somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প - ভদ্রলোক

১৫ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিনয়ী বলতে একজন মানুষকে যা বোঝায় ভদ্রলোকটি ঠিক তেমনই। বিনয়ের সাথে ভদ্রতার মিশ্রণে লোকটিকে পুরোদস্তুর ভদ্রলোক বলা যায়। ভদ্রলোকের নাম আফজালুর রহমান। তার সাথে আমার প্রথম দেখা মাস ছয়েক আগে বিমানবন্দর স্টেশনে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম ট্রেনের জন্য। তিনিই প্রথম আগ বাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসলেন। বয়স আনুমানিক ষাটের উপরে হবে। স্বাস্থ্য এখনো ভেঙে পড়েনি, মাথার সবগুলো সাদা চুলে কলপ দিলে দিব্যি বয়স অর্ধেকে নেমে আসবে। তিনি বেশ লম্বাচড়া, কফি কালারের সাফারি সেটে লোকটিকে দারুণ বেশ লাগছিল, চোখে রে-বেনের কালো রঙয়ের মোটা ফ্রেম, শ্মশ্রুহীন তেলতেলে গাল দেখে মনেই হয় না তার বয়স এখনো ষাট।
কথায় কথায় জানতে পারলাম তার মেয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছেন। তিনি এসেছেন রিসিভ করতে। কথার এক পর্যায়ে আমার সম্পর্কে জেনে নিলেন, কোথায় থাকি, কি করি, কোথায় যাচ্ছি ট্রেনে করে সব। ভদ্রতার খাতিরে তিনিও তার সম্পর্কে সব বললেন। রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা। আশির দশকে পানির দরে উত্তরায় খাস জমি কিনেছিলেন, পেনশনের সব টাকা দিয়ে সেখানেই দোতলা বাড়ি করেছেন। তার ভাষ্যমতে এত বড় বাড়িতে তিনি থাকেন মাত্র একা। স্ত্রী গত হয়েছেন তাও প্রায় বছর সাতেক হলো। একমাত্র ছেলে গোথামে পিএইচডি করে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেছে। আর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে চট্টগ্রামে। সেই মেয়েই আজ আসছে। বছরে একবার তার কাছে আসে, আজ সেই দিন।

সেদিন দেখা শেষে তিনি একবার আমন্ত্রণ জানালেন তার বাসায় যাওয়ার জন্য। ভদ্রতার খাতিরে নয়, সিরিয়াসলিই ডেকেছিলেন। প্রথমে ভদ্রতার খাতিরে যাবো বলেছিলাম। ভেবেছিলাম, তিনি বুঝি ভদ্রতার খাতিরেই যেতে বলেছিলেন, তাই আর সেরকম পাত্তা দেইনি। কিন্তু যখন তিনি আমাকে ফোন করে ঘন ঘনই যেতে বললেন, তখন বুঝলাম তিনি সত্যিকারেই যেতে বলছেন। ফোন নাম্বার তাঁকে দিয়েছিলাম সৌজন্যতার খাতিরে। মানুষকে কখন কোন প্রয়োজনে কাজে লাগে কে জানে? তাই নাম্বার দিয়ে রেখেছিলাম। সেই নাম্বার দেওয়াটাই যে এতটা যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারিনি।
প্রথম যেদিন তিনি ফোন দিয়েছিলেন, সেদিন আমি ছিলাম অফিসের একটি মিটিংয়ে। সাইলেন্ট করা ছিলো না, পুরো মিটিং রুমে আমার ফোনে রিংটোন বেজে উঠলো। বসের সামনে লজ্জা সামলানোর আগেই বস কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন একহাত। কলটি সেসময় কেটে দিয়ে পরে তাঁকে ব্যাক করেছিলাম। রিসিভ করতেই তিনি বলেছিলেন,
-কেমন আছেন রেহান সাহেব?
গলায় কোমলতা ঢেলে জবাবে বলেছিলাম,
-জ্বি ফোন দিয়েছিলেন? আমি ভালো আছি। আপনি?
