somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রঞ্জনের এক রাত

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১৬ সালে বইমেলায় প্রকাশিত বই 'এই ঘরে কোনো খুনি নেই' গল্পগ্রন্থ থেকে একটি গল্প।

গুলির আওয়াজটা শুনেছে। কানের পাশ দিয়ে গেলও রঞ্জনের বুঝতে পারেনি সেটা ‘গুলি’ ছিল। কিন্তু যখন পেছনের লোকটা নুয়ে পড়লো তখন রঞ্জন নিশ্চিত গুলিটা ছিল তার জন্য। ভাগ্যক্রমে টার্গেস মিস। বেঁচে গেল রঞ্জন। মিস ফায়ারে পড়ে গেল আরেক অভাগার জীবন।

এরপর থেকেই রঞ্জন দৌড়াচ্ছে। পেছনের একদল কুকুর ঘেউ-ঘেউয়ের আওয়াজে রঞ্জন বুঝে উঠতে পারে না পেছনে কি কুকুর দৌড়াচ্ছে! নাকি কুকুর দাঁড়িয়েই চিৎকার করছে।

পেছনের মানুষের পায়ের শব্দ রঞ্জনের কানে আসে। মনে হয়, গুলিওলারাও তার খুব কাছাকাছি। রঞ্জন অপেক্ষা করে দ্বিতীয় গুলির। কখন আসবে। হয়ত তার পায়ে লাগবে। কিংবা মাথার ঠিক পেছনটায়। সঙ্গে সঙ্গে মগজটা ভতভত করে কপালের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

রঞ্জনের পালানোর এক আপ্রাণ চেষ্টা। যদিও সে জানে আজকের পালানো বৃথা। এদিক সেদিক যেদিকেই যাক; ধরা আজ সে পড়ছেই। তাও পালানোর চেষ্টা! পেছনে কুকুর অথবা মানুষ। অথবা কুকুরের মতোই মানুষ। রঞ্জন বোঝে না। সে শুধু পালায়। আজ যেন মৃত্যু পেছনে ছুটছে। যে কোনো মুহূর্তেই দেখা মেলবে। ডানা মেলবে রঞ্জন। হারিয়ে যাবে অনন্ত নীলের মাঝে। যে নীলের গভীরতা সে জানে না।

গুলিটা কেন ছিল রঞ্জনের জন্য? এটা তো ভাবার সুযোগ হয়নি! দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবে রঞ্জন। কিসের বুলেট ছুয়ে যায় তাকে? রঞ্জন দৌড়াতে দৌড়াতে এবার ভাবে। গলির স্যাতস্যাতে দেয়াল ঘেষে ড্রেনটা লাফ দেয়। ওপারে যায়। ড্রেনে পড়ে আছে থকথকে হলুদ ঘু। রঞ্জনের বোমি আসে। ইচ্ছে করে জিরিয়ে নিয়ে একটু বমি করবে। সে সময় তার নেই। বাঁচতে হবে। বাঁচার এক বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত তাকে থাকতেই হবে। তার বেঁচে থাকা জরুরি। জীবনটার পরিণতি সে দেখতে চায়।

রঞ্জন নিজেই ভেবে হাসে। মুচকি হাসি। হাপাতে হাপাতে বলে, শালার পরিণতি তো এটাই। কুত্তার মরণ।
এক বাড়ির উঠানে মুরগির খামারের পাশেই ডালিম গাছ। গাছে পাকা ডালিমের গন্ধ রঞ্জনের নাকে এসে লাগে। সে থামে। একটু গন্ধ নাকে লাগাতে চায়। এই জীবনে আর কখনও পাকা ডালিমের গন্ধ রঞ্জনের নাকে তো আসবে না। তাই সে শুকে নেয়। যেন আজ সে শুকর হয়ে উঠেছে। নাকের দুই ফুটো দিয়ে গন্ধ তার ভেতরে যায়। সে এক লম্বা নিশ্বাস নেয়। আশেপাশে বুটের আওয়াজ তার কানে আসে। এবার সে দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্বাসেরও তো আওয়াজ আছে। ওই আওয়াজে না জানি ধরা পড়ে যায়।

রঞ্জন এবার ধীরে ধীরে এদিক সেদিক তাকায় আর আগায়। রাত গভীর। নিরব রাতে অল্প আওয়াজই কানে ধরা খায়। ডালিম গাছ থেকে একটু সামনে এগোনোর পর ছোট একটা ঘর। ঘরের সিড়ির কোঠায় রঞ্জন ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অন্ধকারে কালো রঞ্জনকে দেখা যায় না। ঘরের ভেতর থেকে গান আসে।
‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা...’

