somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ংকর ঠগী (দ্বিতীয় পর্ব)

৩১ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রথম পর্ব



কারা ঠগী?

বাংলা অভিধানে ঠগী বলতে বোঝায়, বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগী বলতে আরও বোঝায়- ঠগীর কার্য, দস্যুবৃত্তি। ঠগী শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ, ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সূত্রে যে সকল শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে Thud(থাড) তাদের একটি। শব্দটির মানে, ধপ করে পড়া বা আঘাত করা। এই শব্দটি সংস্কৃত ঠগী শব্দ থেকে এসেছে।

ঠগীরা তেরো শতক থেকে উনিশ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তৎকালীন প্রচলিত অস্ত্রসস্ত্র তীর-ধনুক কিংবা লাঠি-বল্লম নয়, আগ্নেয়াস্ত্র তো নয়ই; অস্ত্র বলতে শুধু একটি হলুদ রঙের সাদামাটা রুমাল। রুমালটি ভাঁজ করার পর তার দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট আর অন্যদিকে একটি রুপোর টাকা কিংবা দুটো তামার আধুলি বাঁধা থাকত। এই অস্ত্র দিয়েই ওরা হাজার হাজার নিরীহ পথচারী, বণিক, তীর্থযাত্রীকে মেরে ফেলে তার সর্বস্ব লুঠ করে মাটিতে পুঁতে দিত। ঠগীদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে । রাজ্যের নানা স্থানে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার করার সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায় । কর্তৃপক্ষ প্রথম প্রথম বিষয়টি আমলে নেয়নি, ভেবেছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ১৮১২ সালের দিকে গঙ্গার ধারে একটি গণকবরে একত্রে প্রায় ৫০ টি মৃতদেহ পাওয়া যায় । গনকবরটি পরীক্ষা করে দেখা গেল যে মৃতদেহগুলি যাতে ভালো করে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সেজন্য অত্যন্ত সচেতনভাবে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, হাড়ের সন্ধিস্থলগুলি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, যাতে করে পচন প্রক্রিয়াটি তরান্বিত হয় ও কবর ফুলে না ওঠে এবং মৃতদেহগুলি শেয়ালে না খায়।

এসব বিচারবিশ্লেষন করে ব্রিটিশ তদন্ত দল ও কর্তৃপক্ষ অনুমান করে গনহত্যার পিছনে রয়েছে একদল সঙ্গবদ্ধ খুনী। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ঠগী নামে খুনে এক গোষ্ঠীর কথা। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারপর সময় সুযোগমতো পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। এরপর গোপনে মৃতদেহ সমাহিত করে। যে কারণে কেউ ঠগীদের আক্রমনে মারা গেলে বিষয়টি অজানা থেকে যেত। লোকে ভাবত হতভাগ্য লোকটি পথিমধ্যে জন্তুজানোয়ারের আক্রমনের শিকার হয়েছে। কিন্তু যখন বৃটিশ পর্যটক নিখোঁজ হতে শুরু করে তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে ও তদন্ত শুরু হয়। জানা যায় হত্যাকারীরা একটি কালীউপাসক গোষ্ঠী। বাংলার ঠগীরা কালীকে ভবানী বলত। তবে ঠগীরা কেবল সনাতন ধর্মেরই অনুসারী নয়, এদের মধ্যে মুসলিম ও শিখও ছিল!

ঠগীরা বংশপরম্পরায় খুন ও দস্যুবৃত্তি করত। ছোটবেলা থেকেই ঠগীরা শিখত কীভাবে শ্বাসরোধ করে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে হয়। বংশপরম্পরা বা শিক্ষানবিশির মাধ্যমে দলে সদস্যদের নেয়া হত। ঠগী বালকের শিক্ষা শুরু হত দশ বছর বয়সে । তখন সে লুকিয়ে হত্যাকান্ড দেখত। বয়স ১৮ হলে হত্যার অনুমতি পেত এইসব নতুন ঠগী সদস্যরা। সাধারণত শক্ত কাপড়ের তৈরি হলুদ রঙের রুমাল ফাঁস গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করা হত। হলদে রুমাল থাকত ঠগীদের কোমরে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারষ্পরিক বিবাহ প্রথারও প্রচলন ছিল। সারাবছরই ঠগিরা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার করত। শরতের শুরুতে ওরা দলবেঁধে পথে নামত। তখন ওরা অন্য মানুষ, ভ্রাম্যমান খুনি ! এটাই তখন ওদের একমাত্র পরিচয়। শীত শেষ হলেই সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ঘরে ফিরে আসত।

সব ঠগিদের দলেই একজন দলনেতা বা সর্দার থাকত। দলনেতাকে বলা হত জমাদার। সকলে তাকে মেনে চলত। শিকার করার পর যা পাওয়া যেত তা সবাই সমানভাগে ভাগ করে নিত। এমনকি দলে কেউ অনুপস্থিত থাকলেও তার ভাগটা সে ঠিক ভাগটা পেয়ে যেত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ‘কালিঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ‘ভবানী মন্দির’। ওরা এই কাজকে পারষ্পরিক ঐতিহ্য বলেই মনে করত। ঠগীদের রুমাল বা গামছা পেঁচিয়ে মারার কিন্তুছিল একটি বিশেষ পদ্ধতি । এরা সাধারনত রুমাল বা গামছা এক প্রান্তে ইট বা পাথরের টুকরা বেঁধে একটু দুর থেকে ছুড়ে দিত, যা শিকারের গলায় এত শক্ত ভাবে পেঁচিয়ে যেত যে তার শ্বাসরুদ্ধ হবার জন্যে যথেষ্ট।

ঠগীরা সাধারণত ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য যোগাড় করত। তারপরে সুকৌশলে সেই যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত , এবং যাত্রাবিরতিতে হত্যাকান্ড ঘটাত। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ঠেলে দিত, অন্যজন ফাঁস পরাত, অন্যজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, কাছেপিঠেই ওৎ পেতে থাকত ঠগীদের অন্য কোন দল । তবে ঠগীরা সবাইকে হত্যা করত না। যেমন, ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ , নৃত্যশিল্পী , ঝাড়–দার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রী, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গজলবাহক ও নারীদের হত্যা নিষেধ ছিল। তবে ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের হত্যা করা হত।

তৃতীয় পর্ব

চলবে . . .
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫০
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×