-এই আছি আর কি। তা আপনি তো আর আসলেন না।
-জ্বি আসবো।
-জ্বি জ্বি, তা তো অবশ্যই। শুনুন, আমি না একটা নতুন রান্না শিখেছি, আপনি আসলে খাওয়াবো। নিজের রান্না নিজেকেই করতে হয়।
এটুকু বলার পর ওপাশ থেকে তার হাসির কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিলো। যেন খুব উঁচুদরের রসিকতা হয়ে গেছে। এমনিতেই মিটিংয়ে কল বেজে ওঠায় কিছুটা বিরক্ত ছিলাম তার উপর। এরকম অবস্থায় কেউ ফোন দিয়ে যদি বলে নতুন রান্না শেখার কথা, তারমাঝে বিশাল দরের রসিকতার পর মানুষ যেভাবে হাসে সেরকম হাসি, তাহলে মেজাজ খারাপ হতেই পারে। তবুও নিজেকে দমিয়ে রেখে বললাম,
-জ্বি জ্বি চেষ্টা করবো আসতে, আপনার রান্না খেয়ে দেখবো।
-কি আর করা। বুড়ো মানুষ, তারমাঝে বেকার, এটা সেটা করতে মন চায়। তাই রান্না বান্নার দিকে মন দেই মাঝে মধ্যে।
-বেশ তো। আমি আসবো নাহয় একদিন।

এটুকু বলে সেদিনের মতো তার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। এরপরও এমন এমন সময় তিনি ফোন দিতেন, যখন কোন স্বাভাবিক মানুষ কাউকে কল করে না। একদিনের ঘটনা। মাঝরাত। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় যাওয়া মাত্রই গভীর ঘুম। হঠাৎ একসময় টের পেলাম রিংটোন বাজছে। রাতে ফোন অফ রেখে ঘুমুতে ভুলে গেছিলাম, তিনি সেই সুযোগ নিলেন। আমাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলার দায়িত্ব পালন করলেন, ভদ্রতার খাতিরেই তার কলটি রিসিভ করতে ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো,
-ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ঘুমিয়েছিলাম কি ছিলাম না, তাহলে মনে হয় কেবল মহাত্মা গান্ধী ছাড়া আর সবাই-ই বিরক্ত হবে। গান্ধীর কিছুটা গুণ রপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম, পুরোপুরি না পারলেও বিন্দুখানেক অর্জন থেকেই ভদ্রভাবে জবাব দিলাম,
-জ্বি ঘুমিয়েছিলাম।
-আহ হা তাহলে তো বিরক্ত করে ফেললাম।
- না না থাক বলুন। কোন সমস্যা হয়েছে কি?
-আরে না না। একটা কবিতা লিখলাম মাত্র। পরিচিত সবাইকেই কল দিলাম, দেখি কেউই রিসিভ করছে না। আপনি যে রিসিভ করে ফেলবেন তা ভাবতেও পারিনি। যাই হোক শুনবেন আমার কবিতাটা?
মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কবিতা শোনানোর মানেটা কোন লেভেলের পাগলামি বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম, যে তিনি যা যা করতে বলেন, তাই তাই করলেই তাড়াতাড়ি নিস্তার পাবো। নাহলে কোনদিন মাঝরাতে জাগিয়ে তুলে আবার কবিতা শোনান, ঠিক নেই। তাই নিয়তিকে মেনে নিয়ে তার কথা এক কান থেকে আরেক কানে বের করতে করতে তার কবিতা শুনতে লাগলাম।

এভাবে বেশ কয়েকবার আন-টাইমে তার যন্ত্রণার শিকার হওয়াটা আমার রুটিনে যুক্ত হয়ে গেলো। তিনি কখন কখন কল দিতে পারেন তার একটা সম্ভাব্য ধারণা রেখে ঐ ঐ সময়ে ফোন অফ রাখতাম। এভাবে চলছিলো বেশ কয়েকদিন। কিন্তু আমার মুক্তি বোধহয় ছিলো না তার হাত থেকে। তিনি কিভাবে কিভাবে যেন আমার অফিসের ঠিকানা পেয়ে গেলেন। একদিন অফিসের পিওন এসে বললো যে আফজালুর রহমান নামের একজন দেখা করতে এসেছেন। তার নাম শুনেই আমার আত্মা চমকে উঠলো। স্কুলের কোন টিচারকে সবচেয়ে ভয় পেতাম তা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মনে পড়ছিলো না। তবে কিরকম ভয় পেতাম, সেটা মনে পড়ছিলো। সেই ভয়টা তার নাম শোনার মতোই ছিলো। ভদ্রলোক যে তলে তলে আমার অফিসের ঠিকানা বের করে ফেলবেন তা বুঝতে পারিনি। নিয়তিকে মেনে নিয়ে তাঁকে দেখা করার অনুমতি দিলাম। অফিস রুমে ঢুকেই তিনি সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বাদ দিয়েই বলে বসলেন,
-আর বলবেন না, আপনার ফোনটা দেখি বেশ কয়েকদিন ধরেই বন্ধ। মনে করলাম শরীর-টরীর খারাপ কি না! যাই গিয়ে অফিসে একবার খোঁজ নিয়ে আসি। বাসা তো আর চিনি না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, আহ অফিসে এসেছেন, এপর্যন্তই থাক, বাসার দিকে আর নজর দিয়েন না প্লিজ। আমার মনোযোগ ভেঙে তিনি আবার বললেন,
-কিছু ভাবছেন নাকি?
