
ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে একাত্তরের বিভীষিকায় বন্দিত্ব, অল্প বয়সেই বিধবা হওয়া—বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শুরুটাই ছিল যন্ত্রণার অধ্যায়। এরপর ইতিহাস যেন তাঁকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এরশাদের শাসনামলে তিনবার কারাবরণ, পরবর্তীতে অবমাননাকর বন্দিত্ব, মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাত্র ছয় ঘণ্টার প্যারোলে মুক্তি—যেখানে আপনজনের সঙ্গে শোক পালন করার সুযোগও ছিল না। দুই সন্তানকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে দেখেও তিনি আপস করেননি। শির রেখেছেন চিরউন্নত—এটাই তাঁর জীবনব্রত।
চাইলেই তিনি ভিন্ন জীবন বেছে নিতে পারতেন। একটু আপস, সামান্য সমঝোতা—আরামদায়ক জীবন তাঁর নাগালের বাইরে ছিল না। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন যন্ত্রণার পথ, দেশ ও মানুষের স্বার্থে। বিনিময়ে রাষ্ট্র তাঁকে কিছুই দিতে পারেনি; আমরাও পারিনি। তবু তাঁর সুপ্রিম ডিগনিটি ও সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে একে একে হার মেনেছে অপমান, অপদস্ততা, জেল-জুলুমের সব আয়োজন।
একসময় তিনি আমার রাজনৈতিক পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। কিন্তু ২০১৪–পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতা, রাষ্ট্রের ক্রমাগত “বাকশাল ২.০”-এর দিকে গড়িয়ে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন করে পড়তে বাধ্য করেছে। সেই পুনর্মূল্যায়নে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—বাংলাদেশের তথাকথিত সেকুলার বয়ানের সবচেয়ে বড় ভিক্টিমদের একজন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
জিয়াউর রহমানের পর তিনি শুধু একটি দলের নেতৃত্ব দেননি; তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। তাঁর দৃঢ়তা না থাকলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক উত্তরণ কিংবা ১৯৯১–পরবর্তী ক্ষমতার ভারসাম্য ভিন্ন পথে যেত। বামপন্থী টোটাল স্টেটের স্বপ্ন বা একদলীয় শাসনের পুনরাবৃত্তি হয়তো আগেই বাস্তব হতো—খালেদা জিয়া ছিলেন সেই সম্ভাবনার সামনে শক্ত দেয়াল।
তিনি নিখুঁত ছিলেন না। ভুল করেছেন, সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু তিনি কখনো গণহত্যাকে বৈধতা দেননি, “আমরা বনাম তারা” দিয়ে দেশকে ছিন্নভিন্ন করেননি। জনগণের চাপ ও জনমতের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল থাকা—এটাই ছিল তাঁর বড় রাজনৈতিক পার্থক্য।
আজ তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের সংকোচনের সমান্তরালতা অস্বীকার করা কঠিন। খালেদার উত্থান ছিল বাংলাদেশের উত্থান; তাঁর পতন ছিল মানুষের অধিকার হারানোর ইতিহাস। তিনি চলে গেছেন। কিন্তু ইতিহাস বলবে—এই ভূখণ্ডকে টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে যাঁরা ঠেকিয়েছেন, তাঁদের সারিতে বেগম খালেদা জিয়ার নাম অনিবার্য। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