মনে হয়- মা তার সন্তানকে ঘুম পাড়ায়। রঞ্জনের চোখে পানি আসে। তার মা এমনই এক রাতে নিশ্চয়ই এভাবে গান শুনিয়েছিল রঞ্জনকে, তারপর ঘুম পাড়িয়েছে।

তবে এখন তার বড়দা’র কথা মনে পড়ে। বড়দা-তো তাকে প্রায়ই গান শোনাতো। লালনের গান। লালনের গান রঞ্জনের বড় গাইতে মন চায়। তখন বড় দা’র পরিণতির কথা মনে পড়ে।

এক মাইক্রোবাস এসে রঞ্জনের দাদাকে ধরে নিয়ে যায়। কেন যায় রঞ্জন জানে না। রঞ্জন শুধু জানে দাদাকে এক মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসা দানবরা ধরে নিয়ে যায়। রঞ্জন তখন কলেজে পড়ে। বাবাকে সে জিজ্ঞেস করে। দাদারে কই নেয়?
রঞ্জনের বাবা চুপ থাকে। উত্তর দেয় না। হয়তো রঞ্জনের বাবা বলতে চায় না কিংবা বাবাও জানে না। রঞ্জনের আজও জানা হলো না, দাদা কোথায়।

এই প্রশ্ন রঞ্জন পরবর্তী ১০ বছর বুকে নিয়ে ঘুরেছে। উত্তর সে পরে নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছে। কেন নিয়ে গেছে দাদাকে? দাদা রাজনীতি করতো, তাই কি ধরে নিয়ে গেল?

হঠাৎ করেই মহিলার গানের আওয়াজ নেই। ওই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে আবারও বুটের আওয়াজ কাছে ধেয়ে আসে। রঞ্জন আবারও ছুটে দৌড় দেয়। এবার টর্চের আলো আসে পেছনে। রঞ্জন টের পায়। পেছন থেকে একটা গুলির আওয়াজ আসে। চিৎকার আসে। রঞ্জনকে থামতে বলে। রঞ্জন থামে না। অবিরাম ছুটে চলে।
এবার সামনে এক ম্যানহল আসে, ডাকনা নেই। রঞ্জন ঢুকে পড়ে। ভেতরের গন্ধে রঞ্জনের আবারও বোমি আসে। ম্যানহলের ভেতরে নাকি বিষাক্ত গ্যাস থাকে। ওই গ্যাসে রঞ্জনের দম বন্ধ হয়ে আসে। এসবের মধ্যেও ইচ্ছা হয় একটা সিগারেট ধরানোর। পকেটে বেনসন লাইট আছে। ম্যাচ আছে। ম্যানহলের কোনা দিয়ে সিঁড়িতে এক হাতে ঝুলে থাকা অবস্থায় ইচ্ছা হয় সিগারেট ধরানোর। কিন্তু সে ভয় পায়। ওই আগুনের আলোয় গুলিওয়ালাদের কাছে ধরা খেতে পারে। সে ধরায় না।
আবার ভাবে- ভেতরে গ্যাস আছে। দিয়াশলাই ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে রঞ্জন। যেমনটা হয়েছিল বাবা। গেলবারের রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে এক বাসের যাত্রী ছিল বাবা। রাতে ঘরের ফেরার পথে কেউ একজন বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে। এরপর বাবাকে দেখেনি রঞ্জন। দেখেছে পোড়া দেহ। পোড় খাওয়া সংগ্রামী জীবনের দেহটাও ছিল পোড়খাওয়া। কে দেখেছে সে দেহ? কেউ না। শুধু রঞ্জন দেখেছে। মাকেও দেখতে দেয়নি। জানাযা শেষে মাটি দিয়ে রঞ্জন এক বিভীষিকাময় সময় কাটিয়েছে। প্রতি রাতে দেখতে পেত বাবার পুড়ে যাওয়া শরীরটা। হালকা ধোয়া উড়ছে বাবার শরীর থেকে। ধোয়া রঞ্জনের নাকে এসে লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে, বোমি আসে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। তবুও সে চুপচাপ পড়ে থাকে। জানে না কেন বাবার পরিণতি এমন হতে হবে।

