পূর্বের পর্ব:
সামুপাগলার প্রথম প্রাণী ব্লগ: কিছু কথা কিছু ছবি - ৫ টি রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনাপূর্ণ জীবন মরণ লড়াই!
১) গ্রেট হর্নবিলস/রাজ ধনেশ!
গ্রেট হর্নবিলসরা মনোগামাস হয় মানে একের অধিক সঙ্গী রাখেনা। এদেরকে সাধারণত সাউথ ইস্ট এশিয়ায় পাওয়া যায়, এবং ৫০ বছরের মতো সময় বাঁচে। ওদের প্রশস্ত ডানা ঝাপটানোর শব্দ অনেক দূর থেকেও একজন মানুষ শুনতে পারে। ৫ বছর বয়সে ওরা ম্যাচিউর হয়, তখন থেকেই সঙ্গীনি খোঁজা শুরু করে দেয়। মেল হর্নবিলসরা ভীষন রোমান্টিক এবং প্রেমিকার মন জয় করার জন্যে প্রাণপন চেষ্টায় থাকে। পছন্দের মেয়েটির সামনে একের পর এক উপহার রাখতে থাকে। খাবার (মৃত শিকার, ফল), ডাল ইত্যাদি ততক্ষন পর্যন্ত দিতে থাকে যতক্ষন না পর্যন্ত মেয়েটি উপহার গ্রহণ করে! মেয়ে হর্নবিলসরাও কম রোম্যান্টিক নয়! অনেকের কাছ থেকে উপহার পেলেও, তারা শুধুমাত্র পছন্দের ছেলেটিরই উপহার গ্রহণ করে এবং তারপরে সারাজীবনে আর কারো উপহার নেয়না! আমৃত্যু একসাথে থাকে।
প্রেম হয়ে যাবার পরে, ওরা ঘর বাঁধে বড় কোন গাছের মাঝে। একসময়ে মেয়ে ধনেশটি ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। ঘরে প্রবেশের ফাঁকা জায়গাটিও বন্ধ করে দেয়! সেই দুমাস পুরুষ সঙ্গীটি একাই খাবারের ব্যবস্থা করে নিজের পরিবারের জন্যে। পুরুষটি লম্বা ঠোঁট ব্যবহার করে ঘরের ফাঁক দিয়ে খুঁজে আনা খাবার পৌঁছে দেয় নিজের সন্তানের মায়ের ঠোঁটে। যখন বাচ্চারা বড় হতে থাকে, তখন মা ও বাবা দুজনে মিলে বাচ্চাদের জন্যে খাবার আনার জন্যে বের হয়ে পড়ে।
২) সি হর্সেস/সামুদ্রিক ঘোড়া/সিন্ধুঘোটক!
ঘোড়ার মতো দেখতে এই সামুদ্রিক প্রাণীগুলোও মনোগামাস। প্রতি সকালে ওরা একে অপরকে গ্রিট করে - নাহ গুড মর্নিং বলে নয় অবশ্যই - তার চেয়েও অনেক সুন্দর ভাবে। ওরা একসাথে নাচে এবং সেসময়ে একে অপরের লেজ স্পর্শ করে, রং বদলায়। মজার ব্যাপার হলো, পুরুষ সি হর্সরা প্রেগন্যান্ট হয় এবং সেই প্রেগন্যান্সি পিরিওডে নারী সঙ্গীটি খেয়াল রাখে নিজের পার্টনারের!
এদের প্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধহয় এটাই যে ওরা দুঃসময়েও সঙ্গীকে ছেড়ে যায়না। কোন কারণে যদি পুরুষটি আহত হয় এবং সেসময়ে সন্তান দিতে অসক্ষম হয়, তাহলে নারীটি তাকে ছেড়ে যায়না। বরং ততদিন পর্যন্ত সেবা করতে থাকে যতদিন পর্যন্ত তারা সুস্থ হয়।
যারা যারা ভাবছেন এ আর এমন কি!? এটাই তো স্বাভাবিক। তাদেরকে বলি, আস্তে চলার কারণে ওরা খুব দ্রুত ধরা পরে শিকারীর হাতে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটাই উপায়, নিজের জিনস আগত জেনারেশনের মধ্যে দেওয়া। যে পার্টনার রিপ্রোডাকশনে সক্ষম নয়, তার পাশে থাকা মূলত নিজের পুরো জাতটাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়া! কিন্তু প্রেমিকার হৃদয় কবে কোন যুক্তি মেনেছে?
