বিজ্ঞানীরা প্রথমে কল্পনা করেন এবং কল্পনার ফানুস বানিয়ে ভেসে বেড়ান আবিষ্কারের রাজ্যে।
তারা এ কল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য বলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিনরাত নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য কাজ করে থাকেন। তাদের এসব আবিষ্কারের ফলে পৃথিবী এক স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে, বলতে গেলে পৃথিবীই একবারে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমরা হ্যালো বললে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে প্রতি উত্তর আসে হ্যালো। যে কোনো প্রান্তের খবর নিমিষেই ভেসে বেড়ায় ওয়েবসাইটে। এসব আবিষ্কারের পেছনে যেসব দেশের বিজ্ঞানীদের অবদান সবচেয়ে বেশি, আমেরিকা তাদের মধ্যে অন্যতম। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর
আমেরিকার সেরা দশ আবিষ্কার নিয়ে এবারের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন
জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু ও সোহরাব সুমন।
অভাবের জাদুর কাঠি দিয়ে চিরদিন মানুষ তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করেছে। এভাবে এসেছে নতুন নতুন সব আবিষ্কার এবং নতুন পণ্য। আজ আমরা মন্দাআক্রান্ত তথাকথিত যে সমৃদ্ধ আমেরিকা দেখছি তার সফলতার মূলেও ছিল এ অভাব বা প্রয়োজন। আর এ কারণেই দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বর্তমান মন্দার ভেতরও সেই একই আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন বলে সম্প্রতি তার এক ভাষণে ঘোষণা করেছেন।
ইতিহাসও কিন্তু সেই একই কথা বলে। বিশ্বকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে দেশটি আগাগোড়াই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে কথাটি আরো বেশি সত্য। আর এ নেতৃত্ব দেশটির অর্থনীতিকে করেছে কালোত্তীর্ণ। যুগোপযোগী নীতিমালা, শিক্ষা এবং বর্তমান মন্দা আবারো সেই অতীত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলবে বলে ওবামা আশা প্রকাশ করেছেন।
আমেরিকানদের এতোসব যুগোত্তীর্ণ আবিষ্কার দেখে মনে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক তাদের এ আবিষ্কারের নেশা কি মজ্জাগত?
চলুন এবার দেখে নেয়া যাক তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা। এদের মধ্যে কোনটির পর কোনটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন সে সিদ্ধান্ত কিন্তু পাঠককেই নিতে হবে।
১. মানুষের আকাশে ওড়া
পৃথিবীতে আর কোথাও বোধ হয় প্রযুক্তিতে দুই ভাইয়ের একসঙ্গে এতোবড় অবদান রাখা হয়নি। ওরভিল এবং উইলবার রাইট এ দুই ভাইয়ের উদ্ভাবনে পুরো বিশ্ব এখন একই সুতোয় গাঁথা। ১৯০৩ সালে মাত্র বারো সেকেন্ডের জন্য নর্থকেরলিনার লাল মাটি ছেড়ে প্রথমবারের মতো বাতাসের চেয়ে ভারি একটি আকাশযানের মাধ্যমে আকাশে ওড়া সফল হয়। উড্ডয়নে ব্যবহার করা বিমানটি সেই দুই ভাইয়েরই তৈরি করা। তারপর থেকেই মূলত সারাবিশ্ব আকাশযাত্রার যুগে প্রবেশ করে। এরপর মাটির মানুষকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২. এটম বোমা
সম্ভবত চাঁদের মাটিতে পা রাখার মতো আকর্ষণীয় না হলেও এর বিস্ফোরণের প্রভাব খুব কম লোকই অস্বীকার করতে পারবেন। নিউ মেক্সিকোর মরু প্রান্তরে ট্রিনিটি টেস্ট সাইটে ১৯৪৫ সালে প্রথম এটম বোমার পরীক্ষা করা হয়। এ রকম একটি সর্বগ্রাসী বোমা বানানোর জন্য বহু আগে শুরু হয় ম্যানহাটন প্রোজেক্ট। জার্মানির থার্ড রাইখের হাত থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন এমন অনেক গবেষক বিজ্ঞানী এখানে কাজ করেছেন।
৩. চাঁদের মাটিতে মানুষের পা
সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম মহাশূন্যে যাওয়ার গৌরব অর্জন করলেও চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখার কৃতিত্ব আমেরিকার। ১৯৬০ সালে আইসেনহাওয়ার সরকারের সময় নাসা অ্যাপোলো কর্মসূচি শুরু করে। দেশটি ১৯৬৯ সালে মানব জাতির কল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রথম একজন মানুষকে চাঁদে পাঠায়। নীল আমস্ট্রং সেই কল্পবিজ্ঞানের বাস্তব নায়ক ছিলেন। অভিযানটিতে আরো অংশ নেন মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন। বোধ হয় সেদিনের সে অভিযানের তুলনায় আজকের কোনো আবিষ্কারই এতোটা বিস্ময়কর নয়।
৪. লেজার প্রযুক্তি
