মুসলিমদের শেষ খেলাফতের দেশ তুরস্ক দেখতে কেমন? কেমন দেশটির মানুষের জীবনাচার। দেশটিতে সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার আগে কতো রকমারি কৌতূহল যে মনে এসে ভীড় জমায়।
যেদিন বিমানে চেপে বসি সেদিন কৌতূল আরও বেড়ে যায়। দেখতে পরীর মতো, ইয়া লম্বা লম্বা বিমানবালাদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আসার পর সেই মুগ্ধতা যেন খানিকটা ভয় আর বিস্ময়ে পরিণত হয়। মেয়েগুলো সমানে সিগারেট ফুঁকছে আর মাঝেমধ্যে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিচ্ছে।
ওমা এসব কী! একে তো মেয়ে মানুষ সিগারেট খাচ্ছে, সে আবার চোখ টিপ দেয়!
ধার্মিক বাঙালির পিলে চমকে ওঠার মতো অবস্থা। হায়! হায়! একি!
এই তুরস্ক তরুণ বীর ফাতিহ সুলতানের দেশ। এই দেশ সুলাইমান দ্যা ম্যাগনিফিশেন্ট গ্রেট সুলেমানের দেশ। বাঙালির কাছে এই দেশ হুররম সুলতানের দেশ!
এই দেশে পা দিয়েই বুঝতে পারি, তুর্কিরা মানুষ হিসেবে উষ্ণ। বিদেশিদের উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে দিয়ে তারা অভ্যস্ত। আমরাও উষ্ণ অভ্যর্থনা পাই। ওরা যাকে বুকে টেনে নেয় তাকেই আবার পশ্চিমাদের মতো পেছন থেকে পিঠ দেখায় না।
তুর্কিদের পশ্চিমাদের মতো ‘ভণ্ড আর ষড়যন্ত্রকারী না’ এই ভেবে আনন্দ পাই।
দেশে থাকতে ভেবেছিলাম তুর্কিরা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো ইংরেজি জানে। হয়তো সব মানুষই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। তুরস্কে আসার পর ভুল পাল্টায়। এটা একটা জাতিরাষ্ট্র। এখানে টার্কিশই হচ্ছে একমাত্র ভাষা। ফলে প্রথম গিয়ে আমাদের পড়তে হয় এক মধুর সমস্যায়। টার্কিশরা ইংরেজি জানে না আর আমরা টার্কিশ। কিন্তু ওরা আমাদের এ দুর্বলতার সুযোগটা নেয়নি। দোকানে গিয়ে কিছু কেনে ওদের হাতে টাকা দিয়েছি, ওরা হিসেবে করে বাকিটা ফেরৎ দিয়েছে। বাঙালি হলে হয়তো ২ টাকার জায়গায় ৫ টাকা রেখে চিৎপটাং দিত। তুর্কিদের এই বিষয়টি ভাবলে আমার এখনো ভালো লাগে।
ওরা বেশ লম্বা গড়নের, সুন্দর। শিক্ষিত সবাই মোটামুটি প্রমিত উচ্চারণে কথা বলে। দেশটিতে বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর বাস। তবে তুর্কিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের হাতে নীপিড়নের স্বীকার হচ্ছে এমন অভিযোগও শোনা যায়। তবে ওদের জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ রয়েছে এমন সব সমস্যা সমাধানের। তুর্কিরা তাদের জাতীয় উৎসবগুলো বেশ সাড়ম্বর করে পালন করে। কিন্তু ধর্মীয় উৎসব যেমন ঈদ নিয়ে তাদের কোন উৎসাহ দেখা যায় না। অন্য আট দশটা দিনের মতোই ঈদের দিনটা।
কোন সাহায্য লাগলে তুর্কিরা এগিয়ে আসে। রাস্তায় কোন অসুবিধা হলে ওরাই এসে জানতে চাইবে কোন সাহায্য লাগবে কি না। বিশেষ করে বিদেশিদের সাহায্য করাটা ওরা দেখে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে।
তুর্কিরা নিজেদের তার্কিশ-মুসলিম পরিচয় দিয়ে খুব গর্ববোধ করে। মুসলিম শব্দটির সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে তুর্কিদের মসজিদের আশপাশে খুব একটা দেখা যায় না। মোট নাগরিকের খুব অল্পসংখকই ব্যক্তি জীবনে ধর্ম পালন করে বলে মনে হয়েছে আমার। তবে তাদের মসজিদগুলো দৃষ্টিনন্দন। এক একটা মসজদি যেন এক একটা স্থাপত্য শিল্প। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
তুরস্কে থাকতে মাঝেমধ্যেই ভাবতাম টানা ৬০০ বছর যারা এই পৃথিবী শাসন করল তাদের কেন আজ এই পরিণতি?
