বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ‘মুক্তমন’ এর আবৃত্তি সন্ধ্যা
সেরীন ফেরদৌস
রবীঠাকুরকে শুরুতেই স্মরণ করতে হবে,
‘কেহবা দ্যাখে মুখ, কেহবা দেহ
কেহবা ভালো বলে, বলেনা কেহ
ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি
পরখ করে স’বে, করেনা স্নেহ।’
আহমেদ হোসেনের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তমন’ এর আবৃত্তিসন্ধ্যা নিয়ে লিখতে বসে এমনতরো ভূমিকা ‘পরখ না করতে চাওয়ার’ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে মন চায়। গত ২৭ জুন প্রবল বর্ষণে ঢলে পরা সন্ধ্যায় টরন্টোর রয়াল কানাডিয়ান লিজিয়ন হলে আয়োজিত এ ধরনের উদ্যোগ নি:সন্দেহে নিদর্শন হয়ে থাকবে অন্তত এই বিবেচনায় যে, কানাডায় শুধু কবিতা নিয়ে দু’ঘণ্টাধিক এধরনের স্পর্ধিত আয়োজন এই প্রথম।
মোট সাতজন আবৃত্তিশিল্পী-আহমেদ হোসেন, শেখর গোমেজ, অনিন্দ্য শান্ত, অরুণা হায়দার, দিলারা নাহার, মেরী হাওলাদার এবং আদিল কাজী কণ্ঠে ধারণ করে উপস্থাপন করা যায় এমনতরো প্রায় সবগুলি ধারা ( ছড়া, কবিতা, বক্তৃতা, চিঠি, নাটকের সংলাপ, সঙ্গীত, শ্লোগান, পাঠ প্রমুখ) উপস্থাপন করেছেন সেই সন্ধ্যায়। রবীঠাকুর-জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান-সুকান্ত-হেলাল হাফিজসহ আরো অনেককেই উপস্থাপন করেছেন তাঁরা । এমনকি বর্তমানে টরন্টোতে স্থায়ী অবস্থানরত কবি ও নাট্যকারের নাট্যাংশ এবং কবিতাও ছিলো তাঁদের উপস্থাপনের তালিকায়।
দর্শকতৃপ্তির কথা বলতে হলে অবশ্যই বলতে হবে, কারো আশাভঙ্গ হয়নি। বিরামহীন দু’ঘণ্টা বসে থাকবার জন্য যেমন তৈরি হয়েই এসেছিলেন তাঁরা, তেমনি আবৃত্তিকাররাও তাঁদেরকে তৃপ্ত করতে পেরেছেন। মিলনায়তনের মেদহীন নীরবতা, যথাযোগ্য হাততালি এবং ভাষাহীন প্রতিক্রিয়া অন্তত তাই প্রমাণ করে। এই আবৃত্তিকারদেরকে যাঁরা চেনেন, বা আগে আবৃত্তি শুনেছেন তাঁদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করেতে পেরেছেন তাঁরা তার সবটুকু ভালো করে জানা হয়নি এখনো। কবিতাবোদ্ধার চোখ নয়, আমার নবিস চোখ আর মন অন্তত: আপ্লুত হয়েছিলো বলাই বাহুল্য! বলতেই হবে, কি অপূর্ব আবেগে শেখর গোমেজ, অনিন্দ্য শান্ত আর দিলারা নাহার ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছে! সময় গড়িয়ে অপেক্ষা ভারী থেকে আরো বেশি ভারী করে তুলেছিলো তারা। যেন নি:শ্বাস ফেলবার কথা ভুলে গিয়েছিলো অনেকেই!
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সভাপতি আর বক্তৃতাবিহীন সে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের ৬ মিনিট আগেই, শ্রদ্ধাভরে খালিপায়ে মঞ্চে উঠে এসেছিলেন শিল্পীরা। সবাই দেখতে পেলো অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে ছিলো পোশাকের ছন্দিত রঙগুলো- কালো, হলুদ, কালো, নীল, কালো, সোনালি, কালো। কালোর পটভূমিতে হলুদ-সবুজ-গোলাপী কাপড়ের ঢেউখেলানো আঁচল কি ‘নদীমাতৃক বাংলা-মা’কেই মনে করিয়ে দেয় না!
বিদেশ-বিভূঁইয়ে শুধুমাত্র কণ্ঠের কারুকাজের উপর ভরসা করে অবশ্যই বিরাট একটা সাহস দেখিয়েছেন আহমেদ হোসেন। সাথে সাথে অনেককিছুই নানা সীমাবদ্ধতার কারণেই সাধ থাকলেও করে উঠতে পারেননি আয়োজকরা। পরিপার্শ্ব বিবেচনা করলে তারা নানাকিছুর বাইরে চাইলেও যেতে পারেননি। তাই হয়তো বেশ কিছু জায়গায় যন্ত্রসঙ্গীতের অভাববোধটা অনুভূত হয়েছে। আলো থেকে গেছে সাদামাটা। অনুষ্ঠানটি নিয়ে যে বেশ টেনশন কাজ করেছে কিছু কিছু আবৃত্তিশিল্পীদের মনে, তা কণ্ঠেও ফুটে উঠেছে। এটাই বোধহয় স্বাভাবিক; বিদেশের বাড়িতে চুল বাঁধা আর রান্না করা একই হাতে করতে হয়। তাই আহমেদ হোসেনকেই একটু বেশি ক্লান্ত মনে হয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার পরপরই না করে আরেকটু বেশি সময় পরে অনিন্দ্য শান্তের ‘বনলতা সেন’ এর মতো কোমল কবিতাটি জুড়ে দেয়া যেত হয়তো। মেরী হাওলাদারের চমৎকার উচ্চারণের সঙ্গে কণ্ঠে আবেগ আর দরদ আরেকটু উঠে আসতে পারতো, দিলারা নাহারের আবেগের সঙ্গে মিশতে পারতো আরেকটু উচ্চারণের শুদ্ধতা! অরুণার ‘হাস্কি’ ভয়েস সর্বদাই সংলাপের জন্য মানানসই। মোটা দাগে যেটা বলা যায় তা হল, আরো একটু অনুশীলন হলে, আরেকটু বেশি ভালো হতো হয়তো।
প্রবাসের এই দ্রুততম জীবনযাপনে কি পরম মমতায়, কি পরিশ্রমের পর প্রত্যেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এরকম একটি উপস্থাপনা দেবার জন্য- তা অনুমানসাপেক্ষ। উদ্যোগ নেবার সবটুকু কৃতিত্ব আহমেদ হোসেনের হলেও তাঁর দলের সদস্যদেরও প্রশংসা করতে হয়। ওঁদের প্রত্যেকের প্রতি শুভকামনা এবং দর্শক-শ্রোতা হিসেবে আগামীতেও এধরণের আয়োজন উপভোগ করার প্রত্যাশায় রইলাম।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




