জুলাই অভুত্থ্যান-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারীরা হলেন দেড় হাজার+ শহীদ, যাদের রক্তস্রোতে জাতির বুকের উপর থেকে অপসারিত হয়েছে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাহাড়।বীরের সেই রক্তের দাগ এখনও শুকায় নাই।ঘরে ঘরে মাতার অশ্রুধারা এখনও বয়ে চলছে। এর ঠিক সাথেই আছেন, কুড়ি হাজার+ আহত গাজী - বুলেটবিদ্ধ, দৃষ্টিশক্তি হারানো, অঙ্গ হারানো, চলৎশক্তি হারানো আমাদের যুদ্ধাহত সন্তানেরা।এখনও একে একে তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ আসছে। তাঁদের সময়মত উন্নত চিকিৎসা করা গেলে হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচানো যেত, হয়তো অঙ্গহানি রোধ করা যেত, হয়তো দৃষ্টিশক্তি রক্ষা হত, - এই সব আহাজারি নিয়ে আমরা বেঁচে আছি।আমাদের আহত বীর সন্তানদের উন্নত সুচিকিৎসার বিস্তারিত খবর জাতি জানতে চায়।কে কোথায় কিভাবে চিকিৎসাহীন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, তার সামান্য দু-একটি খবর অন্তর কাঁপিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।একটি ছেলে বলছিল, কিভাবে তার পেটে গুলি করা হয়েছিলো, তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গিয়েছিল, নিজের হাত দিয়ে সে তার নাড়িভুঁড়ি চেপে ভেতরে ঢুকিয়েছে, বয়েসে হয়তো টিনএজার, বা কিছু বেশী।হয়তো নিম্নমধ্যবিত্ত, পাশে তার মা দুশ্চিন্তায়-দুর্ভাবনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। কথা বলবার সময় ছেলেটা অমলিন হাসছিল।অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার এই দৃশ্যটা। আমাদের এই সোনার ছেলেমেয়েগুলোর জন্যে কি করা হচ্ছে, জাতি জানতে চায়। আহতদেরও তালিকা প্রস্তুত হউক। এই হাজার হাজার সন্তানের অকল্পনীয় যন্ত্রণাভোগ এবং আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজকের ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ উপহার পেয়েছি, যাদের ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।এরাই জুলায়ের স্রষ্টা, রূপকার এবং মাস্টার।সৃষ্টিকর্তা এঁদেরই মারফতে, এঁদেরই উসিলায় স্বাধীনতার নতুন সূর্যের উদয় ঘটিয়েছেন।দুনিয়া কাঁপানো জুলাই-অগাস্টের কুড়ি দিনের স্রষ্টাদের হাজার সালাম!
নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের দুইমাস পূর্ণ হল।আল্লাহ্ দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাই যে, সত্যি সত্যি এখন আমরা ঘুম ভেঙ্গে দেখতে পাই যে, গণতন্ত্রের হত্যাকারী দুর্নীতিবাজরা দেশ ছেড়ে পলায়ন করেছে।এই দুইমাসে আব্দার ও আফসোস লীগ গোষ্ঠীর হতাশার লম্বা লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে, আর ইউনুস সরকারের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার খুঁটিনাটি বিস্তারিত রিপোর্ট ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসছে।ডঃ ইউনুসের বক্তৃতার প্রতি শব্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ আমোদিত হওয়ার মত। হ্যাঁ, এই স্বাধীনতাই আমরা চেয়েছিলাম।এই স্বাধীনতা আমাদের বীর সন্তানদের অমূল্য উপহার।
জুলাইয়ের আন্দোলনের রাজপথের সংগ্রামে যে নজীরবিহীন রণকৌশল গ্রহণ করা হয়েছিলো, তাতে রচিত হয়েছে ইতিহাস, রাজনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ও সমরবিদ্যার নতুন টেক্সট, অপরাজেয় যুদ্ধ কৌশলের এক নতুন মাস্টারপিস!আগামী দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিভাগে এই কৌশল অধ্যয়ন করতে হবে।এই কৌশলের মূলে ছিল কোন একক ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অদৃশ্য করে বহুস্তরীয় সমন্বয়কদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, যা দৃশ্যতঃ ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার কৌশলের সাথে রিয়েল লাইফ দাবার চালের মত এগিয়ে গিয়েছিল।২০ দিনের প্রতিটি চাল ছিল অটল সংকল্প, প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহসের পরিচায়ক।তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছিল, গুলিবিদ্ধ বন্ধুকে তাক করা বন্দুকের গুলির মুখেও ছেড়ে যায় নাই।রাস্তায় রাস্ত্রায় তৃষ্ণার্ত বন্ধুদের পানি খাওয়াতে জীবন দিয়ে দিয়েছিল। সামাজিক গণমাধ্যমকে ভরসা করে জাতির জন্যে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি, প্ল্যান এ, প্ল্যান বি- এর নির্দেশনা গোটা জাতিকে দিয়েছিল।সারাবিশ্ব থেকে, এমনকি প্রবাসে বসেও আমরা সেই নির্দেশনা মেনেই আজ কি করবো, কাল কি করবো সেই ছকগুলো বুঝে কর্তব্য ঠিক করবার চেষ্টা করে গেছি। রাস্তায় যখন বাচ্চারা বুকেপিঠে বর্ম বেঁধে নেমেছিল, উচ্চারণ করেছিলো "মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু", তখন থেকে কোন পরিবারই ঘুমাতে পারে নাই।যখন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা পথে পথে ৯ টি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সবার হয়ে লড়াই করছিলো, আমরা যার যার অবস্থান থেকে দম বন্ধ করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।গোটা দেশের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে, জাগিয়ে রেখেছে, তাঁদের এই বুদ্ধিমত্তা, অসম সাহস, অমিত বিক্রম, প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ, স্বাধীনতার প্রতি অদম্য ভালবাসা দিয়ে তারা বিশ্বের দরবারে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।২০ দিনে তারা রচনা করেছে নতুন ইতিহাস।
