দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
১৯৮৩ সালে এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর ২৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের জন্য এটা দুঃখের বিষয় যে, এই গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলি বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনও প্রাসঙ্গিক আছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিন্তু তাতে এই প্রাসঙ্গিকতার হেরফের হয়নি, প্রতিষ্ঠান যোগ বিয়োগ হয়েছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সংযোজন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পুঁজির সশস্ত্র ও নিরস্ত্র আগ্রাসন নিয়েছে নতুন মাত্রা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়ে এককেন্দ্রিক পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছে। তবে, আবার প্রতিরোধের নতুন ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছে এই সময়েই।
সেসময়ে এই গ্রন্থে বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানী ও বহুজাতিক সংস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। তা সেইসময় বাংলাদেশের জন্য সেভাবে প্রযোজ্য ছিল না। বাংলাদেশের বহুজাতিক সংস্থার কার্যক্রম তখন ছিল সীমিত, জ্বালানী সম্পদ তখনও ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্তৃত্বে। লক্ষ্যনীয় যে, জনগণের অলক্ষ্যে প্রতারণামূলকভাবে সেসময়ই বিশ্বব্যাংক ও এডিবি বাংলাদেশের জ্বালানী খাত নিয়ে 'সহযোগিতার’ নামে যে ‘গবেষণা’ সম্পাদন করে তার সুপারিশমালার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদ দখলে বহুজাতিক পুঁজির কার্যক্রম শুরু হয়। ৮০ দশকের শেষে বাংলাদেশকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করা হয় এবং জ্বালানী সম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকার নামে একদিকে বিভিন্ন গ্যাসব্লক উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেয়া শুরু হয় এবং অন্যদিকে ‘দক্ষতা’ ‘অর্থ অপচয়’ রোধের নামে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যেমন পেট্রোবাংলা বাপেক্সকে দুর্বল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে অর্থবরাদ্দ কমিয়ে, নিয়োগ বন্ধ রেখে, কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করে, দক্ষ জনশক্তির প্রতিষ্ঠান ত্যাগে উৎসাহিত করে, মেশিনপত্র অব্যবহারে নষ্ট করে পুরো প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করে ফেলা হয়। দেশিয় সংস্থা যে দামে গ্যাস উত্তোলন করতে সক্ষম ছিল তার তিনগুণ দামে ও বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার ফলে পেট্রোবাংলা ক্রমে লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর সমাধান হিসেবে বিশ্বব্যাংকের গ্যাসের দামবৃদ্ধির পরামর্শ এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই দামবৃদ্ধির অজুহাত ধরে আবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে বিদ্যুত ও অন্যান্য গ্যাসনির্ভর সামগ্রীর দাম। এগুলোই হল উন্নযন এর চিত্র। আবার বিভিন্ন গ্যাসব্লকে গ্যাসের পরিমাণ, উৎপাদন ব্যয়ে বড় বড় জালিয়াতিপূর্ন ঘটনা ঘটিয়ে এসব কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করে যার দায়ভার বাংলাদেশের জনগণের উপরই পড়ে। উপরন্ত বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদের উপর বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে দেশের প্রয়োজনের সাথে এর যোগান আর সম্পর্কিত নেই। পুরো বাংলাদেশই এখন তাদের হাতে জিম্মি। যেকোন সময়ে গ্যাস যোগান বন্ধ রেখে তারা বহুজাতিক পুঁজির অধিকতর আগ্রাসন নিশ্চিত করবার নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে চাপ দিতে সক্ষম। এবং সে অভিজ্ঞতা আমাদের ইতিমধ্যেই হয়েছে। আবার জনগণের প্রতিরোধের কারণে তারা তাদের অধিকতর লুন্ঠনমূলক সব পরিকল্পনা করতে পারেনি। এই বিষয়ে আমার গ্রন্থ বাংলাদেশের তেলগ্যাস কার সম্পদ কার বিপদ (২০০১) এবং উন্নযনের রাজনীতি (২০০৬) গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
