somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: পাপ দ্বন্দ্ব

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.৩
"আমার বোনের ধর্ষণের বিচার চাই।"
একা একটা ছেলে শিরদাঁড়া উঁচু করে প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ পাশে ছিল না। কেউ না। ধর্ষিত মেয়েটার তেমন কোনো পরিচয় নেই। একজন পতিতার ধর্ষণকে কেউ গুরুত্ব সহকারে নেয় নি। কেউ মিছিল করেনি, স্লোগান দেয় নি। পতিতা মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছে, এ খবর শুনে আর কারও মাঝে প্রতিবাদ করার চিন্তা আসেনি৷ বরং পত্রিকায় এ খবর ছাপার পর, বেশির ভাগই নাক ছিটকেছে, "বেশ্যা মেয়ে ধর্ষণ হয় কী করে? টাকা পয়সায় বনিবনা হয় নি, বলে দিয়েছে ধর্ষণ!" বলে।

শামীম তবু একা এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল। দুই দিনের মাথায় অনেকেই জমে গেল আশেপাশে। দাঁড়াল ধর্ষণের প্রতিবাদে।
এর মাঝে হুট করে শামীমকে পুলিশে গ্রেফার করাটা দারুণ সরব করে তুলেছে দেশবাসীকে। একটা মানুষ ধর্ষণের প্রতিবাদ করেই কেন গ্রেফতার হবে? সব প্রতিবাদী মুখ বন্ধ করে দেবার যোগাড় করতে চেয়েছে পুলিশ। মানুষ তা মেনে নেয় নি। শামীমের গ্রেফতারের পর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছে আরও শ'খানেক মানুষ, "আমিও ধর্ষণের প্রতিবাদ করছি, আমায় গ্রেফতার করো।" প্ল্যাকার্ড হাতে।

পুলিশের অভিযোগ শামীমকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাকে খুন করেছে, কেন করেছে, কবে করেছে, সে প্রশ্নের উত্তর পুলিশ দেয় নি। উত্তর নেই হয়ত তাদের কাছে। ধর্ষণের প্রতিবাদ দমিয়ে দেবার জন্যই এই গ্রেফতার, তা বুঝতে বাকি নেই সাধারণ জনগণের। পুলিশের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়েছে, "কাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার শামীম?"
পুলিশ বলেছে, "সব জানানো হবে।"
গল্প ফাঁদার পায়তারা মানুষ বুঝতে পারে। সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারছে। পতিতা মেয়েটার বর্ণনা অনুযায়ী, ধর্ষক টাকা পয়সা ওয়ালা। গাড়িতে তুলে নিয়ে এই কাজ করেছে। ক্ষমতাবানের পক্ষে পুলিশ অবস্থান নিচ্ছে, আর কিছুই না। এই ধর্ষণের বিচার হবে না৷ শামীমের মত প্রতিবাদী কেউ বিনা দোষে শাস্তি পাবে।

১.২
মনিরের সাথে আজ প্রথম দেখা হবার কথা অর্পার। ঘন্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে আছে, অথচ কোন খবর নেই মনিরের। একবার কল রিসিভ করে বলল, "আসছি। কাছাকাছি আমি।"
এরপর থেকে কলও ধরছে না, কোন খবরও পাচ্ছে না। একটু দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলো আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছে। কুৎসিত ইঙ্গিত করে যাচ্ছে। এতো মানুষের ভিড়েও নিজেকে বড় একা লাগছে অর্পার, লাগছে অসহায়। নীল রঙের শাড়িটা আজ প্রথম পরেছে শুধু মনিরের সাথে দেখা করবে বলেই। ফেসবুকের পরিচয়ে দেখা করতে আসাটা নিজের কাছেই এখন বোকামি লাগছে। এতোটা বোকা কেন অর্পা? এভাবে এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার আর কোন মানেই হয় না। হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। ভুলেও আর কখনও মনিরের কল ধরবে না, কথা বলবে না, যোগাযোগ করবে না অর্পা - এটাই শেষ সিদ্ধান্ত।

মনিরের লাশ পড়ে আছে রাস্তার পাশে। কিছুক্ষণ আগেই একটা বাইক এসে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। ছিটকে পনেরো বিশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল শরীরটা। মাথা সোজা গিয়ে আঘাত করল রাস্তার ডিভাইডারে। ওখানেই শেষ৷ দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ কিছু বুঝে উঠবার আগেই সাই করে বাইকটা চলে গেল। আটকানো সম্ভব হলো না।
এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নেয়া হলো। ঘোষণা করল মনিরকে মৃত হিসাবে।
অর্পা সে খবর জানল না। অর্পা অভিমান জমিয়ে বসে রইল। মনিরকে ভুলে যাওয়া দরকার, মাথার ভিতর থেকে তাড়িয়ে দেয়া জরুরী।

১.১
"তুমি অকারণে আমার সাথে এমন করতে পারো না।"
ফোনের ওপাশ থেকে শামীম কথাগুলো বলে, অর্পা থাকে চুপ করে। এক জিনিস এতোবার করে বলবার কোন ইচ্ছা অর্পার নেই।
শামীম আবার গলায় জোর এনে বলে, "কথা বলো না কেন? উত্তর দাও আমার কথার।"
অর্পা ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে৷ শান্তস্বরে বলে যায়, "আস্তে কথা বলো শামীম। আমি অনেকবার বলেছি, আমার সাথে চিল্লাপাল্লা করে কথা বলবে না।"
"তোমার যা ইচ্ছা হবে, তাই করবে। আর আমি চুপ করে বসে থাকব?"
"আমি তোমাকে সোজা সাপ্টা জানিয়ে দিয়েছি শামীম, তোমার সাথে আমি আর সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। তুমি এরপরও জোর কেন করছ?"