নিচে নামতে নামতে এক আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হতে হলো!
তুর্কিরা আসলে যুদ্ধ চর্চাটা ভালোই করছিল, কিন্তু বুদ্ধিমত্তার চর্চাটা সেভাবে করতে পারেনি। ফলে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে হেরে যায়। তুর্কিদের একটা বিশাল অংশকে দেখেই মনে হয়েছে ‘মাথা মোটা’। হুট করেই রেগে যাবে। রাগলে আর থামানো যায় না। এমন মাথা দিয়ে কিভাবে ৬ শতক পৃথিবী শাসন করেছে এটাই বিস্ময়ের।
পৃথিবী সম্বন্ধে খুব কমই জানে তুর্কিরা। ওদের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষের ধারণা নেই বাংলাদেশ কোথায়! যারা জানে তারা ভুল জানে। এ নিয়ে বহুবার বহুজনের সাথে তর্ক হয়েছে।
গত দেড় দশক ধরে তুরস্ক শাসন করছে ধর্মপন্থী এরদোয়ান নেতৃত্বাধীন সরকার। তার শাসন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও জনগণের ভোটেই এখনো তিনি টিকে আছেন। তবে আমার মনে হয়, পশ্চিমাদের নাকের ডগায় একটা মানবিক তুরস্ক কিভাবে গড়ে তোলা যায়, যা হবে সব মানুষের জন্য নিরপাদ এ নিয়ে তুর্কিদের ভাববার সময় এসেছে।
জীবনের বেশ কয়েকবছর তুর্কিতে কাটিয়ে যেদিন দেশে ফিরে আসে সেদিন আমার চোখে মুখে লেগে ছিল ওদের জন্য ভালোবাসা-মায়া। সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরা এক অম্ল-মধুর তুর্কি জীবন ছিল আমার। ইস্তানবুলের পথেঘাটে কতো স্মৃতি ছড়ানো ছিটানো।
মনে পড়ে, ২০১৪ সালে তুরস্কে যাওয়ার পর ওদের প্রজাতন্ত্র দিবসে কয়েকজন বিদেশী বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হই। রাত অনেক হয়ে যাওয়ায় আমরা ডর্মে ফিরতে পারছিলাম না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ, পথও চিনি না। তখন একজন তুর্কি তার প্রাইভেটকারে করে আমাদের ডর্মে পৌছে দিয় গিয়েছিলেন। শুধু তাই না, পরে একদিন তিনি আমাদের দাওয়াত করে খাইয়েছিলেনও। তুর্কিদের এ উষ্ণতাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। না চাইলেও বলতেই হয়, তুরস্ক দেশটা সত্যিই খুব অসাধারণ, যেন প্রাকৃতিক লীলাভূমির এক স্বর্গভূমি!
লেখক: সরোজ মেহেদী, তুর্কি জীবনাচার, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী ‘মেরহাবা’র সম্পাদক। লেখাটি মেরহাবা’র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত।
(ছবিতে লেখক ও দুই তুর্কি শিশু)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২১ রাত ১১:২৭