আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলি
বরফের পরিমান আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। বারলাচালা পাস ছেড়ে এবার আমরা অন্য পাহাড়ে চড়া শুরু করলাম।
এ সময় একটা বেশ মজার কান্ড ঘটলো। আমরা ততোক্ষণে বরফের রাজ্য ছেড়ে বেশ দূরে চলে এসেছি। এই পাহাড়গুলায় প্রচন্ড ধূলা। সামনে কতোগুলো ট্রাক যাচ্ছে। দূরপথের যাত্রায় সবসময় কমপক্ষে তিনটে ট্রাক একসাথে চলাচল করে। পাহাড়ী পথে এতো লোড নিয়ে এগুলো খুবই আস্তে আস্তে চলে। এই ট্রাকের ধূলোর যন্ত্রণায় আমরা অস্থির হয়ে গেলাম। এগুলো থেকে মুক্তো হবার উপায় হচ্ছে ট্রাকগুলোকে পাশ কাটানো। কিন্তু এই বিশাল বপুর গাড়িগুলোকে এই পাহাড়ি পথে ওভারটেক করা একেবারেই অসম্ভব। মানালি থেকে লেহ এর পথে অনেকগুলো আর্মি ক্যাম্প আছে। আমরা যদি সেই ক্যাম্পের রাস্তা দিয়ে যেতে পারি তবে ট্রাকগুলোর পিছন ছেড়ে শর্টকাট ক্যাম্পের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ট্রাকগুলোর সামনে উঠে যেতে পারি।
আলী ভাই একটা আর্মি ক্যাম্পের সীমানায় গাড়ি থামালেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে ক্যাম্পের দরজা খুলে দিলাম, আলী ভাই ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। সে সময় দূর থেকে ক্যাম্পের এক আর্মি দৌড়ে এসে আলী ভাইকে খুবই বকাবকি শুরু করলেন,যে কেন সে ক্যাম্পের শর্টকাটে গাড়ি নিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। আলী ভাই বললেন যে তিনি নিজেও একজন আর্মি, তারপরও ক্যাম্পের আর্মি লোকটা কোন কথা শুনতে চাইলো না। অকথ্য ভাষায় আলী ভাইকে বকাঝকা করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আলী ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন, আর আমি গিয়ে আবার ক্যাম্পের দরজা খুলে দিলাম। আলী ভাই আর্মি ক্যাম্প থেকে গাড়ি বের করে আনলেন। ক্যাম্পের আর্মি থেকে দূরে সরে এসে তিনিও ক্যাম্পের আর্মিদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয়া শুরু করলেন।
তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি তো এক ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়িতে উঠেছিই। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ নয়, আমি ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ ক্যাম্পের গেটও খোলা আর বন্ধ করছি। তাও যে সে ক্যাম্প নয়, যে এলাকায় কোন বাংলাদেশীর প্রবেশ একেবারেই সংরক্ষিত। এই এলাকাটা তিব্বত, চীন আর পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বলে খুবই সেনসেটিভ অঞ্চল। সবসময় এখানে যুদ্ধাবস্থা থাকে। আর বাংলাদেশীদেরকে ইন্ডিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা খুবই সন্দেহপ্রবন চোখে দেখে। তারা মনে করে বাংলাদেশীরা বুঝি জানোয়ার পাকিদের সমর্থক।
আলী ভাই কিছুক্ষণ ইন্ডিয়ান আর্মি নিয়েও কথা বললেন। তিনি একজন কর্পোরাল, মাসে তার বেতন ৩৫,০০০ রুপি। কোন দুর্গম এলাকায় অথবা অন্য রাজ্যে বদলী হলে আরো বেশী ভাতা পাবেন। হায় আমাদের বাংলাদেশী আর্মি অফিসাররাও তো এতো বেতন পায় না। ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসাররা মাসে দেড় লাখ রুপিরও বেশি বেতন পান। আর্মি অফিসাররা বোধহয় সৈনিকদের মানুষ বলে গন্য করে না। অবশ্য সারা পৃথিবীতেই সেই একই ব্যাপার। ইন্ডিয়ান আর্মিতে ধর্মের কোন ভেদাভেদ নেই। মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মীয় সব লোকই সমান সুযোগ পায়। কারো প্রতিই ধর্মীয় কারণে কোনরূপ বৈষম্য করা হয় না। প্রতিটি আর্মি ক্যাম্পেই মন্দির মসজিদ শিখদের উপাসনালয় সহ সব ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয় আছে।
যাই হোক আবার ফেরত এসে পথে ট্রাকের ধুলো খেতে খেতে অনেকক্ষণ পরে কিছুটা সমতল জায়গায় ট্রাকগুলোকে ওভারটেক করা হয়েছিলো। এই যাত্রাপথে আমি একটা অদ্ভূত নিয়ম দেখেছিলাম। প্রত্যেক গাড়ির ড্রাইভার বিপরীত দিক থেকে আসা অথবা ওভারটেকিং করা অন্য গাড়ির ড্রাইভারকে হাত তুলে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আসলে তারা যে এই রাস্তায় ড্রাইভিং করা অবস্তায় এখনো মারা যায়নি এটা তারই শুভেচ্ছা জানানো। আবার কোন গাড়ির কেউ কোন অসুবিধায় পড়লে অন্য গাড়ির লোকের গাড়ি থামিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য ছুটে যাচ্ছে।
যাত্রা পথের বর্ণনা আমি আর দিচ্ছি না। আপনারা বরঞ্চ ছবি দেখে নিন। তবে পাহাড়গুলো কিন্তু কেমন ধূসর আর লালচে মেটে ধরনের।
সবুজ গাছপালা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মাঝে একটা ছোট হ্রদ পার হলাম। ধূসর পাহাড়ের মাঝখানে গাড়ো সবুজ রঙের লেকটি এক কথায় অনবদ্য।
বেলা বারোটার দিকে এসে থামলাম সারচুতে। এখানে হিমাচল প্রদেশের সীমানা শেষ আর জম্মু এন্ড কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ অঞ্চলের সীমানা শুরু। এখানে পুলিশ চেকপোষ্ট আছে। সবাইকে কড়া পুলিশি চেকিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের। বাংলাদেশীদের এখানে খুবই কড়াকড়ি। তবে জায়গাটা খুবই সুন্দর।
সারচুর আগের জায়গাটা খুবই সুন্দর। দুপাশে খুবই উঁচু পাহাড়, মাঝখানে একেবারে সমান জায়গা। যার একপাশে রাস্তা,আর তার পাশে গভীর খাদের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। আর এই ভয়ঙ্কর খাদটা এমন যে তার খুব কাছাকাছি না গেলে বোঝা যায় না যে সেখানে এখানে একটা গভীর খাদ রয়েছে আর তার মাঝ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। এই নদীটার নাম হচ্ছে সারাপ-ছু।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:১৯