লেজার প্রযুক্তিকে আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আবিষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর অনেক ব্যবহার সম্ভব। আর এগুলোর মাঝে বাণিজ্যিক প্রয়োগই বেশি। টাকার হিসেবে যা অযুত কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ১৯১৭ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথম লেজার সম্পর্কে ধারণা দিলেও ১৯৬০ সালের আগে তা আবিষ্কার সম্ভব হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণাগারে অক্লান্ত অনুসন্ধানের পর এ জাদুর কাঠি মানুষের হাতে ধরা দেয়। আজকে আমরা লেজারের কারণেই সিডি বা ডিভিডিতে যা ইচ্ছা তাই শুনতে বা দেখতে পাচ্ছি। সহজে জটিল সার্জারি করা এবং বারকোড পড়তে পারা যাচ্ছে। রক কনসার্টে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানিও কিন্তু এ লেজারেরই কারসাজি। ন্যানো টিউবের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে অচিরেই এটি আমাদের আরো কাছে চলে আসবে।
৫. ইন্টারনেট
অনেকেই ইন্টারনেট আবিষ্কারের কৃতিত্বের আংশিক দাবিদার থাকলেও ১৯৬০ সালে আমেরিকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এক অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে প্রযুক্তিটি প্রথম আলোর মুখ দেখে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউসিএলএ, সান্তা বারবারা, ইউনিভার্সিটি অফ উথাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি কম্পিউটার যুক্ত করে সামরিক গবেষণার জন্য আরপানেট (অজচঅহবঃ) তৈরি করা হয়। ১৯৭১ সালে এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রথম ই-মেইল বার্তাও আদান-প্রদান করেন। তারপর থেকে একে একে এর সঙ্গে সারাবিশ্ব যুক্ত হতে থাকে।
৬. এমআরআই বা চুম্বক অনুরণন ছবি
এমআরআই বা চুম্বক অনুরণন ছবি এর কারণে প্রতিদিন অসংখ্য লোক প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে। কোনোরকম ব্যথা ছাড়া শরীরের ভেতর দেখে নেয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় বহু লোকের জীবন বাঁচানো যাচ্ছে। রাইমন্ড ডেমেনিয়ন নামের একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী প্রথম আনবিক চুম্বক ছবির ধারণা দিয়ে পরিচিতি পান। এর মাধ্যমে নিরাপদে শরীরের ভেতরকার ছবি নিয়ে রোগ চিকিৎসার কথা তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম ব্যবহার উপযোগী এমআরআই মেশিন তৈরি হয়। তারপর থেকে ডাক্তাররা ছুরি-কাঁচি না চালিয়ে মানুষের শরীরের ভেতর দেখতে পাচ্ছেন।
৭. যোগাযোগ উপগ্রহ
পৃথিবীর প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ তৈরি করে আমেরিকান সেনাবাহিনী। ১৯৫৮ সালে প্রথম তা মহাশূন্যে পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের পাঠানো একটি বাণী এ সময় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। বাণীটি ছিল এরকম ‘বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির মাধ্যমে মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো একটি উপগ্রহ থেকে আমার কথা আপনাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।’ সেই থেকেই উপগ্রহ যোগাযোগ (স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন) প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হলো। টাকাও আসতে থাকে, বাড়তে থাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তৃৃতি।
৮. ট্রানজিস্টর
ট্রানজিস্টর ছাড়া ইলেকট্রনিক যুগের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। টেলিভিশন থেকে শুরু করে আজকের কম্পিউটার সবকিছুতে এ একটি আধা-পরিবাহী ব্যবহার হচ্ছে। তিনজনের একটি আমেরিকান দল তিন প্রান্তের ট্রানজিস্টর তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে এ ভুবন বিখ্যাত আবিষ্কারের জন্য তাদের সবাইকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
৯. অ্যাসেমবলি লাইন
আমেরিকান উদ্ভাবক হেরি ফোর্ড ১৯০৮ সালে স্বয়ংক্রিয় অ্যাসেমবলি লাইন আবিষ্কার করে কারখানার কাজ কারবারের ধরন একদম বদলে দেন। আমেরিকা গাড়ি আবিষ্কার না করলেও এর মাধ্যমে বড় ধরনের উৎপাদনে নামে। অনেক পণ্য উৎপাদন কারখানা লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। আর নিত্য ব্যবহারের অনেক পণ্য প্রথম মধ্যবিত্তের নাগালে আসে।
১০. বৈদ্যুতিক বাতি
টমাস আলভা এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতি সারাবিশ্বকে আলোকিত করে। ১৮৭৯ সালে নিউজার্সির গবেষণাগারের রাস্তা আলোকিত করার মধ্যদিয়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই মুহূর্তের শুরু। তারপর টানা একশ বছর তার এ বাতিই ছিল ভরসা। এরপর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদার কারণে সাশ্রয়ের প্রশ্নে নতুন ধরনের বাতির দরকার হয়। বাতি ছাড়াও এডিসনের পেটেন্ট করা প্রায় এগারোশটি আবিষ্কার রয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




