মাজার ভাঙাভাঙ্গি শুরু হলে আমি প্রতিবাদ করে ফেসবুকে একটা ছোট স্ট্যাটাস লিখি।সেখানে কমেন্টে আমার কলেজের এক বান্ধবী আমাকে লালসালু উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দিল। মনে পড়লো তিন দশকেরও আগে পড়া লালসালুর কথা।আমরা কচি বয়েসে বন্ধুরা একসাথে এই উপন্যাসটি পড়েছিলাম। পড়তে পড়তে এক মিথ্যা মোদাচ্ছের পীরের ভণ্ড খাদেম মজিদের বদমায়েশির প্রতি আন্তরিক ঘৃণা করা শিখেছি, মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমার মূর্খ সারল্যে নির্ভেজাল করুণা বোধ করেছি, আর কিশোরী স্ত্রী জমিলার স্পর্ধায় অনুপ্রাণিত হতে শিখেছি।মাথার মধ্যে এই নারী-পীড়ক "ভণ্ড ধার্মিক", "ধর্ম ব্যাবসায়ী", গরীব, অশিক্ষিত, আনপড়, ধুরন্ধর ও শঠ মজিদ গং এর স্ক্রিপ্ট একদম সিমেন্টের মোজাইকের মত গেঁথে গিয়েছিল।এতো বছর বাদেও আমার বান্ধবী ঠিক লালসালুর স্ক্রিপ্টে মাজারকে একটা করাপ্ট স্পেস হিসাবে আলোচনা করলো।
এটি রচনার প্রায় পৌনে একশো বছর পরেও মাজার ভাঙার পক্ষে সহানুভূতি, বৈধতা, যুক্তি, ন্যারেটিভ, যৌথ চৈতন্য, জজবা তৈরি করবার এক অব্যর্থ অস্ত্র যোগান দেয় লালসালু।যেন বাংলাদেশের সব চাইতে দুর্নীতিগ্রস্থ জায়গা এখন মাজার - বসুন্ধরা, যমুনা, সামিট গ্রুপ, এস আলম বা বেক্সিমকোর দপ্তর নয়- একাত্তর টিভি, প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার নয়।হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করবার সময় ব্যাংক বা কর্পোরেটগুলোর আখড়া ভাঙার সাহস মাজার ভাঙতে আসা এই দুঃসাহসী সত্যবাদী ইসলামপ্রেমিক বীরপুঙ্গবদের দেখেছেন কি?
"আমি জানিনা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু' এখন স্কুল-কলেজে পাঠ্য কিনা।নব্বইয়ের দশকে লালসালু আমাদের কলেজ পাঠ্য ছিল।"- সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে এই দুই বাক্য লেখার পর মনে হল, দেখি তো একবার সার্চ করে।ওমা! এইচএসসি ২০২২-২৩ এর নোটও পেয়ে গেলাম!তার মানে দশকের পর দশক ধরে ১৬-১৮ বছরের কিশোর-তরুণেরা লালসালু গুলে খেয়ে চলছে? বাংলাদেশী তরুণদের জীবনের শুরুতে কেন লালসালু আবশ্যিকভাবে পড়তেই হবে? কারা এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়? এর পেছনে নিয়তটা কি? - ভাবতে বসলাম।মগজের ভেতরে বহু বছরের জমে ওঠা ধুলি ঝেড়ে অনেক পেছনে ফিরে তাকালাম।নব্বইয়ের দশক থেকে আমার নিজের লালসালু ওয়াশ মাথাটা একের পর এক মাজার ভাঙার দৃশ্যে এই প্রথমবারের মত সন্দেহ প্রকাশ করলো। এই প্রথমবার আমি সন্দেহ করলাম।কয়েকদিন ধরে লালসালু উপন্যাসটা নতুন করে পড়লাম, এবং রাইসুল ইসলাম আসাদের মজিদ চরিত্রায়নে সিনেমাটা দেখলাম।অনেক পুরনো একটা পাজল যেন মিলতে শুরু করলো।সামাজিক গণমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে যত আলোচনা চোখে পড়লো, পড়তে শুরু করলাম।
ফরাসী স্ত্রীর পাশে ওয়ালিউল্লাহ যে কত হ্যান্ডসাম, কি সাংঘাতিক আধুনিক, তেমন বিস্ময় উদ্রেককারী সাদাকালো ফটোগ্রাফ প্রায় অনেক দিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।দেশভাগের ঠিক এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয় লালসালু।ব্রিটিশ-বিরোধী ভারত-ছাড়, স্বরাজ, স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত এনার্জি তখন তাজা থাকার কথা।হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শেষ হয়েছি কি হয়নি।সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম বছরেই আধুনিক বাংলাভাষায় যে উপন্যাস রচিত হল, তার উপজীব্য এক ভণ্ড খাদেমের মাজার ব্যাবসা।এটাই তাহলে এই সময়ের তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সমাজের মূল একটা সমস্যা ছিল? এটা কিভাবে সম্ভব হল?
