somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মঙ্গল শোভাযাত্রার অমঙ্গল বিষয়ক দুপ্রস্থ

১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তি-আপত্তিগুলো, চারুকলার বৈশাখী/মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইসলামিক ইনক্লুসিভ করবার যে আকাঙ্ক্ষা কিছুদিন ধরে প্রকাশিত হল, তা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত (উদাহরণ, ফাইজ তায়েব আহমেদ)। কোন আমলে, কোন রেজিমে বসে কোন সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে, প্রথমে সেটা unpack করে নেয়া চাই। আমরা, কোন রেজিমে কোন সংস্কৃতি করা হচ্ছে, সেটাকে ফোকাসে রাখবো।ইসলামের যে ধারাগুলো এখন ক্ষমতার সাথে মিশে আছে(সেগুলোর অন্যতম প্রধান ওয়াহাবি/আহলে হাদিস),সেই পন্থায় শিল্পচর্চা/সঙ্গীতের কোন বিদ্যালয়েরই অস্তিত্ব থাকবার কথা নয়, সেখানে সঙ্গীত, চারুকলার কোন চর্চাই থাকা সম্ভব নয়। তাই, পহেলা বৈশাখের এই শোভাযাত্রা এর সাথে by default mutually exclusive ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিরাট আলোচনা/বাহাসকে খুব সংক্ষেপে সমস্যায়িত করলে বলা যায়, সংস্কৃতির কোন উপাদান, কোন অভ্যাসই চিরায়ত নয়।এই ভাবনাটাই ঔপনিবেশিক। এই "চিরায়ত" "চিরায়ত" করাটা এসেছে ব্রিটিশ ফাংশনালিস্টদের অপশ্চিমের সংস্কৃতিকে "অনড়" "অচল" "গতিহীন" দেখানোর চর্চা থেকে। এই কলোনিয়াল অবস্থান অনেক বছর হল খোদ পশ্চিমেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মূলধারায় হয় নাই।পণ্ডিত আনিসুজ্জামান/সূফী মুস্তাফিজদের মত "চিরায়ত হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি"র প্রবক্তারা একে প্রায় একটা ধর্মীয় ধরনের আনুগত্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা দিনের শেষে দেশীয় বুর্জোয়াদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে সমর্থন যোগায়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের পত্তনকালে ইউরোপেও জাতীয়তাবাদী/সুশীলরা গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে তাদের পছন্দ মত উপাদান বাছাই করে গোটা জাতির সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যেমন নরওয়ের কথা বলেছেন নরওয়েজিয়ান নৃবিজ্ঞানী এরিক্সেন। জাতীয় পরিচয় ও প্রতীক গড়ে তুলতে নরওয়ের গ্রামীণ সংস্কৃতির কিছু উপাদানকে শহুরে এলিটরা খুঁজে খুঁজে তুলে নিয়ে আসে।ফেলে আসা জীবনের প্রতি এক ধরনের এগ্রিকালচারাল নস্টালজিয়ার অনুভূতি উদযাপন করে। "একদিন বাঙ্গালী ছিলাম রে" - ধরনের এক মোহময় বেদনা বোধ করে। বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রেও খানিকটা কাছাকাছি জিনিসই ঘটেছে।কৃষক-শ্রমিক-আম জনতার সংস্কৃতির বিরাট বৈচিত্র্যময় উপাদানগুলোকে অদৃশ্য করে, বা অস্বীকার করে, জাতি গঠনের নামে সুবিধাজনক কিছু কিছু জিনিস বাছাই করে সুশীলরা জাতীয় সংস্কৃতিকে এক প্রকার হাইজ্যাক করে ফেলে। পকেটস্থ করে। তারা ক্ষমতার দাপটে এমন ট্র্যাডিশনকে ইনভেন্ট করে, যার আদতে কোন অস্তিত্বই ছিল না, যে কারণে অভিজাত নাগরিকদের মধ্যে পান্তা খাওয়ার মকারি চলে, যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রার মত ট্র্যাডিশনের সূচনা করা হয়। এই শোভাযাত্রাসহ নাগরিক নববর্ষ পালনের তরীকা একটা আবিষ্কৃত সংস্কৃতি হলেও সেটা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে।দিনে দিনে দেশজুড়ে প্রসারিত হয়েছে।আবিষ্কৃত হয়েছে বলে তাকে বাতিল করা যায় কি? সংস্কৃতি সব সময়েই মানুষের প্রয়োজন-পরিস্থিতিতে আবিষ্কৃত ও চর্চিত। এই শোভাযাত্রার উপর ক্রমাগত নানামুখী আঘাত আসাই বলে দেয়, এর সাথে ক্ষমতার স্বার্থ আছে, তৎপরতা আছে, সারভেলেন্স আছে।বিশেষ করে এই ট্র্যাডিশন এসেছে পাকিস্তান আমলে চাপিয়ে দেয়া ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, যা আমাদের কালেক্টিভ মেমরির অংশ, এবং সেটা আমরা ভুলে যেতে পারি না। কেন ভুলে যাব যে, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামেওমঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল? মঙ্গল শোভাযাত্রা ঔপনিবেশিক রূপান্তরের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধের চৈতন্যের অংশ, হতে পারে তা খণ্ডিত এবং দেশজ বুর্জোয়াদের করায়ত্ব।

