দুবাইতে আমার ৮ ঘন্টা ৮ মিনিটের ট্রানজিট শেষ হল একসময়। দুবাই এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরার সময়কার অভিজ্ঞতার সাথে একপর্বে লিখবো। দুবাই থেকে ফ্রাংকফুর্ট যাত্রা ছিল ৮ ঘন্টার মত। এই সময়টাও কাটলো মুভি দেখে, ঘুমিয়ে এসব করেই। বাংলাদেশ থেকে দুবাই পর্যন্ত বেশিরভাগ যাত্রীই ছিলেন ইউরোপিয়ান তাই মনে হচ্ছিল অচেনা এক দেশে বাংলাভাষাবিহীন এক পরিবেশে কেমন যে যাবে দিনগুলো, বাংলাদেশে যা রূপকথা তাই কি ওখানে বাস্তব? এভাবেই একসময় ফ্লাইট ল্যান্ড করলো ফ্রাংকফুর্টে। তখন দুপুর ২টার মত। দুবাই এয়ারপোর্ট যেমন ভর্তি ছিল এমিরেটস এর বিমানে, ফ্রাংকফুর্ট তেমনি লুফথানসার বিমানে। বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট ভর্তি ছিল বিদেশী বিমানে, আফসোস।
বাংলাদেশী কেউ বিদেশের কোন ইমিগ্রেশনে দাঁড়ালেই ভয়াবহ বিড়ম্বনার শিকার: এমনটাই আমি পড়েছি বেশিরভাগ জায়গায়। আমি ধরে নিয়েছিলাম আমারো এমনটাই হবে, তবে ভুল ছিল ধারণাটা। আমার সকল অরিজিনাল ডকুমেন্ট সাথেই রেখেছিলাম, ইমিগ্রেশনেও খুব অল্পই মানুষ দেখলাম তাই তেমন কোন সমস্যা ছাড়াই পার হয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন। কেন-কোথায়-কতদিন এই প্রশ্নগুলোর বাইরে আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে এই ইমিগ্রেশনটার একটা প্রভাব আছে পুরো ইউরোপ ট্যুর জুড়েই। আমার সাথে আমার বন্ধু জামিল, দুইজনই ইউরোপে প্রথম, কেউই জার্মান ভাষা জানি না। সুতরাং ইংরেজী বলতে হবে এখন থেকে ফ্লুয়েন্টলি, কারণটা দরকারটা আমার। আমাকেই সঠিক শব্দ বের করে কমিউনিকেশন চালাতে হবে। খুব সহজে বলতে গেলে, আমরা সবাই ইংরেজী লিখতে পারবো কিন্তু বলতে গেলে আটকে যাবো কারণ হঠাৎ করেই একটা জরুরী শব্দ মাথায় আসবে না। ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে একটানা কথা বলে গেলাম কোন প্রকার আ-উ-আ অথবা না আটকেই। ইংরেজী বা যেকোন বিদেশী ভাষা শিখতে গেলে ভাষার ভয়টা ভেঙ্গে যাওয়া দরকার। আমি মনে করি ফ্রাংকফুর্ট এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনেই এই ভয়টা কেটে গিয়েছিল। ইমিগ্রেশনের ছেলেটাকে ধন্যবাদ, তার সহযোগিতামূলক মনোভাবের জন্যে।
ইমিগ্রেশনের পরে ব্যাগেজ কালেকশন। জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে মালামাল, ট্যাক্স এগুলি নিয়ে হয়রানী'র প্রচুর ঘটনা শুনেছি অথবা পড়েছি। ভাবছিলাম, ফ্রাংকফুর্টে কি হয়, ভয় লাগছিলো ভালোই। আমার ভয়কে মিথ্যা প্রমাণ করে আমার ব্যাগ আমি কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই কনভেয়র বেল্ট থেকে পেয়ে গেলাম, ইনফ্যাক্ট ওখানে কারোরই কোন ব্যাগ চেক হল না। খুব সম্ভবত কনভেয়র বেল্টে আসার আগেই চেক হয়ে আসে। বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে লাগেজ ক্যারিয়ারগুলো ফ্রিতেই পাওয়া যায় তবে এখানে প্রতিটা ক্যারিয়ার ব্যবহার করতে .