হলদে আম পাতায় দোল খাওয়া লাল পিঁপড়ের জানা ছিলো না একটু পরেই স্বয়ংক্রিয় ঝরে পড়বে পাতাটি; যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ আর বাতাসের রাজনৈতিক প্রভাবে, কিছুদূর লাটিমের মতো ঘুরে, কিছুদূর নৌকোর মতো দোল খেয়ে, আলু ক্ষেতের পৃথিবীতে পড়লো পিঁপড়েসমেত; আলু পাতাদের বিনা আমন্ত্রনে পিঁপড়ে তাদের গহনে খাদ্য তালাশে লেগে যায়; আলু পাতারা সালোক সংশ্লেষণে পুষ্ট; আম পাতাটি রোদে পুড়ে শুকাতে থাকে; আম গাছ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে; আর তার পাশে এক একর বিস্তারিত আলু ক্ষেত আকাশের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে; সবুজ আম পাতারা ঝরে পড়ার আগে কিছুকাল হলদে রঙ ধারণ করে; তখন আমগুলো পাকতে থাকে;
আলু পাতাদের সমস্বর প্রশ্নঃ
কে তুমি? কি হয়েছে তোমার? কি খুঁজো অমন হন্যে হয়ে?
পিঁপড়ে খুঁজতে খুঁজতে জবাব দ্যায়ঃ
খাদ্য খুঁজি বেঁচে থাকবো বলে; আমাকে সবাই জানে পিঁপড়ে নামে; তার বেশি কিছু জানি না নিজকে
আলু পাতাদের সমস্বর প্রশ্নঃ
কিন্তু শীর্ষে শীর্ষে ডগায় ডগায় দৌড়াও কেন? উড়ে এসে জুড়ে বসার ভাবও দেখতে পাই
পিঁপড়ের জবাবঃ
শীর্ষ আমার পছন্দ, তলে তলে যেতে পারি না, তলে তলে থাকতে চায় তীর্থের কাক; আর উড়ে এসে জুড়ে বসার ভাব নেই, ওটা দেখার ভ্রান্তি তোমাদের; তবে উড়ে এসেছি কথা সত্য, তাতে আমার ইচ্ছা ক্রিয়াশীল ছিল না।
অতঃপর আলু পাতারা চুপ হয়ে যায়
জরুরী নয় যে পিঁপড়ে আম পাতার পতনের কারণ তালাশ করবে; তার মনে হয় সে এখন মহাবন আমাজনে আছে; অথচ পিঁপড়েটি জানে না, আর কিছু বেলা বাড়লেই এখানে কৃষকের কীটনাশকের কবলে পড়বে সে;
সূর্য তার কক্ষপথে দৌড়ায়; পৃথিবীও তার কক্ষপথে প্রতি সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার বেগে দৌড়ে আছে; পিঁপড়ে টুকটাক খাদ্য খেতে খেতে দৌড়ায়; কোথায় কোন দিকে যায় সে জানে না; তার দিক দর্শন জ্ঞানেরও প্রয়োজন নেই।
মরমী পল্লী গানের মাধুরী ছড়াতে ছড়াতে কৃষক তার সময়মতো এসেছেন ক্ষেতে। জরুরী নয় যে পিঁপড়েটির অবতরণের গল্প শুনবেন; কতো প্রকারের পিঁপড়ে আছে তার আলু ক্ষেতে সে খবর প্রয়োজনহীন; পিঁপিলিকাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে মাথা ঘামায় এমন কাউকে উন্মাদ আখ্যা দেয়া হয় এই তল্লাটে। কৃষকের মাথার ভেতরে স্বপ্ন আর আনন্দ গোল্লাছুট খেলে; রক্তের লৌহ কণিকারা করে উদ্বাহু নৃত্য; আর মুলতঃ আম গাছের ওই লাল পিঁপড়ে আলু ক্ষেতের কোনো ক্ষতি করে না; তবু সে তার অনিচ্ছায় আম পাতায় ভর করে আলু পাতার আমাজনে এসে অন্যান্য কীটদের সাথেই গণ্য। এমনও হতে পারে, যে-কৃষক কীটনাশক ছিটাতে এসেছেন, এই কৃষকই আম গাছটিতে থাকা লাল পিঁপড়েদের বাসা ভেঙে, তাদের শাদা ডিম মিশিয়ে পুকুরে বর্শি দিয়ে মাছ ধরেছিলেন গতকাল। হয়তো ডিমগুলোর অধিকাংশই এই পিঁপড়ের।