৩) প্রেইরি ভোল!
ভোল হল ইঁদুরের একটি রিলেটিভ প্রজাতি। প্রেইরি ভোলদেরকে সেন্ট্রাল নর্থ আমেরিকায় দেখা যায়। মেল ভোলরা আয়েশ করে মনের মানুষ খোঁজে না। বরং যেকোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা করে। এর কারণ, যতদিন না সম্পর্ক এবং মেলামেশা হয় ওরা পার্থক্য করতে পারেনা কোনটি নিজের পার্টনার এবং কোনটি অন্য কোন মেয়ে ভোল! মানুষদের মধ্যে জমজদের মধ্যে যা হয় আরকি। কিন্তু সম্পর্ক হবার পরে ওরা পার্থক্য করতে পারে - গন্ধ, ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে। তখন ওরা ডিভোটেড প্রেমিক হয়ে যায়। ব্যাপারটা সেটেলড ম্যারেজের মতো অনেকটা, নয়?
সম্পর্ক হয়ে যাবার পরে দুজনে এক ঘরে থাকা শুরু করে এবং সারাজীবন একসাথেই থাকে। মেল ভোলরা যেমন প্রেমিক তেমনই যোদ্ধা! নিজের সঙ্গীনি এবং সন্তানদের রক্ষার জন্যে নিজের এলাকায় চিহ্ন আঁকে এবং পাহাড়া দেয়। যদি অন্য কোন ভোল বিশেষত ফিমেল ভোল তার এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করে, তাহলে নিজের দাঁতে দাঁত ঘষে/বাহু তুলে তাদেরকে হুমকি দেয়। তাতে কাজ না হলে আক্রমণ করে। মেল এবং ফিমেল প্রেইরি ভোল কাপলরা মাঝেমাঝেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকে উষ্ণতার জন্যে।
৪) বাটারফ্লাই ফিশ!
এই সুন্দর মাছগুলোকে কেন প্রজাপতি বলা হয় তা নিশ্চই ছবি দেখেই বুঝতে পারছেন!? শুধু সৌন্দর্যেই নয়, প্রেমেও তারা অন্য অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর চেয়ে এগিয়ে। ওরা একাই থাকে যতদিন না পর্যন্ত সেই পারফেক্ট সোলমেটকে পায়, আর একবার পেয়ে গেলে তাদের সাথেই সারাজীবন মানে প্রায় সাত-দশ বছরের মতো সময় কাটিয়ে দেয়! বাটারফ্লাই ফিশেরা সবসময় জোড়ায় জোড়ায় সিংক্রোনাইজ করে সাঁতরে বেড়ায় এবং অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য তৈরি করে। হলুদ, কালো ও সাদা রং এর পোশাকে, নেচে বেড়ায় নীল সমুদ্রের পানির মাঝে দুটো প্রেমে পাগল প্রজাপতি!
শুধু যে রোম্যান্সের জন্যেই ওরা একসাথে থাকে তা কিন্তু নয়। বিপদজনক সমুদ্রের কোণায় কোণায় প্রতি মুহূর্তে শিকার ও শিকারীর জীবন মরণ খেলা চলতে থাকে। সেখাকে একজন সঙ্গী থাকলে সার্ভাইব করা সহজ হয়ে যায়। বাটারফ্লাই ফিশদের খাদ্য হচ্ছে ছোট ছোট কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি। কিন্তু এই শিকারগুলো প্রবাল প্রাচীরের ছিদ্রে লুকিয়ে থাকে এবং দু জোড়া চোখ থাকলে খুঁজতে সুবিধা হয়। শিকারের পরে একজন যখন খেতে থাকে অন্যজন চারিপাশে চোখ রাখে - কোন শিকারকে দেখলেই একজন আরেকজনকে সিগন্যাল দেয় এবং পালিয়ে যায় দুজনে মিলে। তবে এদের ভালোবাসা শুধুই স্বার্থের জন্যে তৈরী হয়না।
যদি কোনদিন এরা আলাদা হয়ে যায় তাহলে প্রবাল প্রাচীরের একেবারে মাথায় উঠে ভালোবাসার মাছটিকে খুঁজতে শুরু করে দেয় যদিও এতে মৃত্যুর আশংকা থাকে!
৫) লাভবার্ড!