গ্যাসব্লকগুলোর পাশাপাশি কয়লা সম্পদ দখলের জন্যও এখন নানাদিক থেকে চেষ্টা চলছে। ব্রিটিশ অস্ট্রোলিয়ান কোম্পানি এশিয়া এনার্জি এবং ভারতের টাটা কোম্পানি বাংলাদেশের দুটো বৃহৎ কয়লাখনি দখলের জন্য নানা উন্নয়ন প্রকল্প পাশ করতে ব্যস্ত। এশিয়া এনার্জির মানুস, বসতি, পরিবেশ বিধ্বংসী ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দিনাজপুরের চার থানা জুড়ে এক অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয় ২০০৬ সালের আগষ্ট মাসে। তাতে তিনজন শহীদ হন এবং বিশজন গুলিবিদ্ধসহ দুই শতাধিক আহত হন। এর ফলে বিগত সরকার জনগণের সাথে এক চুক্তি সম্পাদন করে অঙ্গীকার করে যে ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিল হবে এবং সারাদেশে আর কোথাও বিদেশি মালিকানায় উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লা খনি হবে না। এরপরও এই প্রকল্পসহ টাটার একইরকম প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নানা তৎপরতা চলছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য সবরকম চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্প এবং গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে আমার সামপ্রতিক ফুলবাড়ী কানসাট গার্মেন্টস গ্রন্থে।
এই গ্রন্থ যখন প্রকাশিত হয় তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নয়া উপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে সামরিক শাসন ব্যবহার করে, কীভাবে এসব দেশে তাদের ¯^v_© উপযোগী রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র ও কনসালট্যান্ট সমাজ তৈরি করে, পুষ্ট করে, ব্যবহার করে এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছিল। বাংলাদেশেও আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আরও আলোচনা আছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি: বাংলাদেশের দুই দশক (২০০১) গ্রন্থে। উন্নয়ন নামে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসুচি বাংলাদেশে কী পরিণতি নিয়ে এসেছে তা আমার অন্য দুটি গ্রন্থ বাংলাদেশের অর্থনীতি চালচিত্র (২০০২) ও বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিমুখ (২০০৫)এ উপস্থিত করা হয়েছে।
এই গ্রন্থ প্রকাশের সাত বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সোভিয়েত ব্লকের পতন হয় এবং পুঁজিবাদ আঞ্চলিক অর্থেই একটি একক বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট তারপর থেকেই একচেটিয়া দাপটের চেহারা নিয়েছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার উদ্ভব হয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এই ত্রয়ী বিশ্বব্যবস্থার অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র গঠন করে। গ্যাট চুক্তির মধ্য দিয়ে ৯০ দশকে পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ, আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজন অনেক বৃদ্ধি পায়। পুঁজির আঘাতে, চাপে, অব্যাহত সংস্কার কর্মসূচির কারণে খর্বিত হয় তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র-র অস্তিত্ব বিশ্বব্যবস্থার আঞ্চলিক শাখা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবার উপক্রম হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে এটি আরও বেশি সত্য, সেখানে শাসক শ্রেণী বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে নিজেদের ভিত্তি দাঁড় করতে ব্যর্থ, অনিচ্ছুক, আন্তর্জাতিক পুঁজির কমিশনভোগী হওয়াতে কিংবা তাদের ক্ষমতার আড়ালে আভ্যন্তরীণ লুন্ঠনের ভাগীদার হওয়াতেই তাদের বেশি আগ্রহ। এরফলে এসব রাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া কিংবা ৯০ দশক পর্যন্ত আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি একদিকে জনগণের জীবন ও সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির হিংস্র থাবার নীচে নিক্ষেপ করে, শিক্ষাস্বাস্থের জনপ্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় প্রত্যাহার করে এগুলোকে মুনাফার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, দেশের সকল নীতিমালা প্রণয়নের ভার অর্পণ করে বহুজাতিক পুঁজির ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে এবং অন্যদিকে এই একই রাষ্ট্র তার বলপ্রয়োগকারি সংস্থাসমূহের ক্ষমতা, পরিসর ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করে। কার্যত এই বলপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ আর জাতীয় সংস্থা নেই, আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনে এগুলো পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার এক একটি দেশিয় শাখায়। ঋণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক ‘শান্তি মিশন’ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই যোগসূত্র রক্ষা করা হয়েছে।
দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সশস্ত্র আগ্রাসন সম্পর্কে সেসময় এই গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে তথ্য উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উপস্থিত করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর মার্কিন এই সশস্ত্র আগ্রাসন লাগামছাড়া হয়ে যায়। তেলসম্পদের উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার এবং মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করবার জন্য ইরাকের উপর একটানা অবরোধ শেষে এককভাবে তার দখলের ঘটনা ঘটে। ২০০১ সালে রহস্যজনক টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পায়। আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অগ্রাসন, গণহত্যা ও দখলের ঘটনা উপনিবেশিকরণকে নতুনভাবে উপস্থিত করে। নতুন এই উপনিবেশিক কাঠামোতে ‘তেল কোম্পানির হামিদ কারজাই’ একটি শাসন ধরন উপস্থিত করছে। আমার বিশ্বায়নের বৈপরীত্য (২০০৩) এবং পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং অনুন্নত বিশ্ব (২য় সংস্করণ, ২০০৬) গ্রন্থদুটিতে বিশ্বায়নের সামপ্রতিক রূপ, আফগানিস্তান ও ইরাক অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অধিক বিশ্লেষণ আছে। এছাড়া বিশ্বসংস্থা ও বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ে একটি নতুন লেখা এই সংস্করণে সংযোজন করা হল।
পুঁজির আগ্রাসনের ধ্বংসাত্নক চেহারা যখন আরও বেশি খোলামেলা সেই সময়ে ৮০ ও ৯০ দশকে বিশ্বজুড়ে এনজিও কার্যক্রম অনেক বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, এই কার্যক্রম বস্তুত বেসরকারিকরণ কর্মসূচিরই একটি উদার পথ। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে এনজিওগুলোকে শরীক করার বাধ্যবাধকতা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও সংকুচিত করেছে এবং সেইস্থান নিয়েছে এনজিও বা তার আওতায় ব্যবসাযিক সংস্থা। ক্রমে এনজিওগুলোর মধ্যে মেরুকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ স্পষ্ট অবয়ব নেয় কর্পোরেট এনজিও হিসেবে কতিপয় সংস্থার আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। এগুলো এনজিও হিসেবে নানা সুবিধা নেয়, জনসেবার ছদ্মাবরণ রাখে কিন্তু কার্যত এগুলো এক একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ। ব্যাংকিং খাতের এনজিও হিসেবে যাকে উল্লেখ করা যায় সেই গ্রামীণ ব্যাংক এই বিষয়ে অগ্রণী। ৯০ দশকের মধ্যে এনজিও, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্প কনসালট্যান্সির সুবিধাভোগী একটি হৃষ্টপুষ্ট সিভিল সোসাইটিও গড়ে উঠে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংক তার উন্নয়ন মডেল পাকাপোক্ত করবার জন্য ৮০ দশকেই ‘রাষ্ট্র - বাজার- সিভিল সোসাইটি’ ত্রয়ীর সমাবেশ ঘটিয়ে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে এবং সেভাবে ‘সংস্কার’ কর্মসূচি চলছে। এনজিও খাতে শুরু থেকে এই পর্যায় পর্যন্ত নানাদিক বিশ্লেষণ আমার অন্য একটি গ্রন্থ বাংলাদেশে উন্নয়ন সংকট ও এনজিও মডেল (১৯৮৮, ২০০০) গ্রন্থটিতে আছে। এই সংস্করণে থাকছে ক্ষ্রদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিষয়ে একটি লেখা।
এই গ্রন্থে এশিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন-অনুন্নয়ন-দখল-লুন্ঠন-সম্পদ পাচারের অভিজ্ঞতা আলোচিত হয়েছে। গত দশ বছরে পরিস্থিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রথমত, আফ্রিকায় মার্কিন নেতৃত্ব্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের সামনে হুমকি হয়ে উপস্থিত হয়েছে চীন। দ্বিতীয়ত, কিউবা বিপ্লবের পর থেকে ৯০ দশকে বিভিন্ন উঠানামার মধ্য দিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার এক নতুন পর্বের শুরু হয়েছে। ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি সহ বিভিন্ন দেশ সাম্রাজ্যবাদী দখল ও উন্নয়ন প্রত্যাখ্যান করে উন্নয়নের কার্যকর পথ অনুসন্ধান করছে। সে পথের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে এসব দেশে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এর এজেন্ডা এখন প্রত্যাখ্যাত। এসব দেশের নতুন সরকার জনগণের শক্তির উপর ভরসা করে ভিন্ন কেন্দ্র দাঁড় করাতে সচেষ্ট। বস্তুত ল্যাটিন আমেরিকা এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক কেন্দ্রে। ল্যাটিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা বিস্তারিত আলোচসা আছে বিপ্লবের স্বপ্নভূমি কিউবা: বিশ্বায়িত পুঁজিবাদে ল্যাটিন আমেরিকা শিরোনামে আমার সমপ্রতি প্রকাশিত গ্রন্থে ।
এই গ্রন্থে ব্রাজিল ও ভারতকে উপসাম্রাজ্যবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ব্রাজিল সেই অবস্থান ত্যাগ করে ল্যাটিন আমেরিকার পরিবর্তিত বস্থার মধ্যে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনয়িনের পতনের পর ভারত এখন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার এই অঞ্চলের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চীনের বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভাব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র এখন পারমাণবিক সহযোগতার অংশীদার। ভারতকেন্দ্রিক বৃহৎ পুঁজি এখন বহুজাতিক সংস্থার রপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এখন এই অঞ্চলে ভারত কেন্দ্রিক পুঁজির অধিপত্য রক্ষাকেই তাদের এজেন্ডা হিসেবে বিবেচনা করছে।
মুহম্মদ ইউনুস, বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী আর আমাদের কনসালট্যান্ট বাহিনী আগামী ২৫/৩০ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র বিমোচনের কথা বলেন। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়নের জন্য পিআরএসপি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। বলেন বিদেশি বিনিয়োগ নামে কার্যত বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য নিশ্চিত করবার , দেশের সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেবার আর দেশের সকল খাত পুঁজির হস্তগত করবার কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিই দারিদ্র আর বঞ্চনা সৃষ্টির কর্মসূচি। আর এগুলো রেখে দারিদ্র বিমোচনের নামে ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও কর্মসূচির প্রতারণামূলক হট্টগোলও আমরা শুনেছি। বহুজাতিক কোম্পানির ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কম হলেও ল্যাটিন আমেরিকা এ ব্যাপারে বিস্তর জীবন সম্পদ দিয়ে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাংগঠনিক ধরনে সেখানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে তারপর শুরু হয়েছে উন্নয়নের ভিন্ন যাত্রা। আর বাংলাদেশে এখন আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা বা চিলির পরিত্যক্ত পথে যাত্রা শুরু করেছে।
একদিকে যখন সশস্ত্র আগ্রাসনের মাধ্যমে ইরাক বা আফগানিস্তান দখল হচ্ছে তখন অন্যদিকে শাসকশ্রেণীর গঠন, নৈরাজ্যিক স্ফীতি ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশে এই দখলকাজই সম্পন্ন হচ্ছে গোপন প্রকাশ্য চুক্তি কিংবা সিভিল অসিভিল যোগসূত্রে রাজনেতিক বিন্যাসে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সম্পদ, অর্থনীতি, রাজনীতির উপর আধিপত্য পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে এখন বহুবিধ সংস্কার কর্মসূচিও চলছে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র বিমোচনের জন্য ২৫/ ৩০ বছর দরকার নেই, আগামি দুই বছরের মধ্যে দারিদ্র আর বঞ্চনার ভয়াবহতা থেকে মানুষের মুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করা সম্ভব। আর দশ বছরের মধ্যে দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ তৈরি সম্ভব। আর তার জন্য দরকার হবে দারিদ্র বান্ধব ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে মুক্তির সামষ্টিক বোধ ও উদ্যোগ। যা ল্যাটিন আমেরিকা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা এর অভ্যুদয় দেখছি।
আনু মুহাম্মদ
................................
গ্রন্থটির সংহতিসংস্করণ বর্তমানে নিঃশেষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৩:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




