somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুড়ে যাওয়া নগরেও থাকে কিছু জলরঙে আঁকতে না পারা কষ্ট

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবিতা হলো সেই নাচিয়ে যার পায়েলের শব্দে খুন হয় অজস্র প্রেমিক হৃদয়। কিংবা অ্যাকুরিয়ামের সেই মাছ যার লেজের নিকটে থাকে জীবনের সমস্ত রঙ; ঘুরেঘুরে সে খরচ করে ফেলে সবটুকু রঙ । কবিতা প্রেমিকগণ অ্যাকুরিয়ামের বাইরে থেকে অবলোকন করেন জীবনের এইসব দৃশ্যাবলী । সমস্ত রঙ খরচ হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার। মাহমুদ রাসেল এক সরল জিজ্ঞাসা দিয়ে তাঁর কবিতার অ্যাকুরিয়ামের দিকে আমাদের টেনে নেন-

'' যে পাখি উড়ে যায় , আকাশের চিবুক ছুঁয়ে - ছেড়ে দাও
বিস্বাদ জাগিয়ে রেখে মাটির কান্না কি থেমেছে কখনো ?
ধোঁয়ার ভেতর যে অবয়ব ফুটে ওঠে অনন্তকাল,
চেয়ে দেখো- তাঁর চোখে শ্বাস নেই; একফোঁটাও
জানোতো,
বেহিসাবী জীবনে যন্ত্রণা বলে কিছু থাকে না । '' ( অগোছালো আর্টিস্ট)

রাতভর জেগে জেগে আমরা যন্ত্রণার পাতা পোড়াই আর ধোঁয়ার ভেতর ছড়িয়ে দেই বিস্বাদলিপি। বস্তুত এইসব খামখেয়ালীপনাই জীবন । ফলে এই কবিতায় কবি অগোছালো আর্টিস্টের সমস্ত যন্ত্রণাকে সহসাই অস্বীকার করেন । তারপর তিনি মেতে উঠেন ভজন সঙ্গীতে । মেতে উঠেন প্রেমে । তাঁর কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হয় -

'' প্রতিটি চুমুর পর দৃশ্যতঃ আমরা সতেজ হয়ে উঠি
কী কেউ অবশ্য সংকুচিতও হয়; সলাজ লজ্জাবতী
প্রতিটি শ্বাস বিনিময়ে আমরা অসীম পুলক পাই,
ঝরঝরে রৌদ্র ভাসমান পিঠে পতঙের মতো উড়ি। '' ( ভজন সংগীত)

ঝরঝরে কথার পেরেকে আমরা গেঁথে নেই প্রেম এবং চুম্বন । সংকুচিত লজ্জাবতী গাছটিও জানে বাতাসের চুম্বন । জানে হৃদয়ের উত্তাপ। তবু দ্বিধার আকাশে কিছু মেঘ জমাট বেঁধে উড়াউড়ি করে । উড়তেই থাকে । মাহমুদ রাসেল মেঘের উপরে কল্পনার এক সুদৃশ্য বাড়ি বানান -

'' বাড়ি বানিয়ে রেখেছি মেঘের উপরে
আমার দোচালা ঘর , খড়ের মন্দির
পেছনে পরিত্যাক্ত ডোবা , শাপলা-শালুক সঙ্গম
সহস্র কুনোব্যাঙ , শরীরে শরীর উৎসব।''( দণ্ডপ্রাপ্তের পাণ্ডুলিপি)

কবি মাত্রই যেন কল্পনার আকাশ । যে আকাশে তিনি মুহুর্তেই বৃষ্টি নামান আবার পরক্ষণই ছেড়ে দেন কথার পায়রা । মাহমুদ রাসেলের কবিতার আকাশে হামেশাই জমাট বাঁধে অজস্র চিত্রকল্পের মেঘ । উড়ে উড়ে তিনি সেই মেঘের দেশ পেরিয়ে চলে যান অনেক উপরে। দক্ষ মিস্ত্রি হয়ে নির্মাণ করেন সুদৃশ্য কুটির । আর সেই কুটিরের আনাচে কানাচে এঁকে দেন শাপলা-শালুক কিংবা সহস্র কুনোব্যাঙ ।

কবিরা স্বভাবতই স্মৃতিপ্রবণ হয়ে থাকেন । বয়সের খোলস ছেড়ে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন অতীত আকাশে । মাহমুদ রাসেল যেন দুর আকাশের সেই চাঁদ , যিনি বসে থাকেন জোছনার ঝাপি খোলে -

'' কথার ঝাঁপি খোলে বসে থাকি
কৃত্তিম আলোয় আমরা বনবাস খাটি
ফেরে না শিমুল ডালে বেভোলা পাখি
রঙের সাথে তবে আপোষ করে কী লাভ ?'' (মলিন চশমা)

এইসব স্মৃতিপ্রবণ আকাশ হাতড়েই আমাদের বেঁচে থাকা । আমরা যখন খুব পুড়ে যাই ব্যথায় , খুব যন্ত্রণায় কাতর হই তখন এইসব স্মৃতিরাই একেকটা চাঁদ হয়ে আকাশে ওঠে। চাঁদের বুড়ির ন্যায় চরকায় সেলাই করে আমাদের সমস্ত দু:খলিপি।

রাসেল খুব বেশীক্ষণ স্মৃতিপ্রবন থাকেন না। তিনি জানেন জীবিকা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। তাই তো তিনি স্মৃতির আকাশ থেকে চাঁদ নামিয়ে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন বাস্তবতার মুখোমুখি । যেইখানে প্রতিটি কায়িক সকালে নেমে আসে প্রতিটি ব্যস্ততা। ক্যালেন্ডার থেকে শুক্র খুব দ্রুতই উধাও হয়ে যায় -