এসব ভাবতে গিয়েও দম বন্ধ হয়ে আসে রঞ্জনের। সে ম্যানহলে থাকতে পারে না। বের হয়ে আসে। এবার নিরব মনে হয়।
গুলিওয়ালারা মনে হয় চলে গেছে না পেয়ে। তবুও রঞ্জন আস্থা ফিরে পায় না। সে এদিক-সেদিক তাকায় আর হাঁটে। যে কলোনির ভেতর এতক্ষণ সে চোর-পুলিশ খেলেছে, এখন সেখান থেকে বের হয়। মেইন-রোডে উঠে সে এবার একটু জিরায়। সোডিয়াম লাইটের আলো তার চোখে লাগে। বড় বড় ট্রাক যায়। রঞ্জনের মনে তখনও আতঙ্ক। কখন না-জানি চলে আসে। রঞ্জনের গলা শুকিয়ে কাঠ।

এমন সময়ে সামনে এক কলা বোঝাই ট্রাক এসে দাঁড়ায়। রঞ্জন পেছন দিয়ে এক লাফে ওই ট্রাকের ওপর উঠে পড়ে। কেউ দেখতে পায়নি, রঞ্জন নিশ্চিত।

ওই ট্রাক চলে, রঞ্জনও চলে। এবার যেন প্রাণ বাঁচে। সে কলা বোঝাই ট্রাকের এক কোনে এসে শুয়ে ঘুমাতে চায়। তবু মরণের আতঙ্ক তার পিছু ছাড়ে না। সে উঁকি দিয়ে দেখতে চায় ট্রাকের পেছন পেছন কেউ আসে নাকি! সে বোঝে না। সে নীরব হয়ে বসে থাকে। এই ট্রাক তাকে অন্য আরেক আরেক ট্রাকের ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
রঞ্জন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ করেছে। একদিন শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাসে উঠবে। ওমন সময় রঞ্জনের সামনে এক মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে আসে। ঠিক দাদাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরই মতো। সে এসে বলল, ‘গাড়িতে ওঠেন।’ রঞ্জন বলল, ‘কেন ভাই?’
লোকটি কানের কাছে এসে বলে, ‘গাড়িতে ওঠ নাইলে খুলি উড়াইয়া দিমু।’

আতঙ্কিত রঞ্জন মাইক্রোতে ওঠে। সে মাইক্রো চলে গতিতে। ভেতরে পাঁচজন ভদ্রলোক। সুঠাম তাদের দেহ। কেউ কথা বলে না। চুপচাপ নিরবতা। মাইক্রোটা শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পার করে মোয়াখালি-বনানী হয়ে উত্তরায় চলে গেল। সেখানে এক গলির মধ্যে থামে। রঞ্জন তখনও বুঝতে পারে না- কি হচ্ছে। আতঙ্কিত রঞ্জন নির্বাক হয়ে বসে থাকে। এরা কি অপহরণকারী? নাকি অন্য কেউ।
সুঠাম দেহের একজন তার পাশে বসা ছিল। রঞ্জনকে বলল মানিব্যাগ বের করতে। রঞ্জনের মানিব্যাগে ছিল মাত্র ১০৪টাকা। তা দেখে তারা নিশ্চয়ই খেপে বুম হবে। কোনও ব্যাংকের কোনও কার্ডও নেই। এইটা দেখেও হয়তো তারা আরো হতাশ হবে। রঞ্জনের বাবার কোনো অর্থ নেই, নিতান্তই গরীব। মোটা অংকের কোনো অর্থ বাবা দিতে পারবে না।