৩ ইউরো দিতে হবে। তবে আপনি যখন ক্যারিয়ারটা আবার ফেরত দিয়ে যাবেন তখন পুরোটাই আবার ফেরত পাবেন। পদ্ধতিটা বেশ ভালোই লাগলো, অবিন্যস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বা এগুলো মেইনটেইন করার জন্যেও কোন লোক দরকার নেই। এভাবেই ফ্রাংকফুর্ট ইমিগ্রেশন শেষ হলো এবং এবার যেতে হবে আপাতত শেষ গন্তব্যে: বাডগোডেসবার্গ, বন।
ICE এর বুলেট ট্রেন
ফ্রাংকফুর্ট এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে পর্যন্ত শুধু এয়ারপোর্ট দেখেছি (যা দুবাইয়ের মতোই), এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার ভয়ংকর বাতাসের ঝাপটা লাগলো। এটাই ছিলো ইউরোপে অভ্যর্থনা (আর তো কেউ নেই যে গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, রোমান্টিক মুভি হলে সম্ভাবনা ছিল)
তাড়াতাড়ি করে নিজের জ্যাকেটটা পড়লাম। শীতের সকালে লেপ গায়ে ঘুমাতে যেমন শান্তি লাগে তেমনি লাগলো সেই ঠান্ডায় জ্যাকেটটা পড়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরে বিশাল বিশাল সব লরি ছুটে যেতে দেখলাম, বাংলাদেশের ট্রাক-লরি ওগুলোর তুলনায় শিশুই মনে হলো। ফ্রাংকফুর্ট এয়ারপোর্টেই ট্রেনস্টেশন আছে, ওখানে যেয়ে ট্রেন নিয়ে যেতে হবে। স্টেশন পর্যন্ত শাটল বাসের জন্যে অপেক্ষা করে আছি এবং একসময় শাটল বাস আসার পরে বাসটা দেখে মজা পেলাম কারণ ২টা বাস একসাথে একটা বাস আগে কখনো দেখিনি:
যাইহোক, শাটল বাসে দ্রুতই পৌছে গেলাম ট্রেনস্টেশনে। আমাদের গন্তব্য বাডগোডেসবার্গ, বন। তখন বাজে দুপুর ২:০০টার মত, কাউন্টারে ইংরেজী নাকি জার্মান বলে তা তো আর জানিনা। ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম সবচেয়ে সস্তায় কিভাবে যাওয়া যাবে? মেয়েটা ওদের টাইমলাইন দেখে জানালো ৩ ঘন্টা এবং ২৬ ইউরো। অতক্ষন বন অফিসে কেউ থাকবে না, তাই দ্রুততম কোনটা হবে জানতে চাইলে ও বললো "ICE" ট্রেন যাবে একটু পরেই, ওটাতে ৬৫ মিনিটের মাঝেই পৌছে যাওয়া যাবে তবে টিকেটের দাম ডাবল (৫৮/৫৯ ইউরো)। দ্রুত যেতে হবেই সুতরাং সেইমত টিকেট কাটলাম ICE তে এবং টিকেট নিয়ে জানতে পারলাম আর ৪ মিনিটের মধ্যে ট্রেন আসবে। পুরা মাথায় হাত কারণ এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ট্রেনে উঠবো যেখানে ট্রেন কোথায় থামবে সেটাই এখনো দেখিনি। দৌড়ানো শুরু করলাম লাগেজ নিয়ে, এবং ক্লিনার, পুলিশ এদের জিজ্ঞেস করে করে ঠিক ২ মিনিটের মাঝে পৌছে গেলাম।