এই "মিটিকুলাস প্ল্যান" কার জন্যে সমস্যার মনে হয়? এই "মিটিকুলাস প্ল্যান" এর ভিত্তি রচিত হয়েছিলো বিগত ১৫ বছরে আরও অগণিত জীবনের আত্মত্যাগের মিছিলের বিনিময়ে।যারা আয়নাঘরের ভয় তুচ্ছ করে আওয়াজ উডাইছিল, বিজয়ের দিনে সেই অসংখ্য ভাইবোনদের, কিশোর, মুস্তাক, মাইকেল চাকমাদের গল্প আমরা কোনদিনই ভুলে যাব না।জুলাইয়ের অবিস্মরণীয় জাগরণকে যারা অ্যানার্কি, বিশৃঙ্খলা, আবেগি, হঠকারী বলে বিশেষণ দিয়ে আন্ডারমাইন করার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত, "মিটিকুলাস" বিশেষণে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। তারা মিটিকুলাসলি ডঃ ইউনুসের উচ্চারিত বাক্যের শব্দে শব্দে এলার্জিক বোধ করছে।প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ইউনুসের নবনিযুক্ত বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে মাসখানেক আগে সাংবাদিক শাহেদ আলম জুলাইয়ের আন্দোলনের অন্যতম "মাস্টারমাইন্ড" অভিহিত করা নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে থেকে থেকে মধ্যমমাত্রার ঝড় বেগবান হচ্ছে।মাহফুজ দেড়শত "মাস্টারমাইন্ড" সমন্বয়কের একজন হয়ে "অন্যতম মাস্টারমাইন্ড" হতে পারবেন না কেন? তিনি তো তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করেন।ইউনুস কিন্তু এই শব্দ চয়ন করেন নি, কিন্তু জাতিসংঘের অধিবেশনে নিউইয়র্কে এসে ক্লিনটন ফাউণ্ডেশনের মঞ্চে তিনি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসাবে দুজনকে পরিচয় করে দেয়ার সময় বলেছেন, এঁদের দেখলে হয়তো যে কোন সাধারণ তরুণের মত দেখায়, আপনারা আলাদা করে চিন্তে পারবেন না, কিন্তু যদি আপনারা যখন তাঁদের কর্ম দেখবেন, যখন তাদের কথা বলতে শুনবেন, আপনারা ধাক্কা খাবেন, তারা গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, তাঁদের বক্তব্য, তাঁদের আত্মনিবেদন দিয়ে। তারা বলেছে, তোমরা আমাদের যে কোন সময় হত্যা করতে পারো, কিন্তু আমরা ছেড়ে দেব না।- এই কথা তিনি সমগ্র শিক্ষার্থী সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন।মাহফুজকে কাছে টেনে বলেছেন, হি ইজ নোউন অ্যাজ দ্য ব্রেইন বিহাইণ্ড দ্য হোল রেভলিউশন। জুলাইয়ের কর্মসূচিগুলোকে অ্যাকশন প্ল্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় কাউকে না কাউকে তো ছক কাটতেই হয়েছে, সেটা যদি মাহফুজরা হয়ে থাকেন, তিনি যদি শিক্ষার্থীদের একজন প্রতীক হয়ে উঠেন, তাতে কি যুগসঞ্চিত মাতার এই অশ্রুস্রোত, বীরের রক্তধারাকে অস্বীকার করা হল? শহীদের স্বপ্নকে বাস্তব করবার জন্য কাঁধে এই দায় নিয়ে দরদের পথে রওনা হতে মাজফুজ, নাহিদ, আসিফদের বেঁচে থাকতে হবে।
একমাস আগে জুলাই পরিসরে মাহফুজের যে বক্তৃতা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক এই একই আলাপ যদি হাজার প্রাণের এই বলিদানের আগে হত, তাহলে কত জন মন দিয়ে শুনতেন, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।এতদিন এমন অনেক জরুরী গভীর আলাপের জন্যে দশ-পনেরজন শ্রোতা জোটানোও বেশ কষ্টকর ছিল।মাহফুজেরা যখন এই আলাপ জুলাইয়ের মাস্টারদের রচিত অবিস্মরণীয় টেক্সটের পাটাতনে দাঁড়িয়ে করেছেন, তখন এক একটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন শহীদি রক্তের উত্তরাধিকার থেকে।এই উচ্চারণ কেবল তাঁর ব্যাক্তিগত কারিশমার বিষয় নয়।তিনি বলেছেন গণের কণ্ঠস্বর হয়ে, মাস্টার অব জুলাইয়ের ভয়েস ধারণ করে, সেটা সকলকে ইনক্লুড করে, ধারণ করে।এখান থেকে আপনি, আমি, আমাদের সন্তানেরা যত দূরে ইচ্ছা যেতে পারে, কেউ আমাদের আর আয়নাঘরে বন্দী করে রাখতে পারবে না, সীমারেখা টানতে পারবে না।আমাদের সীমা মহাকাশ পর্যন্ত। রিসেট বাটন টেপা হলে পুরনো ইতিহাস মুছে যায় না, ইতিহাস স্বচ্ছ হয়ে পরিষ্কার ধরা পরে।২০২৪ এর বিপ্লব ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে পরিপূর্ণ করে।
রবিবার,
অক্টোবর ৬, ২০২৪
মিল্বাকি, উইস্কন্সিন
#সায়েমারলেখা
#JulyMassacre
#secondindependencebangladesh
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




