'কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ' গ্রন্থটির মুখবন্ধ
বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে বাংলাদেশের যাত্রাপথ ও তার পরিবর্তনের সম্ভাবনা অনুসন্ধানের লক্ষ্য নিয়েই এই গ্রন্থ পরিকল্পিত হয়েছিল। এর পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও অনেকখানি সেভাবেই লিখিত হয়েছে। যেহেতু এই গ্রন্থের রচনাকাল তিন বছর, সেহেতু এই সময়কালে সংঘটিত নানা ঘটনাবলি মূল তাত্ত্বিক কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বিভিন্ন পর্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অংশ হিসেবে। এই গ্রন্থ লেখার কাজ শুরু হল এমন সময়ে যখন একদিকে সরবে ইসলামপন্থী কিছু গোষ্ঠীর সহিংস তৎপরতা চলছে অন্যদিকে বাংলাদেশকে দাসত্বের নতুন নতুন শৃঙ্খলে আবদ্ধ করবার জন্য, সম্পদ দখল ও লুণ্ঠনের জন্য নানা চুক্তি সম্পাদন হচ্ছে নীরবে।
দৃশ্যপটের এই দুটি দিক গ্রন্থের বিভিন্ন পর্বে ঘুরে ঘুরে এসেছে। সে কারণে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তস্থ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কথিত সার্বভৌমত্ব নিয়েও এই গ্রন্থে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এই সার্বভৌমত্বের ক্ষয় ও সেই ধারার অন্যপিঠে এই দেশের মানুষ ও সম্পদের উপর আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজি ও তার প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন বিশ্বসংস্থা ও কতিপয় রাষ্ট্রের আধিপত্য বৃদ্ধি ও তার প্রভাব পরীক্ষা করা হয়েছে এই গ্রন্থের বিভিন্ন পর্বে। বৈশ্বিক রাজনীতি, আঞ্চলিক আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদী সম্পর্ক অতি অপরিহার্যভাবে বারবার এসেছে।
বাংলাদেশে সমাজ ও অর্থনীতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বিনিয়োগ ও উৎপাদন ক্ষেত্র, প্রযুক্তি, সম্পর্ক, অগ্রাধিকার, শ্রেণী বিন্যাস, লিঙ্গীয় সম্পর্ক এগুলোর মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন জৌলুস এনেছে, নারকীয়তাও এনেছে; আবার একই যাত্রায় উন্মোচিত হয়েছে মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার নতুন নতুন সম্ভাবনাও। নতুন উন্নয়ন দর্শনের চিন্তা ধামাচাপা পড়ে তথাকথিত 'দারিদ্র বিমোচন' নামাবলী গায়ে দেয়া অধিপতি উন্নয়ন চিন্তার দাপটে, যা কার্যত দারিদ্র ও বঞ্চনা সৃজন ও পুনরুৎপাদনের ব্যবস্থাকেই পাকাপোক্ত করে; লিঙ্গীয়, জাতিগত এবং শ্রেণীগত বৈষম্য ও নিপীড়নকে স্থায়ী করতে ব্রতী হয়। এই গ্রন্থ এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে উদ্যোগী হয় যে, দারিদ্র নয়, আমাদের প্রধান সমস্যা নিজেদের জীবন, প্রতিষ্ঠান ও সম্পদের উপর এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্তৃত্বের অভাব।
বাংলাদেশের জনচেতনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মৌলিকভাবে ভিন্ন দুই ধারার রাজনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং এই দুই ধারার আপাত বিরোধ অনেক বেশি মাত্রায় জনগণের বিভিন্ন পর্যায়ে সংক্রামিত। ‘সুশীল সমাজ’ নামে পরিচিত সুবিধাভোগী সমাজ এই বিরোধ নিরসনকে জাতীয় সমস্যা সমাধানের অন্যতম পথ বলে মানুষের সামনে উপস্থিত করে। এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে এই আপাত সত্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে সমাজ ও রাজনীতির ভেতরে তাদের নীতিগত ও শ্রেণীগত ঐক্যের উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। বিশ্লেষণে এসেছে এই দুই ধারার রাজনীতির তফাৎ আছে ঠিকই, কিন্তু জনগণের জীবন ও সম্পদ হরণ, নিপীড়ন বৈষম্য ও আধিপত্যের ব্যবস্থাবলি রক্ষা ও পুনরুৎপাদনে তাদের ঐক্যটাই মৌলিক। সামরিক বাহিনীর সমর্থনে যে সরকার বর্তমানে জরুরি অবস্থার আড়ালে দেশ শাসন করছে সেটি এই দলগুলোর বিরোধিতা করলেও যে নীতি এই পুরনো ঐক্যের ভিত্তি, সেই নীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা জোরদার করেছে।
এই বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে? গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ের বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট হবে যে, যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, যদি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকে তাহলে এই দেশ পরিণত হবে বিশ্ব ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এক নাটবল্টুতে; তার আড়ালে জনগণের জীবন ও সম্পদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে বহুজাতিক পুঁজি আর নানা চেহারার অধিপতি শক্তিসমূহ। তবে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ ইতিমধ্যে বার্তা দিয়েছেন যে তাঁরা জীবিত আছেন। সেই বার্তাই আমাদের নতুন যাত্রাপথ সৃষ্টির ভরসা দেয়।
একটি বাদে এই গ্রন্থের সবগুলো অধ্যায় প্রকাশিত হয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন দিগন্ত-তে। নারীর জগত লেখাটি প্রকাশিত হয় সুস্মিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত চন্দ্রাবতীতে। আমি তাঁদের এবং এই গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ায় সংহতি প্রকাশনকে ধন্যবাদ জানাই।
আনু মুহাম্মদ
অর্থনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৫:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