মানিব্যাগ দেখে সত্যি সত্যিই তারা হতাশ হলো। লোকটি কষে এক চড় লাগিয়ে রঞ্জনকে বলল, ‘খানকির পোলা শাহবাগ থেকে গাড়ির গ্যাসের খরচও তোর কাছে নাই। মোবাইল আছে লগে?’ রঞ্জন বলল, না নাই।
সামনের ড্রাইভিং সিটে থাকা লোকটা বলল, ‘চুদানির পুতরে মাইরা ফালা। হাউয়া একটা ধইরা আনছি।’

রঞ্জনকে কেন জানি তারা মারেনি। কিন্তু হাত মুখ বেঁধে মাইক্রো’র সামনে থাকা এক ট্রাকের ওপর রেখে দিয়েছিল। ওই ট্রাকটিও কলা বোঝাই ট্রাক ছিল। রঞ্জনের সারারাত ওই ট্রাকেই কেটেছে। থেমে থাকা ট্রাক চলছে তো চলছেই, রঞ্জন ভয়ে সেদিন কুকড়ে ছিল। ওখান থেকে বের হওয়ার কোনও চেষ্টাই সে করেনি। অবশেষে রাত শেষ হলো, আকাশে আলো ছড়ালো। কোনও এক ব্যস্ত বাজারে রঞ্জনকে দেখলো ট্রাকের ড্রাইভার। তখন সে জানলো, ট্রাক চলে এসেছে মানিকগঞ্জ।
আজ এমনই হয়তো হবে। ভয়ে মৃত্যু আতঙ্কে রঞ্জন দিশেহারা। তার পেছন সেই মাইক্রোবাসই যেন ছুটে চলছে। রঞ্জন জানে না কোথায় গিয়ে হারাবে সে। কোথায় পাবে জীবন। বাঁচার তীব্র তাগিদ সে বহু বছর পেয়েছে। এর আগেও তার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। যখন তার বাল্যবন্ধু জাকির দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কি দোষ ছিল জাকিরের? জাকির তো লিখতো। লিখে লিখে উত্তাল হয়ে উঠতো। গল্প লিখতো, কবিতা লিখতো, গান গাইতো। জাকির কোনো রাজনীতির সঙ্গে তো ছিল না। ছিল দেশের সঙ্গে, দেশের ইতিহাসের সঙ্গে। যেই ইতিহাস জাকির হৃদয়ে ধারণ করতো। এই দেশের অন্ধ-বিবেকহীনদের কাছে যেন না চলে যায় সেই দাবিতে রাজপথে স্লোগান দিত। তবুও জাকিরকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। সে ছিল রঞ্জনের একমাত্র ভালো বন্ধু। যার সঙ্গে রঞ্জন দিনের পর দিন নিজের কষ্ট-দুঃখ-বেদনা নিয়ে আলাপ করতো।

হুট করে একদিন জাকিরকে যেন হয়ে গেল দূরের কেউ। পালিয়ে বেড়ায়। কথা বলে না কারো সঙ্গে। একদিন রঞ্জনকে এক টং দোকানে ডেকে নিয়ে বলেছিল, আমার পেছন ছায়া ঘুরে। চাপাতি নিয়ে ছায়া হাঁটে। যে কোনো সময় মাথায় পেছনের মাঝ বরাবর কোপ পড়বে। তাই প্রতিনিয়ত পালাচ্ছি।
রঞ্জন বলেছিল, পুলিশকে জানা।

উত্তরে জাকির চুপ ছিল। কিছু বলেনি। কয়েকদিন বাদে জাকির একদিন হুট করেই উপস্থিত হয় রঞ্জনের দরজার। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। জাকির সেদিন বলেছিল, সে চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। গোপনে। এই দেশে সে থাকবে না। সে আর কোনোদিন বক্তৃতা দেবে না, আর কোনোদিন কবিতা লিখবে না, আর কোনোদিন গল্প লিখবে না, আর কোনোদিন গভীর ভাবনায় হারিয়ে যাবে না।