দুইশত বছরের উপনিবেশের ফেলে যাওয়া শৃঙ্খল, জুলুমের ক্ষত চিহ্নগুলো, দেশজ সমাজের উপর চেপে বসা পশ্চিমা রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, আইন-আদালত-বিচার ব্যাবস্থার আমূল বদলে যাওয়া, ভূমির পুঁজিবাদী রূপান্তর, প্রথাগত লিঙ্গীয় সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়া, জমিদারি বন্দোবস্তের অবসান ঘনিয়ে আসা- এতো সব বিরাট বিরাট ঐতিহাসিক অভিঘাতগুলোতে গ্রামীণ জীবনে কি রূপান্তর এনেছিল, তার কোন আভাস কোথাও নেই! গ্রামীণ সমাজ কাঠামোতে ক্ষমতার প্রধান দ্বন্দ্ব মিথ্যা পীরের ভণ্ড খাদেমের ক্ষমতা? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে এথনোগ্রাফিক সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো তো তা বলে না। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজে সবচেয়ে বড় নিপীড়ক তাহলে পীর-আউলিয়া সম্প্রদায়? এটা কি ঐতিহাসিক সত্য? সামাজিক গবেষণাগুলো থেকে এমন তথ্য তো সে রকমভাবে উঠে আসেনি!
বরং উল্টো, ঐতিহাসিক বিবরণগুলোতে পীর-ফকির-আউলিয়া-দরবেশদের নিরন্তরভাবে কলোনি-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম, সম্প্রদায়, সংগঠন, সংস্কৃতি গড়ে তুলতে দেখা যায়।ফকির মজনু শাহ্ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে পীরের দরগাহ, খানকাহগুলোকে জনমানুষের কাতারে থেকে লড়াই-সংগ্রাম জারী রেখেছে।হিন্দু-মুসলমানকে একসাথে বুকে আশ্রয় দিয়েছে, মনোবল ও রসদ জুগিয়েছে।
এবার পড়তে গিয়ে দেখলাম, ব্রিটিশ-ভারতে শাসকের আদলে গড়ে ওঠা ইংরেজি-শিক্ষিত অধিপতি মধ্যবিত্ত্ব শ্রেণীর পশ্চিমাভাবধারার সাথে সমান্তরালে সদা-সর্বদা স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসিত এক ভৌত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক পরিসর হিসাবে এই পীর-আউলিয়াদের দরবার, মাজার, খানকাহ এর ভূমিকার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণের সাথে লালসালুর কোন মিল নেই।ইংরেজ প্রশাসক উইলিয়াম হান্টারের বাংলার মুসলমানদের দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার যে মর্যাদাবিবর্জিত বিবরণী ও পরিবেশনা, মুসলমানদের জীবন, সংস্কৃতির যে প্রাচ্যবাদী পরিবেশনার লেন্স, ওয়ালিউল্লাহ সেই ধারারই এক বাদামী দাসের মানসপুত্র মাত্র, যে কিনা দরিদ্র মুসলমানদের করুণা ছাড়া কিছু করতে অক্ষম।এই দাসচিন্তার লেন্স গরীব গ্রামীণ মুসলমানদের সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনধারার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা, ঘৃণা মিশ্রিত ভয় সৃষ্টি করে।
লালসালুর দরিদ্র মুসলমানের যে কল্পিত গ্রাম, সেই দারিদ্র্য কিভাবে সৃষ্টি হল, সেই গ্রামে ক্ষমতার লড়াইয়ে, ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে শ্রেণীগুলো কি, রাষ্ট্রের কর বা খাজনা আদায়ের বন্দোবস্ত কি রকম, জমিদারী প্রথার বিলোপের ঠিক পূর্বকালে ভূস্বামীরা কোথায়, কোন প্রশ্নের কোন জবাব সেখানে নাই।উপন্যাস শুরু হয়েছে ভীড়াক্রান্ত দরিদ্র ট্রেনযাত্রীদের বর্ণনা দিয়ে, যা রীতিমত বর্ণবাদী চরিত্রের।গ্রামীণ নারীদের একমাত্র নিষ্পেষণকারী হল, তথাকথিত "ধর্মীয় কুসংস্কার" বা "অন্ধবিশ্বাস"। লালসালু গ্রামীণ জীবন এবং কৃষকের সংগ্রাম সম্পর্কে অজ্ঞ-মূর্খ এক ভূমিজ বাদামী দাসের লিখিত এক পশ্চিমা সিভিলাইজিং প্রজেক্ট যা গ্রামীণ গরীব মুসলমানদের উপর স্পষ্টতই এক জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা ইতিহাসের মোড় ঘুরানোর সময় বাস্তব জীবনে দৃশ্যমান সহিংসতা পুনরুৎপাদন করে চলেছে, বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশে এখন আমরা যার সাক্ষী হলাম।
