সারা দেশে বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। যে হারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে, সেই হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সময়মতো মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়া। তাই চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে গঠিত হচ্ছে পুলিশের আলাদা তদন্ত সংস্থা। এরই মধ্যে 'পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন' (পিবিআই) নামে সংস্থাটির অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
পুলিশ ও আইনজীবীদের মতে, এ সংস্থা গঠিত হলে পুলিশের কাজে গতিশীলতা আসবে। তবে আইনজীবীরা মনে করেন, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দিলে এ সংস্থা গঠন কোনো কাজেই আসবে না।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন পিবিআইয়ের অনুমোদনের বিষয়টি। তিনি বলেন, 'এটি পুলিশের অধীনেই একটি আলাদা বাহিনী হবে। এই বাহিনীর কাজ হবে শুধু মামলার তদন্ত করা।' তিনি আরো বলেন, দেশের সব কটি বিভাগীয় শহর, মহানগর ও তৃণমূল পর্যায়ে তদন্ত সংস্থা কাজ করবে। এতে পুলিশের কাজে আরো গতিশীলতা আসবে বলে আইজিপি মনে করেন।
পিবিআইয়ের প্রস্তাব : দেশের নিম্ন আদালতে ২০১০ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ফৌজদারি মামলার ৭৬ শতাংশই সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে টেকেনি। তাই অনেক আসামি খালাস পেয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর পুলিশের কাছে আসে। দীর্ঘ সময় ধরে মামলা তদন্তের কারণে ঘটনার সাক্ষীরা তাদের ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলে। এ কারণে বেশির ভাগ মামলায় সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে 'পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন' (পিবিআই) নামে একটি পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন। এরপরই নীতিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করা হয়।
জানা যায়, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পিবিআই গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে নীতিমালা তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। একজন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির নীতিমালা তৈরি করা হয়। শুরুর দিকে তদন্ত সংস্থা গঠনের জন্য দুটি নাম চিন্তা করা হয়। একটি 'পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন', অন্যটি হলো 'ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন'।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, এ উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বাধা আসতে থাকে। ফলে আলাদা বিভাগ না করে সিআইডির ভেতরেই 'ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন' বিভাগ চালু করার চিন্তা করা হয়। কিন্তু গঠিত কমিটি শেষ পর্যন্ত আলাদা তদন্ত সংস্থা গঠনের পক্ষেই মত দেয়।
জানা গেছে, কমিটির সুপারিশ প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠালে প্রধানমন্ত্রী পিবিআই গঠনে অনুমোদন দেন। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ মাসেই সরকারি অনুমোদনের কথা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সকে জানায়। শিগগিরই এ সংস্থায় লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান।
কারা থাকবে: প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এ সংস্থায় পুলিশ কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসার নিয়োগের চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী বিসিএস কর্মকর্তাদেরও অনুমোদন দেন। এখন পর্যন্ত নতুন এ সংস্থায় ৬৭৬ জন বিসিএস অফিসার নিয়োগের বিষয় অনুমোদন পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। নতুন এ সংস্থায় একজন ডিআইজি পদবির কর্মকর্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পিবিআইয়ের অধীনে গোটা দেশকে সাতটি বিভাগ ও ছয়টি মহানগরে ভাগ করা হচ্ছে। পিবিআইয়ের প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে পুলিশ সুপার এবং প্রতি জেলায় একজন করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে থাকবেন না, সংস্থা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এ সংস্থা থানায় দায়ের করা সব নিয়মিত মামলার তদন্ত, তল্লাশি, গ্রেপ্তার ও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করবে। আর থানাগুলো এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, মামলা দায়েরসহ অন্যান্য কাজ করবে।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ তদন্ত ইউনিট গঠন করলে মামলার সাজার হার অনেক বেড়ে যাবে। আর অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) তাদের তফসিলভুক্ত অপরাধই তদন্ত করবে।'
কত মামলা তদন্ত : পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর গড়ে সারা দেশে এক লাখ ৬০ হাজার মামলা হয়। এই মামলার মধ্যে চাঞ্চল্যকর মামলাসহ হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই মামলাগুলোর তদন্তসহ পর্যায়ক্রমে প্রতিবছর ৭০ হাজার মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাবে পিবিআই।
উল্লেখ্য, সিআইডিকে বর্তমানে ৩৫ হাজার মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা মাত্র এক হাজার ৫০০ মামলার তদন্ত শেষ করতে পারে। বাকিগুলোর তদন্ত ঝুলে থাকে দিনের পর দিন।
ঢাকা মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. আবদুল্লাহ আবু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সুষ্ঠু তদন্তের জন্য এমন একটি সংস্থার প্রয়োজন। দক্ষ, অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এই সংস্থায় নিয়োগ দেওয়া হলে অবশ্যই মামলার তদন্ত সুষ্ঠু হবে।'
ব্যারিস্টার মুশফিকুল হুদা বলেন, 'পিবিআই গঠন সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। অনেক আগেই এটা হওয়া উচিত ছিল। সাক্ষীর সাক্ষ্যকে বিশ্লেষণ করা বর্তমানে সম্ভব হয় না। আলাদা তদন্ত সংস্থা হলে যারা তদন্ত করবে তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হবে। আর এ জন্য প্রকৃত অপরাধীদের দায়ের করা মামলায় সাজা দেওয়া সম্ভব হবে।'
ব্যারিস্টার মুশফিক বলেন, পিবিআইয়ে যাদের নিয়োগ করা হবে তাদের সৎ হতে হবে। যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মামলার কার্যক্রম, তদন্ত সংক্রান্ত বিধিবিধান ও বিভিন্ন আইন সম্পর্কে চৌকস করে তুলতে হবে। প্রাথমিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে তদন্ত সংস্থায় নিয়োগ দিতে হবে। না হলে এই সংস্থাকে মুখথুবড়ে পড়তে হবে। তিনি আরো বলেন, তদন্ত সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করারও সুযোগ দিতে হবে।
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