কয়েকদিন ধরে বাংলা ভাষার "মঙ্গল" শব্দটির প্রতি ( ইংরেজিতে well- being/wellness) অসহিষ্ণুতা বেশ বিস্ময়কররকম বর্ণবাদী শোনাচ্ছে।মঙ্গলের বিরোধিতা করতে গিয়ে "নববর্ষ উদযাপন হাজার বছরের নয়, ইসলামের সংস্কৃতি হাজার বছরের" - এমনটা শুনতে বেশ চটকদার শোনায়, কিন্তু এই ধরনের বাৎচিতের ঝামেলা হল, সেই কালেক্তিভ মেমরিকে অস্বীকার করা। কোন সংস্কৃতিকেই প্রাচীনত্বের গুণে তাকে বেশী ভ্যালিড ভাবা, আরেকটিকে খারিজ করা এক ধরনের অপরাজনীতি।কোন ক্ষমতার মধ্যে আমরা এই মুহূর্তে বাস করছি, সেটা আমলে না এনে, "চিরায়ত", "স্থির", "অনড়", "পরিবর্তনহীন", "সমাজসংহতি গঠনকারী" এক একক বাংলা সংস্কৃতিকে কল্পনা যেমন জাতীয়তাবাদী সুশীল সমাজের প্রকল্প এবং বহুবাদের অস্বীকৃতি, তেমনি বাংলার ইসলামকে হাজার বছরের এক অখণ্ড সংস্কৃতি হিসাবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গীও একেবারেই অনৈতিহাসিক। বাংলার ইসলামের প্রবর্তন, ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে এবং আমজনতার ধর্ম রূপে কায়েম করাবর কাজ যারা করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন আরব, সিরিয়া, ইয়েমেন, তুরস্ক, ইরান - অঞ্চল থেকে আগত সূফী-সাধক।১২০৭ এ বখতিয়ার খলজির রাজনৈতিক বিজয়ের আগেই দ্বাদশ শতাব্দীতে ময়মন্সিংহে প্রথম ইসলামের প্রবর্তনে দুজন সূফী সাধকের কথা জানা যায়।এই হাজার বছরের ইতিহাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকা সবচেয়ে ইনক্লুসিভ ধারা সূফীবাদকে এখনকার উত্তর-ঔপনিবেশিক জমানায় প্রায় কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে।শত শত বছর ধরে সারা বাংলা জুড়ে সূফী-সাধকদের ধর্ম-সাধনায় সর্বজাতি-ধর্মের মানুষের বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়ে যে সংস্কৃতির শেকড় অরগানিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেখান থেকে ইসলামী জীবনধারার গভীর এক ঔপনিবেশিক রূপান্তর ঘটেছে, বিপ্লবী এবং প্রতিক্রিয়াশীল- উভয়ধারাতেই ইসলামী ভাবধারার বিকশিত হয়েছে, চর্চা করা হয়েছে (এখানে মনে রাখা ভাল যে, পবিত্র কোরআন ঐশী ও অপরিবর্তনীয়, কিন্তু যেভাবে মানুষ তাকে আমল করে তা কিন্তু ইহজাগতিক।ঐশী কোরআন পরিবর্তন অসম্ভব, কিন্তু একে চর্চার সংস্কৃতি মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং বিভিন্ন সময়ে একরকম ছিল না, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তাফসীর ও আমলের ভেদ হয়েছে)। সুতরাং ইসলামী সংস্কৃতি বলে কোন এক পন্থা নাই। সংস্কৃতি হিসেবে ইসলাম এক নয়, অনেক রকম।

উত্তর-আধুনিক জমানায় বিশ্বের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ, এবং ইসলামোফোবিয়ার প্রেক্ষাপটে ও প্রতিক্রিয়ায়, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্থান, ইরাক, সিরিয়ায় মুসলমানদের উপর ধারাবাহিক গণহত্যার ফুটন্ত বিক্ষোভে বৈশ্বিক মুসলমানদের এক আইডেন্টিটির সন্ধান চলছে। বাংলাদেশ এর পেটের ভেতরই বাস করে। এই প্রতিরোধী চেতনায় যেমন বিপ্লবী শক্তি আছে, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ারও সমূহ নজীর দেখা গেছে। প্রতিক্রিয়াশীল এমন এক ইসলামী ভাবধারাকে পুনঃপুনঃ শক্তিশালী করবার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, যা আবার বিপদজনক এক ধরনের Totalitarian Islamic State গঠন করতে চায়। এই অবস্থাটা একটা শাঁখের করাতের মত।এই শাঁখের করাতের এক ধারে সুশীলদের উদ্ভাবিত "আবহমান বাংলা সংস্কৃতি" যাতে ইসলামের উপাদানগুলোকে other করা হয়েছে, অন্যধারে Totalitarian Islamic State গঠনের প্রবল নড়াচড়া, যাতে কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী-নারী ও প্রান্তিক জনতার স্বার্থ রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:২২
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×