আমেরিকান প্রখ্যাত গবেষক রিচার্ড ইটনের পূর্ববঙ্গে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে পীর-আউলিয়াদের সাথে কৃষকদের নদী অববাহিকার ধরে আবাদী জমিকে উদ্ধার করতে করতে বাংলার গোটা সভ্যতাই গড়ে তোলার প্রামাণ্য বিবরণী দেয়া হয়েছে।হজরত শাহ্ জালাল, শাহ্ পরান, থেকে শুরু করে শাহ্ মখদুম, খান জাহান আলী, মাইজভাণ্ডারীরা দ্বাদশ শতক থেকে ইসলামকে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির দেহে একেবারে জৈবকাঠামোতে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন যে, তা এক অবিচ্ছিন্ন ও অভেদ্য আত্মসত্ত্বা সৃষ্টি করেছে।এই জৈব ইসলামের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঘৃণা ইউরো-আমেরিকান ইসলামোফোব প্রজেক্টের বাইরে নয়।এমন নয় যে আজকের এই সূফী-পীর-আওলিয়া-দরবেশদের ওপর জুলুম-নির্যাতন জারী থাকবে আর ওয়াহাবীরা পার পেয়ে যাবে।মনে করিয়ে দেয়া জরুরী যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ওয়াহাবী আন্দোলনও হয়েছিলো।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে কিছু বিশেষ বিশেষ বর্গের বা সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতা এখনও চলমান। মন্দির ভাঙার পর, এবার চলছে মাজারভাঙার পালা!কেন? মাজার কি বাংলাদেশে কোন বৈষম্য উৎপাদন করেছিলো? মাজারভাঙা কি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করবে? রাষ্ট্র সংস্কারের এজেণ্ডায় কি মাজার ভাঙার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো, না সকল বিশ্বাসের সহাবস্থানের কথা ছিল? কারা মাজার ভাঙার এই অনুমতি দিয়েছে? কাদের এই এখতিয়ার দেয়া হয়েছে? সূফী-দরবেশ-পীর-ফকির সম্প্রদায় কি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ জারী রাখতে কোন ভূমিকা রেখেছিল? নাকি, বরং, রাষ্ট্রের ভেতর একটা কর্তৃত্ববাদী ব্যাবস্থার ঊর্ধ্বে একটা অসঙ্গায়িত পরিসর রূপে বিরাজ করেছে, যেখানে নিম্নবর্গ অবাধে প্রবেশ করতে পারে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিম্বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেতর এমন কোন সম্মতি সৃষ্টি হয়েছিলো কিনা যেখানে ইসলামের অন্তর্গত বিবিধ প্র্যাকটিসগুলোকে একে অপরের নির্মূল করবার অনুমতি দেয়া হয়েছে? এই এক মাসে এই সরকারের কর্মপদ্ধতি, কিম্বা অভ্যুত্থানের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব, ছাত্র-জনতার চলমান আলোচনায় মূল উপজীব্য ছিল ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা!জনপরিসরের আলোচনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে শুনেছি, ফিলিস্তিনী- আমেরিকান পণ্ডিত এডওয়ার্ড সাঈদকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।উচ্চারিত হয়েছে, ইসলাম অনেক! ইসলাম এক না!আল্লাহ্ এক, পবিত্র কোরান এক, কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি এক না।মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে অনেক এবং বিচিত্র ইসলামী সংস্কৃতি বিরাজ করে।একটি পন্থার মুসলমানদের ভিন্ন পন্থার এবং সংস্কৃতির ইসলামের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়ার কোন সুযোগ নাই!
মাজারের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন এখনই!অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হস্তক্ষেপ দাবী করছি! অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছর থেকে আমাদের কলেজের বাচ্চাদের লালসালু ওয়াশ বন্ধ করবেন!
লালসালু ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হউক!
সেপ্টেম্বর ২-৮, ২০২৪
উইস্কন্সিন
যুক্তরাষ্ট্র
#মাজারভাঙ্গাবন্ধকরুন
#secondindependencebangladesh
#সায়েমারলেখা
#islaminbengal
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




