ওহহো, আমিও ভুলে যাই বড় হয়ে গেছি। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আর ক'দিন পর চলে যাবে প্রবাসে, স্বামী-জীবন যাপনে। তবু কৈশরের স্মৃতি হানা দেয়। আমাদের গেছে যে দিন তা কি একেবারেই গেছে!
ও নিমিষেই চোখের আড়াল হয়ে যায়। আমার আর দেখা হয় না ওকে। কোনদিনও বলা হয় না নিজের না বলা কথাগুলো। সে কি জানে, তার একটু দেখা পাবো বলে, সেই কবির মতো এককোটি বছর দাঁড়িয়ে আছি, এই চৌরাস্তায়। কতো অশ্রুজল শুকালো দু’চোখে, কত শীত গ্রীষ্ম পার হয়ে গেলো, অপেক্ষা ঘুচলো না। তাকে একটু দেখতে পাবো বলে, বুদ্ধের মতন আমি ঘর ছাড়া, পথের বাউল…
আমি থাকব বলে বিছানা পাতা হয়েছে। কিন্তু যাব বলে উঠে দাঁড়াই। চোখ রাঙাতে রাঙাতে দরজার সামনে বিদায় দিতে এসে দাঁড়ায় ফুপু, মানে গৃহকর্তী। একে একে বাসার সবাই আসে, শুধু একটি প্রাণী ছাড়া। মোজা পরি, তারপর ক্যাডস। বাসার সবচেয়ে ছোটজন এসে গো ধরে না যেতে পারবে না, না-না-না। পিচ্চীটা এবার বিকট চিৎকার শুরু করে।
শেষ বেলায় চোখ তুলি। ও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের মতোই নির্লিপ্ত। ঠিক তাকাচ্ছেও না। আমি হাত নারি। সাড়া দেয় না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফুপুর কণ্ঠ শুনি, তোদের রাত বিরাতে চলে অভ্যাস। কথা শুনবি না কি করব। গিয়ে একটা ফোন দিবি। ইনশাল্লাহ বলে গেট ক্রস করি। ফোন দিবি বলে দিলাম, ফুপু হাঁক ছাড়ে। আমিও সজোরে আওয়াজ দেই-দেব ফুপু।
রাতটা থাকা যেত। থাকলে সাড়ে তিন বছরের নদু সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। নাদিয়াকে ভিডিও কলে বহুবার দেখছি। এই পিচ্চী যে এত মায়াময় আর বুদ্ধিদীপ্ত দেখা না হলে বোঝা যেত না। হেলেদুলে কি সুন্দর করে কথা বলে। দাঁতগুলো যেন কেউ সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছে। মুখটা মায়ার আঁধার। ও ছাড়বেই না, তাই বিদায়ও দেবে না। চিৎকার করতে করতে ভেতরে চলে গেছে। যাবে না বলছি। না-না-না…।
নদু কাঁদছে। ফুপুর মুখ গোমরা। এতোদিন পর এসে একটা রাত না থেকে চলে যাচ্ছি এটা কেউ মেনে নিতে পারে না। তবু কেন এই মধ্য রাতে সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কেউ জানে না, আমি জানি। আমার বাহিরে সবুজ আর ভেতরে লাল। ১৩ বছরের যন্ত্রণা নিয়ে এক রাত পাশাপাশি ঘুমানো যায় না। নি:শ্বাসও আসলে নেয়া যায় না। আমি তাই পালাই। পালিয়ে বাঁচার মধ্যে নাকি এক ধরনের আনন্দ আছে। আমি কি আজ সে আনন্দের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমার নাকে!
বাসার সিঁড়ি থেকে নেমে হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। সুতায় বাঁধা একটা খাম আমার সামনে ঝুলছে। আশপাশে তাকাই। আমাকেই দেওয়া হয়েছে বোধহয়। খামটা হাতে নেই। আবার হনহন করে হাঁটি। পথে বার কয়েক চেক করি। খামটা আবার হারিয়ে যায়নিতো।
উত্তরা থেকে ধানমণ্ডি। বাসায় আসতে আসতে রাত সোয়া একটা। ঘরে না ঢুকে পাশের পার্কে চলে যাই। কোন মানুষ নেই। ২/৪জন আশ্রয়হীন শুয়ে আছে। কয়েকটা ছোকরা মিলে পার্কের দক্ষিণ পাশে আগুণ জ্বেলে কি যেন পুড়াচ্ছে। এদের একটা গাইছে, বাকিগুলো তালিয়া দেয়। এদের বোঝার কথা না, আমি কেন এই রাতে এখানে। এদেরতো ঘর নেই বলে, পার্কই রাতের ঠিকানা। আমি একেবারে
উত্তরে সরে আসি। সোডিয়াম লাইটের আলোয় খামটা খুলি। একটা সাদা পাতা।
মাঝখানে লাল কালিতে লেখা, যে ভালোবাসা বুঝে না তাকে ভুলে গিয়ে বেঁচে যাক পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকারা।
বি.দ্র: ইলিশ খাওয়াটা দেখি এখনো শেখেননি জনাব।
লেখক: সরোজ মেহেদী
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৪