সাগর পাড়ে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্ত বেশি সুন্দর না সূর্যোদয়? সাগরের নোনা জল থেকে একটু দূরে ঝাউ গাছের নীচে বসে ভাবে শাই। সুর্যোদয় নতুন আশার গল্প শোনালেও সূর্যাস্তকেই বেশি আপন মনে হয় শাইয়ের। কি যেন সেই বিষন্নতা, কি ছিল সেই না বলা কথা, কি যেন বাকী থেকে গেল...করা হলনা শেষ সেই অসমাপ্ত কাজটা! অথচ ফুরিয়ে গেল আরেকটা দিন! ঠিক যেন ওর জীবনের প্রতিচ্ছবি!
তেত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেল...কিন্তু আজও ও সেখানেই আছে যেখানে ছিল কিছু কাল আগে...একা, সঙ্গীহীন। বাতাস সামলে গুছিয়ে নেয় পড়ে থাকা সাদা তাঁতের শাড়ির পাড়, এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলে হাত বুলাতেই মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা...ছ’বছর আগের মধুচন্দ্রিমার কথা...এই এখানেইতো ওরা এসছিল বিয়ের দুরাত পর! কত গল্প, একে অপরকে জানা, অকারণ হাসি, ঘন্টার পর ঘন্টা সাগরের পাড় ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া, সারা রাত জেগে থাকা, ভালবাসায় ডুবে থাকা...ভালোবাসা, ভালবাসা...আকাশে, বাতাসে, জমিতে কোথায় ছিল না ভালোবাসা! কি প্রচন্ড উন্মাদনা!
মধুচন্দ্রিমার কোন এক রাতে ওরা মেতে উঠেছিল এক তর্কে। কিণা ক’টা বাচ্চা নেবে। শাই বলছিল একটা বাবুই যথেষ্ঠ...কিন্তু সাব্বির মানবেই না...নিতান্তই দু’টো বাচ্চা না হলে আর বাবা কি হলো! কি অকারণ তর্ক! কিন্তু কই তখনতো একবারও বিরক্ত লাগেনি! বরং মনে হয়েছিল বাহ বেশতো, সাংসারিক আছে মানুষটা! তো আজ কেন...আজ কেন অসহ্য মনে হয় সব? ঠিক শাইয়ের মনের মতোই সাগর পাড়েও বইছে দমকা বাতাস... বর্তমানে ফিরে আসে শাই!
কিন্তু ঝাউ গাছের ওপাশ থেকে কে তাকাচ্ছে বার বার? শাইয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রয় বলে কেউ একজন তাকে ফলো করছে। শাই কি ঘাড় ফিরিয়ে দেখবে? কি দরকার! দেখছে তাকে, দেখুক...কি এসে যায়! উটকো লোকতো আর কম নেই এই সাগর পাড়ে! পাত্তা দিলেই পেয়ে বসবে। ইনিয়ে বিনিয়ে জমাতে চাইবে গল্প। কি দরকার বাবা!
উঠে যায় শাই, বিষে বিষ ক্ষয় করতে সেই একই সাগর পাড়ে এতো বছর পর এসে এখন এই সুন্দর সন্ধ্যাটাকে কেমন বিষাক্ত মনে হয় শাইয়ের। তাছাড়া এই দমকা বাতাস আর তার বয়ে আনা ধুলোয় কিরম অস্বস্তি লাগছে! শাওয়ার নিতে হবে, লম্বা শাওয়ার...ধুয়ে ফেলতে হবে সারাদিনের ক্লান্তি...আহা, এভাবেই যদি ধুয়ে ফেলা যেত সবকিছু! শাই পা বাড়ায় হোটেলের দিকে...
২
সাগর পাড় থেকে হোটেলে ফিরেই লম্বা শাওয়ার নেয় শাই। তৈরী হয়ে নেয় ডিনারের জন্য। পড়েছে সোনালী চওড়া জরি পারের অফহোয়াইট সিল্কের শাড়ী, সাথে কফি রঙের স্লিভলেস। মুক্তোর হালকা গয়না, চোখে ডার্ক আইশ্যাডো ও স্নিগ্ধ মেক-আপে অনন্য শাই। ব্রাউন ক্লাচ হাতে শেষবারের মতো আয়না দেখে নেয় শাই। কি যেন একটা বাকী আছে...কি আছে বাকী? আসলেইতো, হাসি কোথায়? মুখে একটু হাসি না পরলে কি আর পরা হলো! হেসে ফেলে শাই!
