somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মতুয়া

৩০ শে মার্চ, ২০২১ ভোর ৬:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মতুয়া

দক্ষিণ এশিয়ার বহুত্ববাদী বুনটের জীবন্ত সাক্ষ্য এবং জাতিরাষ্ট্রের সমাজসমূহের আন্তঃপ্রবিষ্টতা


মোদীর আগমনের সুবাদে হঠাৎ করে আমাদের সম্পূর্ণ অজানা এক দেশী ভাইবোনের সন্ধান পেলাম, যাদের নাম মতুয়া।
মতুয়া সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ইতিহাস হঠাৎ করে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথা বলে উঠলো ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের মঞ্চে। রাষ্ট্র আর রাজনীতি নিয়ে মনোযোগের আতিশয্যে এবং রাজনৈতিক মহা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ঘনঘটায় আমরা ভুলেই গেছি সমাজ বলে কিছু আছে, সম্প্রদায় বলে কিছু আছে, জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার বলেও আমাদের কিছু ছিল বা আছে। মতুয়া সম্প্রদায় কেবল একটি মুহূর্তেই তল থেকে সংবাদের পাতায় আবির্ভূত হল, যখন বাংলাদেশ এবং ভারতে রাজনীতির কোথাও তাঁদের একটা কর্তাসত্তা সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রাজনীতির সাথে সমাজের ক্ষমতা ছেদ করেছে। এখন প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আগত অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্যে কেন বাংলাদেশের গোলাপগঞ্জে মতুয়াদের প্রধান তীর্থস্থান ওড়াকান্দি সফর এতো গুরুত্বপূর্ণ?

মতুয়া গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ওড়াকান্দির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এই ভুলে যাওয়া ভাইবোনদের সম্পর্কে খোঁজখবর করে জানতে পেলামঃ

গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে প্রায় ২১০ বছর আগে জন্ম হয় হরিচাঁদ ঠাকুরের, যিনি এই মতুয়া সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করে মতুয়া মতবাদ।ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাসস্থান ও এর আশেপাশের এলাকা মতুয়াদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। মতুয়াদের প্রধান মন্দিরও এখানেই অবস্থিত। "হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের 'লীলাক্ষেত্র' - অর্থাৎ তারা যেখানে থেকেছেন, ধর্ম প্রচার করেছেন, তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল - মতুয়াদের কাছে তীর্থস্থান", বলছিলেন কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর, যিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধরও।পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের মোট ২৯৪টি বিধানসভার ১৪টি বিধানসভার আসনের ফল পুরোপুরি নির্ভর করে মতুয়া ভোটের ওপর। আর মোট ৬০ থেকে ৭০টি বিধানসভার আসনে ৫ থেকে ১০ হাজার করে মতুয়া ভোটার রয়েছে, যা এবারের বাস্তবতায় ফলাফলের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে বলা হচ্ছে। - বিবিসি
মতুয়া ধর্মের ভিত্তি হল, আদর্শ গারহস্ত জীবন-যাপনে নিবেদন । মতুয়ারা ১২টি মূলনীতি পালন করে যাদের ১২ আজ্ঞা বলা হয়। মতুয়া ধর্মে নারী পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে, বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করা হয়েছে। নারীপুরুষ যে কেউ এই ধর্ম প্রচার করতে পারে। এক কোটি মতুয়া এই ভাবধারায় জীবন যাপন করছেন। এমন একটা মানবতাবাদী জীবনবাদী ধর্ম, জীবন দর্শনের জন্ম এই বাংলাদেশের মাটিতেই হয়েছে জেনে অবাক এবং আনন্দিত হলাম।

১৮৬০ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রবর্তিত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের এই ধর্মীয় আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতের অগণিত প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ-ভারতে ১৮৫৭ সালের আগেও অন্তত ২০০ টি প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো, যা তাঁর বিবেচনায় ব্রিটিশ-ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র, আকার-আকৃতি-প্রকৃতি ঠিক করে দেয়। কেবল ব্রিটিশদের উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া ইউরোপীয় ধাঁচের রাষ্ট্রকাঠামোই আমরা পেয়েছি, তা নয়; পশ্চিমা জাতিরাষ্ট্রের মডেল সেটা আসলে এককভাবে একচেটিয়াভাবে করতে পারেনি। তল থেকে আসা অগণিত প্রতিরোধও ক্ষমতার কাঠামো- আকৃতি-প্রকৃতি স্থির করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন এই রাষ্ট্রগুলো ঐতিহাসিকভাবে এই সব প্রতিরোধের মুখে ভিন্নরকম নিজস্ব চরিত্র নিয়েছে।

