পশ্চিমের আকাশ লাল আলোয় ভাসিয়ে দিনের সূর্য অস্ত যায়। ডানা মেলে পাখিরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসে। ধীরে ধীরে শান্ত পায়ে অন্ধকার নামে চারদিকে, জীবনের বিচিত্র কলরোল-কোলাহল যায় থেমে। থামেনা শুধু সাগরের অশান্ত কল্লোল। এই যে বিশাল সাগর তা প্রাণেরও বিপুল ভান্ডার।
ডাঙার ওপর জীবজন্তু বাস করার মতো যতখানি জায়গা রয়েছে, সমুদ্রে রয়েছে তার চাইতে অন্তত তিন চার গুন বেশি জায়গা। সমুদ্রে নানা রকম প্রাণী বাস করে, একেবারে পানির ওপর থেকে গভীর তলা পর্যন্ত। সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে অতি ভয়াবহ হল দানবাকার স্কুইড।


পৃথীবিতে অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে এত বড়, এত দ্রুতগতি আর এমন মারাত্নক প্রাণী আর নেই। আকারে এরা কোন কোন টা তিমির সমান হয়। আর মরণপন যুদ্ধে প্রায় যে কোন সামুদ্রিক জীবকে হারিয়ে দিতে পারে। স্কুইড ও অক্টোপাসের মধ্যে একটা দিক দিয়ে মিল আছে। সে হল এদের অনেকগুলো করে নরম আঁকশির মত লম্বা পা রয়েছে। স্কুইডের শরীরটা টর্পেডোর মত, আর লেজের দিকটা তীরের মত সুচালো। অক্টোপাসরা স্কুইডের জ্ঞাতি ভাই হলেও তাদের শরীর টর্পেডোর মত নয়, কেমন ঝলমলে থলের মত। তাই তারা অত তাড়াতাড়ি চলাচল করতে পারে না। অক্টোপাসের চেহারা বীভৎস হলেও আসলে এরা ভীতু আর ঠান্ডা মেজাজের প্রাণী; সাধারণত মানুষ-জন দেখলেই পালিয়ে যায়।

শত্রুর হাত থেকে আত্নরক্ষার জন্য স্কুইড আর অক্টোপাস একরকম কালির মত জিনিস ছুড়ে দিয়ে তার আড়ালে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া এরা চোখের পলকে এদের চিত্র-বিচিত্র শরীরের রং পাল্টাতে পারে।ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া শক্ত হয়। সাগরে মেরুদন্ডী প্রাণিদের মধ্যে পড়ে হাজার হাজার রকমের মাছ। এক হাঙর মাছই আছে প্রায় আড়াইশো জাতের। হাঙর লম্বায় ছ ইঞ্চি থেকে পয়তাল্লিশ ফুট পর্যন্ত হয়। এদের দাঁত আর চোয়াল অত্যন্ত মজবুত। কিন্তু শরীরে কাঁটার বদলে রয়েছে শুধু নরম হাড়। হাঙরের মুখে করাতের দাঁতের মত ধারালো চার থেকে ছ পাটি দাঁত থাকে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এদের কোন বাছ-বিচার নেই। পানিতে অতি সামান্য পরিমাণে রক্তের নিশানা পেলে তারা খাবারের উল্লাসে একেবারে হন্যে হয়ে ওঠে। হাঙরের পেটে মানুষের হাত-পা, কাঠের টুকরো, কয়লার বস্তা, গরুর মাথার খুলি, টিনের কৌটা, ভাঙা এলার্ম ঘড়ি ইত্যাদি নানা ধরণের জিনিস পাওয়া গেছে।

হাঙরের এক জাত ভাই হল করাত মাছ। এরা লম্বায় সাধারণত ষোল ফুট পর্যন্ত হয়। বড় জাতের করাত মাছ লম্বায় হয় প্রায় বাইশ ফুট, আর তার নাকের সামনে দু ধারে দাঁত বসানো করাতটা লম্বায় হয় ছ ফুট পর্যন্ত।
এমনি আর এক মাছ হল ‘রে’। এরা এমন চ্যাপ্টা চেহারার যে এদের দেখলে মাছ মনে না হয়ে বরং বিশাল প্রজাপতি বা বাদুড়ের কথা মনে হবে। দুপাশের পাখনা চওড়া হতে হতে পাখায় পরিণত হয়েছে। এরা যখন বিরাট বিরাট পাখা দুলিয়ে পানিতে সাঁতরায় তখন মনে হয় যেন পাখি উড়ছে। দিনের বেলা এরা পানির তলায় কাদায় গা ঢাকা দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমোয়, রাতে শিকার ধরতে বেরোয়।
বিজলি রে বা টর্পেডো লম্বায় ছ ফুট আর দুশ পাউন্ড পর্যন্ত ভারি হয়। এদের দুপাশের পাখায় থাকে দুটো বিজলি তৈরির ব্যাটারি। কোন কোন রে শক্তিশালী বিজলি তৈরি করতে পারে যা একজন মানুষ বা একটা বেশ বড় মাছকে কুপোকাত করবার পক্ষে যথেষ্ট।

