somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই পড়ার বিরুদ্ধে

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের দেশে ট্রেনে-বাসের যাত্রীদের, পার্কে অবসর সময় কাটাতে আসা মানুষকে প্রকাশ্যে বই পড়তে দেখেন কি? বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করা আমাদের নিত্য জীবনের রুটিনে বাঁধা। এই অপেক্ষার সময় বই পড়ার অভ্যাস খুব একটা দেখা যায় কি? ফেব্রুয়ারির বইমেলা শুরু হলে ঘটা করে বই পড়া এবং কেনার যে উচ্ছ্বাস সেটা ক্ষণস্থায়ী, বই পড়া নিয়ে সাধারণ মানুষদের মনে বরং আছে একটা তীব্র বিরুদ্ধতা, আছে জনমানসে বই পড়ুয়াদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব। দু-পাতা বইপড়া বিদ্যা দিয়ে তো দুনিয়া চলে না। দুনিয়া আসলে চলে কি দিয়ে? অতি বাস্তববাদী সাংসারিক মানুষ চাল-ডাল-তেল-নুনের হিসাব নিকাশ করে চলতে গিয়ে বই পড়াকে বিলাসিতা মনে করে। সাংসারিক মানুষ জীবন-যুদ্ধের নিত্য কাজে যা জানে বই পড়ুয়ারা তাদের সেই জাগতিক জ্ঞানের কাছে দুগ্ধপোষস্য শিশু। জাতি হিসেবে বই পড়বার ব্যাপারে আমাদের প্রবল অনীহা। আমাদের প্রাত্যহিক পারিবারিক জীবনে বই পড়ার বিরুদ্ধে অভিভাবকেরা। বিচিত্র পাঠাভ্যাস মোটামুটিভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। বইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আছে একশো একটা অকাট্য যুক্তি। বই পড়া মানে সময় নষ্ট। বই পড়া আমাদের জীবনে এক নিরানন্দ একঘেয়ে কাজ যেটি আমরা কেবল পরীক্ষা পাশের জন্যে করি, চাকুরী পাওয়ার জন্যে করে থাকি। পরীক্ষা আর চাকরীর প্রয়োজন না থাকলে কে বই পড়তো? স্বেচ্ছায় মনের আনন্দে কে বই পড়ে? কবিতা মুখস্ত করে দাঁড়ি, কমাসহ লেখার বুদ্ধি কোন প্রতিভাবানের আল্লাহ মালুম। তরুণ মনের কবিতা পড়ার আনন্দকে এভাবেই অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয় স্কুল। স্কুল জীবন থেকেই বই-পুস্তককে শিশুদের জীবনে এক দুর্বহ ভার হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা কাউকে ভয় দেখানোর সময় হুমকি দিয়ে বলি “তোকে এমন শিক্ষা দেবো না, যে বাপের নাম ভুলে যাবি”, “এই নিয়া তোমারে পড়ানো হবে”, ইত্যাদি। পড়ানো, পড়া – এই ক্রিয়াগুলো আমাদের মনের ভেতরে গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। ‘পড়ানো’ একটা সহিংসতা আর পাঠক নিষ্ক্রিয় ভিকটিম। এতে ক্ষমতাবান পড়ায়, পড়ে ক্ষমতাহীন। তাই কেউ কিছু জানাতে চাইলে আমরা আক্রান্ত হই, ক্ষেপে যাই, “আমাকে শেখাতে আসছিস?” আমার আত্মসম্মানে লাগে। তদুপরি ‘পড়া’ ক্রিয়াটি এদেশে এলিট সংস্কৃতির প্রতীক, তাই তা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধিপত্যের প্রতীক। পড়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তাই এদেশে বিপ্লবী বোলচালে ঢুকে আছে। সব চেয়ে বড় কথা, পড়বার ফুর্তিটা নেই। বই পড়ার বিরুদ্ধাচরণ সংস্কৃতির গভীরে শেকড় ছড়িয়ে ফেলেছে। তাই পড়ার বিরুদ্ধতার সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলা বলতে গিয়ে নিজেই বাস্তবতা বিবর্জিত এবং একঘেয়ে পুস্তকের কীট সাব্যাস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়। সেই ঝুঁকিটা আমাদের কাউকে না কাউকে নিতে হবে।

বই পড়বার, পাঠক গড়বার সামাজিক আন্দোলনকে আমাদের দেশের অনেক বিপ্লবীর না-পছন্দ। বই পড়ে সমাজ বদলায় না, মানুষ বদলায় না, জাতি গঠন করা যায় না। আজকে ক্যাপিটাল পড়লে কালকেই আপনাকে সমাজবিপ্লবে ঝাঁপায়ে পড়তে হবে। নয়া উদারবাদী সমাজে বই আর দশটা পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়, তাই বই পড়ার সাথে মানস গঠনের কোন সম্পর্কও নাই। আর দশটা পণ্যের ভোক্তা হতে কোন বাঁধা নেই, বাঁধা কেবল বইয়ে বেলায়। অন্য পণ্যের কাছ থেকে তো সমাজবদলের আকাঙ্ক্ষা রাখেন না, তাহলে বইয়ের কাছে রাখেন কেন? আপনি অলস, অকর্মণ্য, অপদার্থ, আপনি চেয়ার থেকে নড়বেন না, আপনাকে নড়াবে বই? বইয়ের মত একটি জড়বস্তুর কাছে এতো উচ্চাশা কেন? আপনি চিন্তার সুযোগ কিভাবে তৈরি করছেন? আপনার সক্রিয়তা কই? একে অপরের চিন্তার সাথে যোগাযোগের রাস্তায় বই না রেখে কি রাখতে চান? চিন্তার যোগাযোগে বই ছাড়া আর কোন কোন বাহনের আশ্রয় নেবেন? এর কি জবাব হতে পারে আমার জানা নেই। একবার আমি “জীবন বদলে দেয়া মহামূল্যবান ১০ টি বই” এমন একটি প্রবন্ধ শেয়ার করেছিলেম। আমার এক বন্ধু মন্তব্য করলো, বই জীবন বদলে দিয়ে পারে এ সব হাস্যকর কথা।কথাটা খুব অযৌক্তিক নয়। আপনি যেদিন বদলাবার জন্যে প্রস্তুত, সেদিন হামানদিস্তাও আপনার জীবন বদলে দিতে পারে। যেদিন আপনি প্রস্তুত নন, সেদিন কোরান- পুরাণ- বাইবেল- ক্যাপিটাল-মহাভারত- অরিজিন অফ স্পিসিস- ইন্টারপ্রেটেশন অব ড্রিমস - কোনটাই আপনার অন্তরের গুহায় প্রবেশ করতে পারবে না। আপনি যে সক্রিয় পাঠক নন, তার দায় বইয়ের কেন হবে?