ইতিহাসের এবং আমাদের বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রের প্রতি অতি মাত্রায় ঝোঁক এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে আমরা দেখতে পাই না যে, কিভাবে সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা নিরন্তর প্রতিরোধ-শক্তি ব্রিটিশ-ভারত এবং পরবর্তীকালের স্বাধীন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বার্মার মতো রাষ্ট্রকে বার বার নিজের মতো করে বদলে দেয়, নিজের আকারে গড়ে তোলে এবং ক্ষমতার খেলায় আপাতভাবে বেমক্কা নিজের বিরাশি শিক্কার দেশী এক চাল দিয়ে বসে। মতুয়া সম্প্রদায় দেশজ সমাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মাটির গভীর শেকড় থেকে আজকের ইতিহাসের খেলায় তাঁর নিজস্ব নিয়মে নিজস্ব স্বর শুনিয়ে দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভোট ব্যাংকে তাঁদের এই প্রভাব এবং পশ্চিমবঙ্গের বামজোটের সেই ভোট ব্যাংকে ঢোকার জন্যে মোদীর বাংলাদেশে অবস্থিত তীর্থক্ষেত্র দর্শন, এবং ঠাকুরবাড়ী দর্শন আমাদের সামনে কয়েকটি শিক্ষা হাজির করেঃ

১। সমাজের ভেতর যে আন্দোলনগুলো জৈবভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে বিরাজ করে, সেগুলো নিজের পদ্ধতিতে রাজনীতিতে কর্তা হয়ে কাজ করে, সক্রিয় থাকে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীতার কিম্বা গণমাধ্যমের রাষ্ট্রবাদী লেন্সে সেটা ধরা পড়ে না।

২। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের আগের ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামগুলো আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাসই শুধু নয়। সেটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য বর্তমান।

৩। মতুয়াদের মতো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সম্প্রদায় এবং সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনকে এখনকার মাঠে ময়দানের গনতন্ত্রকামী এবং বৈষম্য-বিরোধী সংগঠনগুলোর চিনে নেয়া প্রয়োজন।

৪। এমন অসংখ্য সমাজ এবং সম্প্রদায়, জ্ঞাতিগোষ্ঠী জাতিরাষ্ট্রের তলায় পাটাতন হয়ে আছে, যারা ভীষণভাবে জীবন্ত এবং সক্রিয়, যাকে আধুনিক গণতন্ত্রের নাগরিক সমাজের সেকুলার মিটিং, মিছিলকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও রাজপথের সংগ্রাম রচয়িতারা বুঝতে পারেন না। কট্টর সেকুলারদের কাতারে অনেক সময় গনমানুষ তাঁর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চর্চা, জীবনধারা নিয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পায় না।

৫। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-বার্মা, ব্রিটিশ-ভারতের রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর সৃষ্টি হয়েছে বলে এই অঞ্চলের একটা সাধারণ অতীতের মতো একটা সাধারণ বর্তমানও আছে। সেটা ভবিষ্যতের স্বার্থেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়। নয়তো ভারতীয় কর্পোরেট হিন্দুত্ববাদী আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বোঝাবুঝি ত্রুটিপূর্ণ থাকবে।

৬। মতুয়াদের মতো সম্প্রদায়গুলো যারা দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর বহুত্ববাদী পরমতসহিষ্ণু ন্যায়বিচারের বুনন জৈবভাবে এই মাটিতে বুনে রেখেছেন, সেই বুননকে ছিন্ন করবার প্রচেষ্টা প্রতিহত করবার উপাদান এই সমাজের ভেতরেই আছে। রাষ্ট্রবাদী চিন্তুকদের সেটা মাথায় নিতে হবে।তাহলে একটা সার্বক্ষণিক সেকুলার হতাশার চাষবাস অনেকাংশে বন্ধ করার সুযোগ আসবে।

ছবি ১ঃ Voboghure Kothamala, Mar 27, 2017
ছবি ২ঃ The Daily Star

তথ্যসূত্রঃ

https://www.bbc.com/bengali/news-56497194
https://www.news18.com/.../explaining-pm-modis-matua...
https://sanatanpandit.com/what-is-matua

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০২১ ভোর ৬:৪৮
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×