-না না! কিছু ভাবছি না। শরীর ভালোই আছে। সেটটা ডিস্টার্ব দিচ্ছে কয়েকদিন যাবত।
-ওহ তাই বলুন।
-তা আপনি অফিস চিনলেন কিভাবে?
-কেন ঐ যে আপনি বলেছিলেন, টেনঅ্যান্সি টাওয়ার, গ্রীন রোড, অফিস নং ২, সেভেন্থ ফ্লোর। ওটা মনে রেখেই চলে এলাম।
-ও।
-আচ্ছা ভালো কথা, আপনার জন্য একটা গিফট নিয়ে এসেছিলাম।
-কি গিফট?
-আমার নিজহাতে গড়া বনসাইয়ের আম। খেয়ে দেখুন ছোট হলেও বেশ মিষ্টি।
এটুকু বলেই ভদ্রলোক সেদিন মিটিংয়ের মতো উঁচুদরের রসিকতা শেষের বিখ্যাত হাসিটা দিতে দিতে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। প্যাকেটটা ধরে বোঝা যাচ্ছিল এটা আমই। তবে ভদ্রলোকের বুদ্ধিশক্তির প্রশংসা করতে হয়। সেই কবে কোন সময় বলেছিলাম অফিসের ঠিকানা, তিনি ঠিকই খুঁজে বের করে এসেছেন। বিরক্ত হলেও তার সামনে সেটি প্রকাশ করিনি। এরপর গল্প-গুজব করে চা-নাস্তা খাইয়ে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে বলে অজুহাত দেখিয়ে বিদায় দিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর পিওনকে ডেকে বলছিলাম এরপর থেকে এই লোক আসলে বলে দিবে অফিসে নেই। অফিসের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম বেশ কয়েকদিনের। কিন্তু সেই সুখও বেশিদিন টিকলো না।

গত সপ্তাহের শেষ শুক্রবার। ছুটির দিন পেয়ে সারাদিন রেস্ট নিয়ে বিকেলে মার্কেট থেকে কেনাকাটা করে ফিরেছি। রাতের খাবার খেতে বসবো। হঠাৎ এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ভাবতে লাগলাম কে হতে পারে? মাসের মাঝামাঝি সময়, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ডিশ কোন বিলই আসার কথা না। আর তাছাড়া রাতের বেলায় কারোর আসারও কথা না। মনে মনে ভাবলাম, থাক বেল টিপুক কতক্ষণ, টিপতে টিপতে একসময় ঠিকই চলে যাবে।
এরপরেও প্রায় আধাঘণ্টা ধরে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে কলবেল বেজেই চললো। একবার ভাবলাম ফকির কি না। ঢাকা শহরে ফকির বলতে এখন আর কেউ নেই। যারা আছে, তারা সবাই ব্যবসায়ী। রাতের বেলায় কেউ ভিক্ষা চাইলে বুঝতে হবে সে সত্যিকারেই ফকির। কারণ ফকিররা এখন বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে না। ফ্রীজে একবাটি ভাত আর দুই টুকরো মুরগীর মাংস ছিলো। বের করে সেটা নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। খুলে দিতেই আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। অনেকটা হিন্দী সিরিয়ালে দরজা খুললে আর্টিস্টের যেমন চাহুনী হয় তেমন। হিন্দী সিরিয়ালের সাথে আমার পার্থক্য কেবল বাজনা বাজছিলো না। তাদের বেলায় বাজনা বাজে। সত্যিকারে বাজে না। তবে হার্টবীটের কাছে হিন্দী সিরিয়ালের বাজনাই মনে হয় মধুর।
দরজা খুলে দেখি আফজালুর রহমান সাহেব। প্রথম দেখায় তাঁকে যেমন বেশ শক্ত সামর্থ লেগেছিল, সেদিন আর তেমন লাগছিলো না। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে জবুথবু হয়ে আছেন। কণ্ঠে আদ্রতা ঢেলে তিনি বললেন,
-ভেতরে আসতে পারি?