অলসভাবে বই পড়ার পরিবর্তে অলসভাবে টিভি-ভিডিও দেখলে কিন্তু কেউ আক্রান্ত বোধ করে না। আপনি জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারেন, ফেসবুকে লাইক গোনার সময় পাবেন, ইউটিউবে আপনার নানা প্রকার গসিপ ভিডিও দেখার সময় আছে, বাজার করার সময় আছে, বিল দেয়ার সময় আছে, বাচ্চার স্কুলের সামনে চাদর বিছিয়ে প্যাঁচাল পাড়ার সময় আছে, কিন্তু বই পড়ার সময় নাই। বই পড়বে কেবল আঁতেলরা, শ্রমিক-কৃষক, কেরানী, সাধারণ শিক্ষার্থী, গৃহিণী, মুদি দোকানদার, দর্জি, কাজের বুয়া বই পড়বে না। কেন? আমজনতা বই পড়বে না কেন? বাংলা ভাষায় রচিত রান্নার বই থেকে শুরু করে, ব্যায়াম, ঘরসাজানো, ফ্যাশন, ডায়েট, জলবায়ু পরিবর্তন, আত্মজীবনী, ভ্রমণ-কাহিনী, শিশু-কিশোরদের গল্প, জীবনযাপন, ইতিহাস, দর্শন, উপন্যাস, গল্প, কবিতা – বিচিত্র বিষয়ে বই পড়া আমজনতার খাদ্য তালিকায় আসা সম্ভব নয় কেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে বই পড়বার সংস্কৃতি থাকতে পারতো। কিন্তু হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিও বইপড়ার বিরুদ্ধে। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, বিশ্ববিদ্যালয়েও খুব সামান্য মানুষ পড়ে। পরীক্ষা, প্রমোশন, পাবলিকেশন, কনসালটেন্সি ছাড়া পড়বার আর কোন প্রণোদনা নাই। যারা পড়ুয়া, বন্ধুরা তাদের হয় একধরনের তাচ্ছিল্য করে, অথবা ভয় পায়।শিক্ষকতায় যোগ দিতে চাওয়া শিক্ষার্থী ছাড়া বাকি শিক্ষার্থীরা নিজের সক্রিয় পাঠাভ্যাসে নিজের জানা–বোঝা গড়ে তোলার কোন প্রেরণা খুঁজে পায় না। অধিকাংশ পড়ুয়ারা বিসিএসের বই ছাড়া আর কোন বই জীবনে কাজে লাগবে মনে করে না। সেমিনার রুমে যে শিক্ষার্থী পড়তে চেষ্টা করে, তাকে বন্ধুদের হাতে এক রকমের লাঞ্ছিত হতে হয়। আমি দেখেছি, যারা পড়ে, তারা বন্ধুদের সাথে নিজের পড়ার বিষয়টি গোপন করে। বই হাতে সেমিনারে, শিক্ষক লাউঞ্জে, বাসে, মাঠে, বেঞ্চিতে কোথাও বসে শান্তি পাবেন না। বই হাতে দেখলেই লোকে আপনাকে প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করে ছাড়বেঃ কি বই পড়েন? গল্পের বই? না পড়ার বই? বুঝতে চেষ্টা করে, এখানে বসে আপনি পড়ছেন কেন? আপনার কোন কাজ নেই? প্রকাশ্যে কেউ বই পড়লে আশেপাশের লোকেরা হঠাৎ আক্রান্ত বোধ করে। প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করলে আক্রান্ত বোধ করে কি? কেউ বেশী জেনে ফেলতে পারবে না, কারো কাছ থেকে জানা- বোঝা-শেখারও কোন প্রয়োজন আমার নেই নেই।কোন গম্ভীর বিষয়ে আপনি আলাপ করবেন না, রসাত্মক-তির্যক মন্তব্য করবেন না, সারাক্ষণ মাথা নাড়বেন, হে হে আর ফাতরামী করতে থাকবেন। আপনি যে একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি, শিল্প-রসিক, সাহিত্যে আপনার অগাধ জ্ঞান, আপনি যে নিজেই একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক, ভাবুক, বক্তা, কবি, তাকে লুকিয়ে আপনার সবচেয়ে ঘিয়ে ভাজা আটপৌরে চেহারাটা নিয়ে জনসম্মুখে হাজির হলেই সামাজিক আলাপচারিতায় ‘বেইল’ পাবেন। জাতি হিসেবে আমরা বই পড়ার বিরুদ্ধে।

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৪৫
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×