বৃক্ষ, তোমার নাম হাসনুহেনা
সেরীন ফেরদৌস
রাক্ষসমার্কা ঢাউস দালানটার ভেতর থেকে বের হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আহ্, গ্রীষ্মকালের গভীর রাত, এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস ! দালানের গুমোট থেকে প্রাকৃতিক বাতাসে বেরিয়ে শরীরটা কেঁপে ওঠে! টরন্টোয় বেশ গরম পড়েছে কয়েকদিন ধরে। ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রীর ভেতর তাপমাত্রা, তুখোড় রোদ, ঝাঁঝালো চনচনে আঁচ। দীর্ঘ বেলা, রাত সাড়ে ৯টা অবধি।
চরকির মতো ঘুরে-ঘুরে করা কাজ শেষ হতে হতে মধ্যরাত। কন্যারা ঘুমুতে গেছে এইমাত্র! বরাবরের মতোই নাজেহাল অবস্থা! নিয়ম না-মানা মা, নিয়ম না-মানা শিশু! সূর্য ডোবার পরও তাদেরকে পার্ক থেকে ঘরে আনা যায় না। মনে পড়ে, যখন বালিকা ছিলাম, মা ঘড়ি ধরে নয়, সূর্যাস্ত অথবা মাগরেবের আযানের সুর ধরে ঘরে ফেরার জন্য শাসন করতো। বলতো, সূর্য ডোবার পর আর এক মুহূর্ত বাইরে থাকা চলবে না। পুরোনো ঢাকার অলি-গলি চষতে গিয়ে মসজিদে আযান পরামাত্র বাসার দিকে দে দৌড়, দে দৌড়! শর্টকাট হচ্ছে হাজারিবাগের সেই পুরোনো পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির কোলঘেঁষা রাস্তাটি। কি ভয়! ফেলে রাখা বাড়িটির অলিন্দের অন্ধকারে ছায়া ছায়া প্রেতাত্মারা তখন জেগে ওঠার অপেক্ষায়! মা বলতো, আযানের পর ‘রাস্তা ক্লিয়ার’ হলে নাকি এইসব প্রেতাত্মারা বাইরে বেরিয়ে আসে!
বার্চমাউন্টের প্রেতাত্মারা তবে কোথায় থাকে! সোয়া বারোটার এই নিশুত রাতে, এই ধুন্ধুমার জ্যোৎস্নায়! কোথায় সেই পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি! মায়ের শাসন নেই বলে কি প্রেতাত্মারাও নিখোঁজ? না: এসব মনে করা চলবে না। দীর্ঘ ঢেউখেলানো বার্চমাউন্ট রোড আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তথাপি ভৌতিক ছায়া নিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে পত্রবহুল বৃক্ষেরা সার সার দাঁড়িয়ে আছে হাঁটাপথ ঘেঁষে। ঠাণ্ডা বাতাস গাছে গাছে বাড়ি খেয়ে তীক্ষ্ণ বিলাপের মতো শব্দ করে উঠছে! হাঁটা ধরলাম। কেন জানি, ভয়-ডর কিছুই কাজ করছে না। (এজন্যে নয় যে, ‘যেহেতু নিরাপদ বলে পরিচিত এ শহর’; বরং হতে পারে ‘যেহেতু জ্যোস্নাভুক প্রেতাত্মা আমি তবে নিজে’!)
পূর্ণচাঁদের বিপরীতে খর্বাকৃতির প্রেতাত্মাটি হেঁটে চলে ধীর পায়ে, আপনমনে। উদ্দেশ্য লরেন্স নামক মহাসড়ক পর্যন্ত পা ঠুকে আসা। সে আর হয় না। কোত্থেকে যেন হাসনুহেনা ফুলের একরাশ তীব্র সুবাস এলোমেলো করে দেয় সব চিন্তা। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে হাসনুহেনা কি করে আসবে! তবে কি মেইডভিল পার্কের কোনো কোণে ফুটে আছে কোনো রাতজাগা ফুল! প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার পরেও যা চোখে পড়েনি? ঢুকে পরবো নাকি পার্কের ভেতরে? না: সেটা উচিত হবে না। আরো দু’একটা শৌখিন প্রেতাত্মা সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। ঠোকাঠুকি না হওয়াই সমীচিন! কিন্তু সৌরভ তো পিছু ছাড়ে না! না-কি শৈশবের স্মৃতি থেকেই উঠে আসছে এই তাজা অমলিন গন্ধ! কয়েকটি সেকেণ্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় কাটে। কি করি? আচ্ছা ঠিক আছে, হাঁটা অব্যাহত থাক। দেখি কি হয়!
গ্রীন সিগনালে বারট্রেণ্ড রোড ক্রস করতে হল। ২৭ মে, বৃহষ্পতিবারের এই গভীর রাতে রাস্তা প্রায় গাড়িশুন্য হলেও, দেখতে পাচ্ছি, পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে ঠিকই! ১৭ নং বাসটি মাথায় নীল আলো জ্বালিয়ে মাত্র দুজন যাত্রীসহ পাশ কাটালো। এইক্ষণে হাসনুহেনার গন্ধ হঠাৎ করেই উধাউ! কি ব্যাপার! ওহহো, ধরতে পেরেছি। ইউরেকা! ফুলগাছটি তো তবে এগলিংটন আর বারট্রেণ্ড- এই দুই সমান্তরাল রোডের মধ্যেই কোথাও আছে! উল্লসিত হয়ে উঠে মন-খোঁজো, খোঁজো। বাতাস বইছে কোন দিকে খেয়াল করো। লরেণ্স গোল্লায় যাক, নাসা তীক্ষ্মতম করে ফিরতি পথ ধরো। এইবার চাঁদ মুখোমুখি, পরিপূর্ণ এবং গোলাকার। একটা চিকন, দীর্ঘ মেঘ পাখির পালকের মতো দাগ দিয়ে গেছে তার ঠিক নিচেই। অথবা এমনও হতে পারে, কোনো মহাকাশযান চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে, এই পথ দিয়ে, পিছে রেখে গেছে পদচিহ্ন।
এইতো, পেয়ে গেছি! বাসস্ট্যাণ্ড লাগোয়া বাড়িটির ঘন অন্ধকারের গভীর থেকে ভুরভুর করে সুবাস বইছে। তীব্র মাদকতায় আচ্ছন্ন চারপাশ! ওমা, কোথায় ঝোপগাছ? এতো বি-শা-ল এক বৃক্ষ। পুরো গাছ জুড়ে ধবধবে সাদা ফুল আকাশ ছুঁয়েছে। জ্যোৎস্নায়, সমুদ্রের ফেনার মতোই খলবলিয়ে উঠেছে ফুলগুলো থোকায় থোকায়! গাছটির দৈর্ঘ্য মাপতে গিয়ে পাশের ইলেকট্রিকের খুঁটিটি নজরে আসে। সেটি ছাড়িয়েও সে উপরে। রাতের বেলা, অন্যের আঙিনায় প্রবেশ নিষেধ, তারপরও গুটিগুটি পায়ে গাছের নিচে আসি। কোনো সাপ নেই তো?
[বি:দ্র: পরের দিন ঝকঝকে রোদে ক্যামেরাবন্দি করেছি সেই বৃক্ষকে। এক্কেবারে কাছে গিয়ে ফুলের থোকায় হাত দিয়ে দেখি, একেকটি ফুল অবিকল বাংলাদেশের সীমফুলের মতো! কি বিস্ময়কর, না!]
মে ২৮, স্কারবরো

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