রঞ্জনের খুব রাগ হয়েছিল। যে যুদ্ধ জাকির শুরু করলো, সেই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কেন যাবে জাকির? এমন প্রশ্নের উত্তরে জাকির বলেছিল, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ হয় নারে। মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যে ছায়া পেছনে পেছনে আসে, দেখা যায় না, ধরা যায় না। সে ছায়ার সঙ্গে মৃত্যু অনিবার্য। আমি তো বেঁচে থাকতে চাই। আমার যে আরো কত কি করার আছে।

জাকিরের পরিণতিতে হতাশায় মরে যেতে ইচ্ছে করেছিল রঞ্জনের। কিন্তু সে শেষমেষ মরেনি। সেও বেঁচে থাকতে চেয়েছে।
এমন ভাবতে ভাবতেই ট্রাকটা কষে ব্রেক চাপলো। রঞ্জন শক্ত হয়ে বসে ছিল। ট্রাকের ওপর উঠে আসলো বাহিনীর এক সুঠাম দেহের লোক। উঠেই বলল, স্যার পাইয়া গেছি।

২.
রঞ্জনের চোখ বন্ধ। সে আর চোখ খুলেনি। ভেবেছিল ওখানেই গুলিটা তার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে। আসলে সে ভুল ভেবেছিল। রঞ্জনকে তারা নিচে নামালো। তার গায়ে কেউ হাত দেয়নি। বরং এক অফিসারের হাতে পানির বোতল ছিল। রঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘পানি খাবেন?’ রঞ্জন মাথা নাড়লো। পানির বোতল নিয়ে ঢগঢগ করে পুরো বোতল খালি করলো।
রঞ্জনকে অফিসার জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি থানায় কার নামে মামলা করছেন?’
- জলিল চৌধুরীর নামে।
কেন মামলা করছেন?
- সে আমার মা-রে খুন করছে।

আপনি দেখছেন?
- জ্বি না। আমি জানি।

কিভাবে জানেন?
- আমার বাবাকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য আমি মামলা করেছি। তারপর জলিল আমাদের হুমকি দিয়েছিল- মামলা না উঠালে মেরে ফেলবে।

এতেই বুঝলেন, সে আপনের মা-রে খুন করছে?
- হ্যাঁ। সে বলছিল, রাজি না হইলে খুন করবো।

মামলাটা উঠান।
- না উঠামু না।

-না উঠাইলে মাইরা ফেলবো। কাক-পক্ষীও লাশ পাইবো না।
- না পাক। মামলা উঠামু না। মামলা চলবে।

অফিসার কানের কাছে এসে বলল, আপনার বাবা মারা গেছে বিরোধী দলের পেট্রোল বোমায়। এতে সরকারের কি দোষ?
রঞ্জন লাল-লাল চোখে অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, এজন্যই তো দুজনই দায়ী। একজন পেট্রোল বোমা মারছে, আরেকজন সেই বোমা বন্ধে ব্যর্থ হইছে। তাই বিচার চাইলাম রাষ্ট্রের কাছে।

অফিসার বলল, বুঝলাম তো জলিল চৌধুরী তো সামান্য নেতা তারে কেন আপনার মায়ের খুনের দায় দিতেছেন।
-কারণ সেই খুন করছে। সে আমারে সরাসরি হুমকি দিছিল।

অফিসার হাসে। হাসে আর বলে, হুমকি দিলেই তার দায় আপনে ওনারে দিবেন কেন। মামলা উঠান। মোটা অংকের টাকা পাবেন। মিডিয়ায় বিষয়টা জানাজানি হইয়া গেছে। সাংবাদিকরা জ্বালানো শুরু করছে। আর নেতার নামে মামলা দিয়াও কি লাভ? দুইদিন পর সব ঠাণ্ডা হইয়া যাইবো।
রঞ্জন শক্ত হয়ে বলে, একটা মামলাও উঠামু না।
অফিসার চুপ থাকে। এরপর একজনকে ডেকে বলল, ওই ওরে গাড়িত ওঠা।

৩.
মাইক্রো চলছে। কি এক জীবন রঞ্জনের। দাদাকে ধরে নিয়ে গেল মাইক্রোবাসে, বাবার লাশ সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রওনা দিয়েছিল মাইক্রোবাসে, মা’র রক্তাক্ত দেহ রঞ্জন মাইক্রো করেই হাসপাতাল নিয়েছিল। মাইক্রো’র মতো অ্যাম্বুলেন্স।
আজ রঞ্জনও চলছে মাইক্রোতে।