শুরু হলো প্রথম বুলেট ট্রেন যাত্রা। ট্রেনে উঠেই হল অন্য অভিজ্ঞতা, এতক্ষন ছিলাম আকাশে (কান তালা লেগে যাচ্ছিল বারবার) আর এখন মাটির নিচে কারণ ICE ট্রেনটা বেশিরভাগ সময়ই মাটির নিচে দিয়ে যাচ্ছে। একবারে আকাশ থেকে একদম মাটির নিচে যেয়ে সারভাইভ করা কুংফু-পান্ডা মুভি'র পো'র পক্ষেই সম্ভব, আমার পক্ষে না। সুতরাং আর কিছুক্ষনের মাঝেই মনে হলো সারাজীবনের জন্যে মনেহয় কান নষ্ট হয়ে যাবে। যাইহোক, ICE ট্রেনের গতিময় জার্নি ভালোই লাগছিল। যেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তার বেশিরভাগই ল্যান্ডস্কেপ ক্যালেন্ডারে দেখা ঢেউ খেলানো মাঠের মত, দূরে ছোট ছোট কিছু শহর। ঠিক ৬৫ মিনিট পরেই যাত্রা শেষ হলো একসময় বিকাল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে এবং স্টেশন থেকে বের হয়ে ট্যাক্সির সন্ধানে গেলাম। টিপিক্যাল জার্মানীর একটা ছবি এখন না দিলেই নয়। জার্মানী বলুন আর ইউরোপ বলুন সবজায়গাই এরকম:
অফিস হয়ে বাসায়:
ট্যাক্সি পাওয়া গেলো, তবে সে মনে হলো ইংরেজী অত ভালো বুঝে না তাই তাকে আমাদের অফিসের অ্যাড্রেসটা দেখালাম এবং রাজী হলো সে যেতে। যাত্রাপথটা মনে হচ্ছিলো বর্ন-আইডেন্টিটি সিনেমার মত, রাস্তার বাঁকে বাঁকে কোনদিকে কোন শহর সেটার নীল/সবুজ সাইনবোর্ড।
গাড়ি চালক রাস্তা দেখছিলো জিপিএস ডিভাইসে, সুতরাং পথ ভুল হবার সম্ভাবনা নেই এবং একসময় পৌছে গেলাম আমাদের অফিসে...অফিস কলিগ এবং সেটার পরিবেশ একবারে লিখবো। আমাদের বস রেনে আমাদের দেখেই বুঝতে পারলো আমরা ভালোই ক্লান্ত তাই তাড়াতাড়ি করে ট্যাক্সি ডেকে আমাদের আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিলো (আমরা ২জন ২ বাসায় ছিলাম কারণ ওরা আমাদের সেভাবেই অ্যালোকেট করেছিলো)। একটা বাসা অফিসের কাছে, আরেকটা বন সেন্ট্রাল সিটিতে। যাইহোক, রেনে টস করে দেখলো কে কোনটায় যাবে এবং আমারটা হলো অফিসের কাছেই। সেইমত ট্যাক্সিতে উঠলাম এবং রওনা দিলাম, আমাকে নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা বন সিটিতে যাবে।
পৌছাতে সময় লাগলো ৫মিনিট মাত্র, ঝামেলা লাগলো বাড়ির তালা খুলতে যেয়ে। কোনভাবেই কাজ হয়না দেখি, তখন ট্যাক্সি ড্রাইভারটাই হেল্প করলো। "আমাদের দেশে/ইন্ডিয়া রিজিওনে তালা খুলতে হয় ক্লকওয়াইজ, আর ওদের ওখানে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ" এটা সে হাসিমুখেই খোঁচা মেরে জানালো। খোঁচাটা খারাপ লাগলো না কারণ জার্মানদের যেমন রোবোটিক-যান্ত্রিক শুনে এসেছি আশা করি সেটা ভুল, অন্তঃতপক্ষে এতক্ষন পরিচিত হওয়া জার্মানদের দেখে সেটা ভুলই মনে হচ্ছে।
বাসায় ঢুকে কোনমতে জ্যাকেট, স্যুয়েটার খুলেই বিছানায় শুয়ে দিলাম ঘুম। বাকি যা আছে সবকিছু আরো ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারে, দুনিয়া তেমন একটা পাল্টে যাবে না।
আগামী পর্বে: প্রথম দিনের শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:১০