শামীম রেগে যায়। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, "আমার কিন্তু প্রচন্ড রাগ লাগছে। তুমি আমাকে ক্লিয়ারলি বলো, কী চাচ্ছ?"
অর্পা আরও শান্ত গলায় বলে, "আমি তোমাকে নিয়ে টায়ার্ড। আমি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছি না। রাখি আমি। আর কল দিও না প্লিজ।"

অর্পা কেটে দেয় ফোন। শামীম অনবরত করে যায় কল। ধরে না অর্পা। শামীমের কথায় কথায় খবরদারি ভালো লাগে না অর্পার। একটা সম্পর্কে সম্মান থাকবে, প্রতিটা ব্যাপারে বোঝাপড়া থাকবে। অর্পা আর শামীমের সম্পর্কে এই ব্যাপারটাগুলোর ছিটেফোঁটাও নেই। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সাথে কথা বলছে সব কিছুর খবর দিতে হবে শামীমকে। এই ব্যাপারটাকে সম্পর্ক বলে না। কোনভাবেই না।

গত কয়েকদিন ধরে মনিরের সাথে কথা হচ্ছে। মনির ছেলেটা এমন নয়। প্রতিটা কথাকে গুরুত্ব দেয়, মনযোগ দিয়ে শোনে, কোন ব্যাপারে করতে চায় না খবরদারি। আজ দেখা হবার কথা মনিরের সাথে। একটা নীল শাড়ি পরে যাচ্ছে মনিরের সাথে দেখা করতে। এই ঘটনা শামীম জানে না। সব কিছু কেন শামীমকে জানাতে হবে? জানাবার কোন মানেই হয় না।

মনির হেঁটে চলে রাস্তার পাশ দিয়ে। দেখা হবে আজ অর্পার সাথে। প্রথম দেখা। হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে এক তোড়া গোলাপ, পরনে পাঞ্জাবি। হাতিরঝিলে এসে যখন রাস্তা পার হবে, কোথা থেকে হুট করে প্রচন্ড স্পিডে এক বাইক এসে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল মনিরকে। ছিটকে পড়ল গিয়ে ডিভাইডারের উপর। ফুলের তোড়াটা গিয়ে পড়ল রাস্তার মাঝ বরাবর। অন্য এক গাড়ি এসে পিষে দিয়ে গেল ফুলের তোড়া। শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে শুধু এইটুকুই খেয়াল করতে পারল।

১.৪
মনিরের দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ করে শামীম নামের এক ছেলে রাস্তার পাশে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে গেল। এক পতিতা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, অপরাধী কে খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে নিজের গাড়ি আছে যেহেতু তার মানে ভাল অবস্থা সম্পন্ন কেউ হবে। দুইদিনের মাথায় শামীমের সাথে জুটে গিয়েছিল আরও অনেকে। এর মাঝ থেকে শামীমকে গ্রেফতার করে আনাটা খুব ঝামেলার কাজ ছিল পুলিশের জন্য। সাধারণ জনতা প্রায় ছিনিয়েই নিয়ে গিয়েছিল শামীমকে।

মনিরের যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে তার পাশেই এক সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, দুর্ঘটনার চিত্র। আরও কয়েকটা ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার পর নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে ঐ বাইকের চালক ছিল শামীম। বেপরোয়া গতিতে চালাবার সময় মনিরকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।
শামীম ছেলেটা ধুরন্ধর। এক্সিডেন্টের ঘটনা ঘটিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ধর্ষণের বিচার চাওয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায় করে নিল, সবার কাছে হিরো হয়ে গেল।

অর্পার সাথে ঝগড়ার ঘটনার পর মাথা গরম করে বেপরোয়া বাইক চালাচ্ছিল শামীম। সে বাইকের নিচেই পড়ল মনির।

যে গাড়িতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে পতিতা মেয়েটাকে, তার মালিক থাকে দেশের বাইরে। যে অল্প বয়স্ক ছেলেটা তার বাসা আর গাড়ি দেখাশুনা করত, ও মাঝে মাঝেই তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেত। ঘুরে বেড়াত এখানে ওখানে। রাস্তার পাশে মেয়েটাকে দেখে, টাকা দিয়ে বলল গাড়িতে উঠতে। মেয়েটার কোন ইচ্ছে ছিল না, বাড়ি ফেরার ছিল তাড়া। 'না' ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি ছেলেটা। জোর করে গাড়িতে তুলে নিল। সব শেষে, রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

পত্রিকায় মনির ও শামীমের ছবি ছাপা হয়েছে। অর্পা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তা দেখে। মনিরের ব্যাপারে একটা কথাও শামীমকে জানায় নি অর্পা। শামীম কীভাবে মনিরের খোঁজ পেল? ব্যাপারটাকে কাকতালীয় মানতে নারাজ অর্পা।

সে পত্রিকার পাতা ধর্ষিতা মেয়েটার হাতেও গিয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পতিতা মেয়েটা নিশ্চিত করেছে মেয়েটার ধর্ষক মনির। মনির ওর মালিকের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে রাস্তার পাশ থেকে তুলে মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে।

আমি তোমার কাছে ভালো, আমার কিছু পাপ আছে। তুমি তার কাছে বিশুদ্ধ কেউ, তোমার কিছু পাপ আছে। সে আমার কাছে নির্দোষ, তার কিছু পাপ আছে। এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষই কারও গল্পে নায়ক, আবার কারও গল্পে খল। মানব মন পৃথিবীর জটিলতম জিনিস। এই মনের ভালো মন্দের হিসাব বুঝতে পারা দায়।

রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১:৫১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×