আমার আচ্ছন্নতা কাটলো। তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দিলাম। একবারও মনে হচ্ছিলো না যে আমি এই কিছুক্ষণ আগেই আমি তাঁকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আমার মাঝে মুহুর্তের মাঝেই ব্যস্ততা চেপে গেলো তাঁকে যত্ন নেওয়ার। ভিজে একাকার। একটা তোয়ালে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-হঠাৎ আমার বাসায়?
-মন ভালো লাগছিলো না।
-বাসা চিনলেন কিভাবে?
-আপনার অফিস থেকে আপনাকে ফলো করে।
আমি মনে মনে বিরক্ত হলাম, তবে সেটা চেপে রেখেই ভদ্রতা করে বললাম,
-তা আমার কাছে বললেই তো পারতেন।
-না। আপনি দিতেন না।
-বলে দেখতেনই না।
-না আমি বুঝি।
-কি বুঝেন?
-আপনি বিরক্ত হন।
-না না আসলে তা না।
ভদ্রলোক যেমন হুট করে এসেছিলেন, ঠিক তেমনিই হুট করে চলে যেতে চাইলেন। তাঁকে বললাম,
-আজ রাতটা থেকে যান। বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি কোন কথা না বলে দরজার কাছে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আবারো তার বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

সেদিনের ঘটনার পর আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে এলো। অফিসে, রাস্তায়, বাসায় তার কথা প্রায়ই ভাবতে লাগলাম। একটা অপরিচিত লোক, কেন শুধু শুধু আমাকে তার বাসায় যেতে বলবেন? একদিন ঠিক করে ফেললাম তার বাসায় যাবোই। তাঁকে ফোনে কল দিলাম। ফোন বন্ধ। এরপর আর ফোনে ট্রাই করিনি। ভেবেছি, তিনি ঠিকই নিজেই চলে আসবেন কোন না কোনদিন। তিনি আসলেন না। ফোনও দিলেন না। আবার ফোন ট্রাই করলাম। পেলাম না। গতকাল অফিস থেকে ফেরার পথে ভাবছিলাম, যে আজ যাবো।
আজ অফিসের কাজ শেষ করে বিকেলেই রওনা দিয়েছিলাম ভদ্রলোকের বাসায়। মহাখালী থেকে উত্তরা বেশ দূর না। ভদ্রলোকের দেওয়া ঠিকানা খুঁজে বের করতেও বেগ পেতে হয়নি। ১০ নম্বর সেক্টরের ৬ নং রোডের ১৩ নং বাড়ি। আশেপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে এ বাড়িটিকে বেশ খাটোই লাগে। দুইতলা বাড়ি খুব বিরাট কোন বাড়ি না। ভদ্রলোকের ভাষ্যমতে তিনি থাকেন নিচতলায়। দরজার কাছে গিয়ে কলিংবেল বাজালাম। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক নিজেই খুলতে চলে এলেন। তাঁকে দেখে চেনাই যাচ্ছিল না যে তিনিই সেই লোক, যাকে প্রথম দেখায় মনেই হয়নি বয়স ষাট। তবে এখন দেখে মনে হচ্ছে ষাটের থেকেও বেশি। আমাকে দেখে ভদ্রলোক বেশ আনন্দিত হয়ে উঠলেন। মানুষ দুঃখ চেপে রাখলেও আনন্দ চেপে রাখতে পারে না। তিনিও পারলেন না। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন। আমাকে ছেড়ে দিলেন। খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাকে আপ্যায়নের জন্য। বাঁধা দিলাম বার কয়েক, তিনি শুনলেন না। কিছুক্ষণ পর এক কাপ চা, এক প্লেট বিস্কুট আর একটা প্লেটে সব্জি ভাজির মতো কিছু একটা আনলেন। ভদ্রতার খাতিরে টেবিলে রাখার সাথে সাথেই না খেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে খেতে ধরলাম। চা টা খেয়ে আমি থমকে গেলাম। কিছুটা দোটানা ছিল এটি কি চা নাকি গরম পানির সাথে দুধ চিনির শরবৎ। বিস্কুটটাও নেতিয়ে গেছে। মিষ্টি বিস্কুটের সাথে সবজি তিনি কেন দিতে গেলেন বুঝলাম না। সব্জিতেও লবণ তেমন একটা হয়নি, কেমন যেন রোগীর পথ্য রোগীর পথ্য মনে হলো। কথার এক পর্যায়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তা আপনি আমাকে আপনার বাসায় আনার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?
-খেয়ে উঠুন। তারপর বলছি।
কষ্টেসৃষ্টে কোনমতে খেয়ে উঠলাম। ভদ্রলোক কেন ডাকেন সে বিষয়ে আর কিছু বললেন না। আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম না। কথায় কথায় জানতে পারলাম তিনি বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন, ফোনও বন্ধ এজন্যই। তিনি সবাইকেই কল করেন, কেউ ব্যস্ততার কারণে তার সাথে কথা বলতে পারে না, তাই ফোন অন রাখাই কি অফ রাখাই কি?
কথাবার্তা শেষে তার ঘর থেকে যখন বেড়িয়ে পড়তে ধরলাম, তিনি ডেকে বললেন,
-আবার আসবেন।
-জ্বি অবশ্যই।
-আপনি যে আজ এসেছেন, আমার খুব ভালো লাগছে।
এটুকু বলেই তিনি কান্না শুরু করলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম,
-ছি! ছি! কাঁদছেন কেন?
-না এমনি। আচ্ছা আপনি আবার আসবেন তো?
ভদ্রলোক তার কোঁচকানো দু’হাত দিয়ে খপ করে আমার বা হাতটা চেপে ধরলেন, আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
-আহ! হাত ছাড়ুন, আমি আবার আসবো তো।
-আপনি যা যা খেতে চাইবেন, আমি তাই তাই খাওয়াবো, আপনি যা যা করতে চাইবেন আমি তাই তাই করে দিবো। তবুও বলুন, আপনি সত্যিই আসবেন?
ভদ্রলোক ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের কান্নাকে উপেক্ষা করা যায় না। মনের ভেতর কেমন যেন মন খারাপের ভাব তৈরী হয়ে যায়। আমি কিছু বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, থাক বেচারা কাঁদুক কিছুক্ষণ। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলেন,
-অনেক দিন হয়ে গেল এ বাড়িতে কেউ আসে না। রেহানা মারা যাওয়ার পরে বাড়িটা পুরো খালি হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে ও লোকজন খুব পছন্দ করতো, আমি করতাম না। কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর লোকজন না দেখলে আমার কেমন যেন অস্থির লাগে।

আকাশে অর্ধেক চাঁদ উঠেছে। হাস্নাহেনার ঘ্রাণও আসছে। ঝড় হবে বোধহয়, তাই বাতাস ছুটেছে। ভদ্রলোককে শান্ত করে তার বাড়ি থেকে হেঁটে ফিরছি বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে। জানি না তিনি আমাকে কেন এতটা আপন ভাবলেন? প্রকৃতির বিশালতায় মানুষ কি সত্যিই খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে? রাতের আধারে মানুষের এই নিঃসঙ্গতাকে কি সত্যিই খুব বাড়িয়ে দেয়? কে জানে দেয় হয়তো।

১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×