সাগরে সবচাইতে দ্রুতগামী প্রাণী হল টুনা মাছ। টুনা মাছ ঘন্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইল পর্যন্ত ছুটতে পারে। কোন কোন টুনা লম্বায় হয় চৌদ্দ ফুট আর ওজনে প্রায় বিশ মণ।

টুনা মাছের জাতভাই হল তলোয়ার মাছ। সব গরম দেশের সমুদ্রে এরা ঘুরে বেড়ায়। লম্বায় এরা আঠারো ফুটের ওপর আর ওজনে সাতাশ মণের ওপর ভারি হয়। শক্ত কাঁটাওয়ালা এত বড় মাছ আর নেই। অনেক সময় এরা লম্বা ধারালো তলোয়ার বিঁধিয়ে মাঝারি আকারের নৌকা ডুবিয়ে দিতে পারে।

সাগরের সবচাইতে বড় প্রাণী হল নীলতিমি। তিমি আছে প্রায় একশ জাতের। কোন কন জাত চার-পাঁচ ফুটের চেয়ে বড় হয় না। এর মধ্যে শুশুক জাতীয় প্রাণিরাও পড়ে। কিন্তু নীল তিমির কথা আলাদা। এর এক একটা লম্বায় হয় প্রায় এক শ ফুট পর্যন্ত। আর ওজন? তাও এক শ দেড়শ টন।
তিমি পানিতে থাকে বলে সচরাচর লোকে একে বলে মাছ। কিন্তু আসলে এরা স্তন্যপায়ী। মাছের মত তিমি ডিম পাড়ে না; আস্ত বাচ্চার জন্ম দেয়, আর তাকে দুধ খাইয়ে বড় করে।

পানির তিন হাজার থেকে দশ হাজার ফুট নিচে দেখা যায় এক ধরনের ভয়ংকর অক্টোপাস। কালির মত কালো এদের দেহ, সাদা হাতির দাঁতের মত চোয়াল, রক্তের মত লাল বিশাল এদের চোখ। এদের দশটা করে পা কালো জাল দিয়ে জোড়া লাগানো।

সাগরের তলায় যেমন আলোর অভাব তেমনি অভাব খাবারের। কাজেই অধিকাংশ প্রাণীর সেখানে রাক্ষুসে খিদে। কোন কোন জীবজন্তুর এমন বিরাট হা যে তারা নিজের চেয়েও বড় আকারের মাছ গিলে খেয়ে ফেলতে পারে।
তিন-পা ওয়ালা মাছ থাকতে পারে এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু কোন কোন মাছের পেছনের দুটো পাখনা আর লেজ সত্যি সত্যি চেহারা পালটে লম্বা লম্বা পায়ে পরিণত হয়েছে। শিকার ধরার জন্য এরা সাগরের তলায় তিন পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
গভীর সমুদ্রের মধ্যকার মাছেরা হয় অন্ধ, আর নইলে তাদের থাকে বিশাল চোখ। অনেকে নিজেরা আলো তৈরি করে সে আলো জ্বালে আর নেভায়। কোন কোন মাছ শব্দও করে।
সমুদ্রের দুহাজার থেকে তিন হাজার গভীরতায় বেশীর ভাগ মাছই আলো তৈরি করতে পারে। এর চেয়ে আরো প্রায় দুহাজার ফুট নিচে পর্যন্ত এমনি আলো দেওয়া মাছ দেখতে পাওয়া যায়। নিচের দিকে আলো কম বলে সেখানে মাছেদের চোখ বড় হতে হতে, হয়ে দাঁড়ায় বিশাল। কোন কোন মাছের চোখ আবার দেখার সুবিধার জন্য মাথার কোটর থেকে অনেক খানি বাইরে বেরিয়ে আসে।

গভীর সাগরের তলায় মাছেরা কী করে এমন উজ্জ্বল আলো তৈরি করে এটা বিজ্ঞানীদের কাছে এক রহস্য। কোন কোন মাছ এত উজ্জ্বল আলো তৈরি করে যে, তাতে কাছে বই রেখে পড়া যায়।