আই সেভড দ্যা বেস্ট ফর দ্যা লাস্ট! প্রেমের কথা হচ্ছে, সেই প্রানীটিকে আনব না যার নামের মধ্যেই প্রেম আছে? লাভবার্ড! রোম্যান্টিক মানব কাপল দেখলেও আমরা বলি, "দেখো দেখো একেবারে লাভবার্ড!" কখনো কৌতুহল হয়েছে কেন ওদের এমন নামকরণ, কিভাবে ভালোবাসার প্রতীক হয়েছে ওরা?
ওরা যে মনোগামাস সেটা আলাদা করে বলার কিছু নেই। সারাক্ষন জোড়ায় জোড়ায় গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোকে দেখলেই বোঝা যায় সেটা। ১০-১৫ বছরের ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা জীবন ওদের। মাত্র ২ মাস বয়স থেকেই সঙ্গী খোঁজা শুরু করে দেয়। মেয়ে পাখিগুলো নিজের পালক ঝাঁকিয়ে পুরুষ পাখিকে আকৃষ্ট করে। পুরুষ পাখিটি সুন্দর করে মাথা ওপর নিচ করে নাচের মাধ্যমে জবাব দেয়। একবার প্রেম হয়ে গেলে এদের আর আলাদা দেখা যায়না। সারাক্ষন একসাথে বসে থাকে এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।
ওরা একসাথে থাকার বাহানা করেনা, বরং একসাথে থাকাকেই নিত্যদিনের নিয়ম বানিয়ে ফেলে। দুজনে মিলে খাবার খুঁজতে যায় এবং বাচ্চাদের খেয়াল রাখে। এদের এমন জোড় দেখে গ্রীকদের তীব্র বিশ্বাস ছিল যে একজন মারা গেলে অন্য সঙ্গীও মারা যাবে। যদিও সেটা সবসময় সত্যি নয়, অনেকেই শোকটি সামলে নেয়। তবে হ্যাঁ, এটা দেখে গিয়েছে যে কিছুক্ষেত্রে, সঙ্গী মারা গেলে কিছুদিন পরে হুট করে অন্য পাখিটিও মারা যায়। কোন পূর্ব অসুস্থতা বা শিকারীর কারণে নয়। মানসিক কষ্টে না খেয়ে থাকা এবং এক কোণে বসে থাকা, সোশালাইজ না করার কারণে একা লাভবার্ডটি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে ধীরে ধীরে।
শেষ কথা:
ছোটছোট প্রাণী হয়েও ওদের মধ্যে কত ভালোবাসা! আর আমরা মানুষেরা - সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও কি করছি? প্রেমে ধোঁকা দিয়ে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে হুমকি দিচ্ছেন স্বামীরা যে কন্যা সন্তান হলে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন! অনেক নারী পরকীয়া এবং মেন্টাল এবিউজের মাধ্যমে শেষ করে দিচ্ছেন পুরুষটির জীবন! যৌতুকের দায়ে হত্যা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। সামর্থ্যের বেশি চেয়ে স্বামীকে বারবার অপমান করে, অনেকে ডিভোর্সের পথে হাঁটছেন! যা যা বললাম তার সব যে পেপারে পড়েছি তা নয়, নিজের পরিচিতদের এসবের মধ্যে দিয়ে যেতেও দেখেছি!
কেন এতকিছু? সত্যিই কি কোন দরকার আছে এক জীবনে নিজের জীবন সাথীকে এত কষ্ট দেবার? কিসের এত ইগো/জেদ/রাগ/অভিমান? এই প্রাণীগুলোর কাছ থেকে কিছু শিখুন এবং সবার আগে নিজের পাশের মানুষটিকে ভালো রাখুন। সে ভালো না থাকলে কিন্তু আপনিও ভালো থাকবেন না। বৃদ্ধ বয়সে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সন্তান কেউ কাছে থাকবেনা - ঔষুধটা এগিয়ে দেবেনা, নকল দাঁত/চশমা খুঁজে দেবে না, ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিগুলো নিয়ে গুটুর গুটুর গল্প করবেনা। শুধু এটুকু মনে রাখবেন, তাহলেই বিনা কারণে "ব্রেকআপ/ডিভোর্স" শব্দগুলো মুখ থেকে বেড়োবে না। ভালোবাসার পোস্টটি সবাইকে ভালোবাসা জানিয়ে শেষ করছি।
ছবি ও তথ্যসূত্র: অন্তর্জালের অলিগলি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৮:১৮