''শুক্র বিলীন হয়ে গেলে ভাসন্ত সকালগুলো
নিরুত্তর গোলাম শরীরে বাঁধে চাকার শেকল
বদ্ধ চাকচিক্যের ঘরে সুখ পায়রা উড়িয়ে
কুমোর হাতের ছাঁচে সভ্যতা গড়ে দেয়'' ( পোকাদের সৌধশেকল)

সভ্যতা মূলত মানুষের হাতেই গড়া । মানুষই এই সভ্যতার কুমোর। মানুষের হাতেই জেগে উঠে একেকটি মৃৎ-সকাল। নকশা করা সেইসব সকালপনার আড়ালে লুকিয়ে থাকে একেকটি ঘাম। একেকটি যন্ত্রণা।

যদিও মানুষ যন্ত্র না ! প্রতিটি মানব সন্তানের জীবনেই পিতা চরিত্রটির অবদান অনস্বীকার্য। পিতাই সন্তানের কানে প্রথম জপে দেন সফলতার মন্ত্র। পিতার ঘামের উপর দাঁড়িয়েই প্রতিটি স্বপ্ন কোলাহল করে। রাসেলও আমাদের সাথে শেয়ার করেন
অপূর্ণ সেইসব স্বপ্ন -

'' বাবাকে স্বপ্নে দেখি
সকালের আলোয় বাবা এসে বসেন
আমার পিঠ চুলকিয়ে আদর করেন ,
মাথায় হাত বুলিয়ে ,
বাবা বলেন - তোকে ডাক্তার বানাবো
আমি স্টেথোস্কোপ নিয়ে গম্ভীর হাঁটি,
আমার দৃষ্টি খোঁজে রোগাক্রান্ত সন্ধ্যার পাহাড়। '' ( বাবা )

আহা ! টেথোস্কোপ নিয়ে হেঁটে হেঁটে কবি খুঁজেন সন্ধ্যার রোগাক্রান্ত পাহাড় । বুকের ভেতর কেমন যেন নির্জনতার ঢেউ বয়ে যায়।এইসব চিত্রকল্পই মূলত মাহমুদ রাসেলকে আলাদা করে । হেঁটে হেঁটে তিনি মিশে যান হাহাকারের নানান রঙে। যে রঙের স্পর্শে তিনি খুন হন আর দেখতে পান একটা দেয়াল । দেয়ালের ভেতর নিজেরই লাশ -

'' দেয়ালের ভেতর ওটা আমারই লাশ
ভগ্নাংশ কিছু ছড়িয়ে গেছে হয়তো '' ( অদৃশ্য অবয়ব)

এইসব বিমূর্ত চিন্তা কি শুধুই কবিকে স্পর্শ করে, না পাঠক হৃদয়েও ছুঁয়ে যায় তার কিয়দাংশ? হয়তো ! আবার হয়তো না !

রাসেল জীবনকে দেখেন ভিন্নভিন্ন আঙ্গিক হতে । তাঁর রয়েছে অন্তঃশীলবাসী এক জোড়া চোখ। যে চোখ থেকে কাগজের জলশ্বাস বেরোয় । তিনি উচ্চারণ করেন -

'' কাগজের নৌকা খুলে যেতে দেখি
দ্বিমুখী ব্বায়বীয় চাপে, জলের ভ্যাবাচ্যাকা বোধ
বাতাসের কলিজাও ছিঁড়েফুঁড়ে খায়
ইস্পাত মিশে যায় মেরুর বরফে '' ( কাগজের জলশ্বাস)

জীবনকে তিনি ভাবেন কাগজের নৌকা । কখনো কখনো পারিপার্শ্বিকতার চাপে বিপর্যস্ত হয়ে উঠি আমরা। ব্যক্তি জীবনের এইসব ব্যর্থতা আমাদের কলিজাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায় । তারপরও আমরা থেমে থাকি না । ভালোবাসি । ভালোবাসাই। ভালোবাসা জমাই -

'' ভালোবাসা জমে জমে ক্ষীর হয়ে গেলে ভ্যাঁপসা গন্ধ বেরোয়'' ( ভ্যাঁপসা সময়)

অধিক ভালোবাসা অনেক সময় ছন্দপতন ঘটায় । জীবনকে বিপর্যস্তও করে । এইসব দ্বন্দ আর দ্বিধাই জীবন । আমরা ভালোবাসি। আবার ব্যর্থ হই।তবু রাসেল আমাদের ডাকেন ভালোবাসার দিকে। তিনি জীবনের শিরোনাম দেন ভালোবাসা । আর তিনি ভালোবাসাকে করে তুলেন শতবর্ষী সকল কবিতার শিরোনাম । তিনি জলকে অভিমান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নাবিক হৃদয়কে সিক্ত করতে বলেন ।

মাহমুদ রাসেলের কবিতার ভাষা একই সাথে গতিময় এবং দ্যুতিময় । যে কবিতার ভাষায় তিনি নিঃশ্বাসে নগর পুড়িয়ে ফেলেন । পুড়ে যাওয়া সেই নগরেও তবু থেকে যায় কিছু ছাইচাপা হাহাকার আর জলরঙে আঁকতে না পারা কষ্ট

বুক রিভিউ
কবিতার বইঃ নিঃশ্বাসে নগর পুড়ে যায়
কবিঃ মাহমুদ রাসেল
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×