লিফট থেকে নামতেই চোখে পড়ে বুফ্যে রেস্টোরেন্টের ভীড়। এই হোটেলের সব গেস্টই কি ওর মতো হাফ-বোর্ড বেসিসে আছে! হোস্ট এগিয়ে এসে শাই আর ওর পাশের ষাটোর্ধ ভদ্রলোককে জানাল এই মুহূর্তে দু’টো টেবিল খালি নেই, একজন আগে পরে বসতে পারে অথবা যেহেতু আমরা দুজনেই একা, চাইলে একই টেবিল শেয়ার করা যেতে পারে। ভদ্রলোক জানালো, “ক্যারি অন ইয়াং লেডী” উনার ওয়েট করতে আপত্তি নেই। কিন্তু শাই দিলো অন্য প্রস্তাব।
“আসুননা আমরা একই টেবিলে বসি, আপনারও নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে...” শাই জানালো স্মিত হেসে।
‘না, না ঠিক আছে...আমার অতোটা...’ শেষ করতে পাড়ে না ভদ্রলোক।
“এবার আপনি কিন্তু অপমান করছেন। আমি কি দেখতে অতোটাই খারাপ!” আরো বড় করে হেসে বলল শাই।
ভদ্রলোক লজ্জা পেলেন, এগিয়ে গেলেন শাইয়ের সাথে, টেবিলের দিকে।
বুফ্যে ঘুরে খাবার নিয়ে টেবিলে ফিরে আসতেই শাই দেখল ভদ্রলোক খাবার সামনে বসে আছেন। শাই একটা স্মিত হাসি দিয়ে বসলে, ভদ্রলোক ‘বন-অ্যাপেটিট’ বলে খাবারে ছুরি-চামচ চালাল। বেশ লাগল শাইয়ের, ম্যানার জানেন ভদ্রলোক। সরগরম রেস্টোরেন্টে ওদের এই টেবিলে আবার নেমে এলো নিরবতা। মাঝে মাঝে শুধু ছুরি-চামচের টুক-টাক শব্দ। কিন্তু সেই শব্দও ছাপিয়ে যাচ্ছে ওদের অস্বস্তি...
“আচ্ছা আমিই শুরু করি, আমি শাই, আপনি?”
‘ও আচ্ছা, হ্যাঁ... আমি আবরার, আবরার চৌধুরী’।
“বেড়াতে এসছেন? নাকি কাজ?”
‘আসলে কোনটাই না... আপনি?’
“আচ্ছা? আমিও অনেকটা তাই...বেড়াতে এসছি কিণা জানিনা, কিন্তু কাজেতো নয়ই” হেসে বলে শাই।
এক আধমিনিটের নীরবতা... “আমি কিছুকাল আগে এখানে প্রথম এসছিলাম সাব্বিরের সাথে, আমার হাসবেন্ড, হানিমুনে...কিন্তু এবার আমি একা, আমরা সেপারেশনে আছি”।
‘বিষে বিষ ক্ষয়?’
“বাহ, দারুণ বলেছেনতো! আমিও ঠিক এই শব্দটাই ভাবছিলাম আজ বিকেলে” হেসে বলে শাই।
“কিন্তু আপনিতো বললেন না, কেন এসছেন এখানে?”
‘গত মাস দুয়েক আগে লন্ডনে যখন আমার স্ত্রী চলল, হঠাৎ একদিন, ভাইরাল ফ্লুতে...সবকিছু কেমন অসহ্য মনে হল...ছেলে-মেয়ে ফিউনারেলের সপ্তাহ খানেক পর ফিরে গেল যে যার জীবনে। কিন্তু আমার সময়তো কাটে না! সেই ঘর, সেই বাড়ী, কিন্তু কোথাও ও নেই...শুধু আছে উপচে পরা স্মৃতি। চলে এলাম এখানে, সাগর পাড়ে, মিতা বড় ভালোবাসতো এই সাগর পাড়।’
“সেইতো একই হলো, আবরার সাহেব...বিষে বিষ ক্ষয়!” শাই আড় চোখে তাকায় ভদ্রলোকের দিকে!
ছুরি-চামচ থামিয়ে কি যেন ভাবেন ভদ্রলোক, কিন্তু কিছু বলেন না, আমার মন দেন প্লেটে।
“সরি! আমি হার্ট করতে চাইনি...” অস্বস্তি লাগে শাইয়ের।
‘আরে না, সেরকম কিছু না, এই মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি টেনে নিয়ে যায়’।
“তবে যাই বলুন, ফিশ ফ্রাইটা কিন্তু দারুণ হয়েছে” উঠে দাড়ায় শাই। “আমি আরেকটা নিচ্ছি, আপনার জন্যে কি একটা আনবো?”
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১১ রাত ৯:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




