গাছ ধরে নামতে হয়। এবং নামার পর প্রায় সবাই নিজ দেহে জোকের নীরব কিন্তু রক্তাক্ত অস্তিত্ব আবিষ্কার করল।
এরপর রাস্তা চমৎকার ও সহজ আধাঘন্টার ঝিরিপথ। ঝর্ণার কাছাকাছি এসে শব্দে টের পাওয়া যায় এসে গেছি, সারা গায়ে একটা শিহোরণ জাগে। তবে পানির তোড় কম দেখে একটু দমে গেছিলাম, ভেবেছিলাম এটা নাফাখুম থেকেও ছোট হবে। কিন্তু শেষ বাঁকটা ঘুরে...আহা!।...ঝুঁকি না নিলে কি কেষ্ট মেলে? মরি মরি!! হামমাম!
(চলবে)