কৃষক কীটনাশক ছিটিয়েছেন তার স্বপ্নের আলু ক্ষেতে; অনেক প্রকার কীটদের সাথে পিঁপড়েটিও মৃত্যু বরন করেছে কয়েকবার ছটফট করে; কীটনাশক ছিটানোর সময় হঠাৎ কৃষকের মনে পড়ে তার প্রিয়তমার কথা; তার বিশেষ উষ্ণতায় সমর্পিত হওয়ার কথা; মধুময় আলিঙ্গনের কথা। গতরাতে প্রিয়তমা তার বলেছিলেন, ‘তুমি কুনুদিন পরবাসে যাওনের কথা মুখে আইনো না, তুমি একদিনের লাইগা চকখের আড়াল হইলে আমার মন মইরা যায়, কিচ্ছু ভাল্লাগে না; খালি পথের দিকে চাইয়া তাহি কহন আইতাছো।‘
এই তল্লাটের মানুষ এই জুটিকে বলে ‘রূপবান-রহিম‘। তার কারণ কৃষকের বয়সের তুলনায় তার প্রিয়তমার বয়স অধিক। ধানের ক্ষেতে কিংবা আলু ক্ষেতে প্রিয়তমার কথা মনে পড়লে কৃষক আকাশে উড়তে থাকেন। গলা ছেড়ে গান ধরেন- ‘আমার কি সুখে যায় দিন রজনী কেউ জানে না/কুহু সুরে মনের আগুন আর জ্বালাইও না‘। এই গান তার গাওয়ার কথা নয়, এই গান বিচ্ছেদের; কিন্তু কৃষক যখন আকাশে উড়েন, তখন বিচ্ছেদেরই গান ধরেন। গান শুনে একদিন তার পড়শি বন্ধু বলেছিলো, ‘রূপবান তোমার ঘরেই আছে, বিচ্ছেদ গাও ক্যা!‘ কৃষক বলেছিলো, ‘এমনেই, হের কথাই মনে হইছে, ভাব আইলো ক্যান জানি বিচ্ছেদের, গাইয়া লাইলাম।‘
‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দৌজ টেল অব সেডেস্ট থট‘- কীটস নামের এক মহৎ কবি এই কথা বলেছিলেন তা কিন্তু কৃষক জানেন না। কীটসের কথাটারে সত্যায়িত করেন কৃষক।
উড়তে উড়তে গান গাইতে গাইতে কৃষক ছিটিয়েছেন কীটনাশক। ভালো ফলন ঘরে তোলার জন্য এই কাজ তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু অতঃপর বাড়ি ফেরার পথে অবিশ্বাস্য সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত কৃষক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন পথেই; এই খবর সকলের জানা হয়ে গেছে। কিছুদিন অধিক শোকে পাথর হয়ে থাকেন তার প্রিয়তমা এবং পরে পথে পথে আউলা বেশে দুঃখের সারি গাইতে থাকেন- ‘সোনার ময়না পাখি, কোন দেশেতে গেলায় উইড়া রে/ দিয়া মোরে ফাঁকি রে আমার সোনার ময়না পাখি‘।
এই সময় এক বদ্ধ পাগল যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। সে শুধু চলতে পথে একা একা বলে ‘মারো আর মরো‘ ‘পিঁপরা মরলে কেউ কান্দে না রে, কান্দে না। তয় বিষাক্ত পিঁপরা কামড় দিয়া মাইনসেরে কান্দাইতে পারে।‘ সে ফুটবল খেলা দেখে খুব আনন্দ পায়। দেখতে দেখতে বলে, মারো মারো, দুনিয়াটারে লাথি মারো জোরসে।‘
পাগলের কথায় কিবা আসে যায়; পৃথিবী তো ফুটবল নয়। পাগলটা বিএ পাশ করেছিলো।
আম পাতার পতন, পিঁপড়ের মৃত্যুর সাথে কৃষকের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র আছে কি না কারো সাধ্য নেই কিছু বলার!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