মা’র কথা খুব মনে পড়ছে রঞ্জনের। মৃত্যুর কয়েকঘণ্টা আগেও রঞ্জন ঘরেই ছিল। বিদ্যুৎ চলে গেল। মা বলল, রঞ্জন-রে ঘরটা অন্ধকার হইয়া আছে, একটা মোম জ্বালায়া দে বাপ।

ঘরে মোম ছিল না। রঞ্জন বলল, আম্মা মোম নিয়া আসি। অন্ধকারে মাকে রেখে বের হলো রঞ্জন। কতক্ষণ হবে? সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট।

এসেই অন্ধকারে মাকে খোঁজে রঞ্জন। চারিদিকে নীরব-নিথর। রঞ্জন পকেট থেকে ম্যাচ বের করে মোম ধরিয়ে মা’কে খোঁজে। দেখে ডায়নিংয়ের এক কোনে রক্তাক্ত মা পড়ে আছে। মোমের আলোয় রক্তকে বড় ভয়ঙ্কর মনে হয় রঞ্জনের। মা নেই, তবুও গোঙাচ্ছিল রঞ্জন। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। মোমটা হুট করে পড়ে যায়, নিভে যায়। রঞ্জন তবুও আওয়াজ করতে পারে না।

পুরো একটি পরিবারের ধ্বংসের সাক্ষী যেন সে একাই। কেন-কি কারণে-কোন অপরাধে এই শহরের এক গলির পরিবার এভাবেই মিশে গেল? এর কোনও উত্তর রঞ্জনের কাছে নেই। আজ শেষ দিন হয়তো তার নিজের।

রঞ্জন মাইক্রোতে বসে থাকে। মাইক্রোবাস চলে। জানালার ফাঁক দিয়ে হিম-শীতল বাতাস রঞ্জনের গালে এসে লাগে। বড় আরাম লাগে। আকাশে সাদা ধবধবে চাঁদ। চাঁদের আলো যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে। রঞ্জনের বড় ভালো লাগে।

মাইক্রো চলতে চলতে থামে এক বিশাল ফাঁকা জায়গায়। চাঁদের আলোয় রঞ্জন খোলা প্রান্তর দেখতে পায়। রঞ্জনের মাথায় বন্দুক তাক করা। রঞ্জন জানে মুহূর্তেই এই আলো নিভে আসবে। মুহূর্তেই এই প্রাণ মিশে যাবে জ্যো¯œায়। হারিয়ে যাবে অজানায়।

রঞ্জনকে বলা হয়- দৌড়া।

রঞ্জন বুঝে না। আকাশে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। চিৎকার করে বলা হয়- দৌড়া।

রঞ্জন বড় ক্লান্ত। দৌড়াতে পারে না। সে দাঁড়িয়েই থাকে। তবুও তারা চিৎকার করে বলে- দৌড়া।

রঞ্জন এবার দৌড়ানো শুরু করে। ভাবে হয়তো বাঁচার কোনও সুযোগ সে পেয়ে গেল। রঞ্জন দৌড়ায়। দৌড়ের বেগ বাড়ে। বন্দুকের গুলির আওয়াজ আসে। রঞ্জন তবুও ছুটে চলে। এই রাত তার বড় ভয়ঙ্কর মনে হয়। ছুটতে ছুটতে এই ভয়ঙ্কর রাত সে পার হতে চায়। রঞ্জন ভাবে রাতটা পার করে দেবে এক দৌড়ে। রঞ্জন দৌড়াতেই থাকে। গুলির আওয়াজও চলতে থাকে। এভাবেই রঞ্জন আটকে যায় এক অজানা অচেনা অন্ধকার মোড়ানো গভীর রাতে। যে রাতে জ্যোৎস্না ছিল তবুও ঢেকে গিয়েছিল কালো মেঘে।

বইটির প্রকাশক আদর্শ।
মূল্য ২০০ টাকা
রকমারি থেকেও কিনতে পারেন। ক্লিক করুন: এই ঘরে কোনো খুনি নেই

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×