মঞ্জুলী-ফেরদৌসের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’
সেরীন ফেরদৌস
বহুদিন মঞ্জুলীদির (মঞ্জুলী কাজী) কোনো খোঁজ-খবর নেই; একদিন ফোন করলে পরে এটা-সেটা আলোচনার পর বললেন, একটা কাজে হাত দিয়েছি, তোমাকে পরে বলবো। ঠিক আছে, সময় হলে বলবেন। সেই পর আর আসেনি, কিন্তু ইতিমধ্যে জেনে গেছি মঞ্জুলীদি নাট্য নির্দেশনায় হাত দিয়েছেন। ড: নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ থেকে তিনটি চরিত্র বেছে নিয়ে নাট্যরূপ দিয়েছেন এবং নির্দেশনায় পাশে পেয়েছেন কবি ফেরদৌস নাহারকে।
শুনতে পাই, পুরোদমে রিহার্সাল চলছে। বীরাঙ্গনার তিনটি চরিত্রে টরন্টোপ্রবাসী তিনটি যুৎসই মুখ- রোজিনা করিম কনক, ইশরাত জাহান দিপ্তী এবং অগ্নিলা প্রিয়াঙ্কা ইকবালও নাকি আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নীলিমা ইব্রাহীমসহ ছ’টি নারীমুখ ছ’টি তারার মতো জ্বলে ওঠে মনে, উজ্জ্বল হয়ে উঠি, বাহ্! উজ্জ্বল হয়ে ওঠার আরো কারণ আছে, এর আগে কানাডার মঞ্চনাটকে এমন সমাহার আর দেখা যায় নি কিনা তাই! কানাডায় নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় এগিয়ে এসে মঞ্জুলী কাজী ও ফেরদৌস নাহার নি:সন্দেহে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন প্রবাসী সাংস্কৃতিক কমর্যজ্ঞকে।
গত রোববার, ১৫ অগাষ্ট বিকেলে রিহার্সাল হবার কথা শুনে এক ঝটিকা সফর দেবার পরিকল্পনা করি। ঘরে ঢুকে দেখি কবি ফেরদৌস নাহার এবং রোজিনা করিম কনক উপস্থিত রয়েছেন, রিহার্সাল চলছে পুরোদমে। কনক প্রাণের অনুভূতি যতটুকু ছড়ানো সম্ভব ছড়িয়ে বলছেন, “এর মাঝে দাদা এলেন। বাবা যা মুখ ফুটে বলতে পারেননি, তা দাদা বলে গেলেন। আমরা তোকে দেখে যাবো। তুই কিন্তু আবার হুট করে বাড়িতে চলে যাস না। তুইতো ভালোই আছিস এখানে। আরো বললেন, চাকুরি পেয়েছেন, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণও পেয়েছেন। ঘৃণায় দাদার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। আমার ভেতরে প্রচণ্ড একটা ঘৃণা এলো মনুষত্ব্যের অপমৃত্যু দেখে। বাবা, দাদা, আমার সত্বীত্ব, মাতৃত্বের দাম নিয়েছেন সরকার থেকে? বাড়ি মেরামত করছে, ওরা ওঘরে থাকবে কি করে? ওদের কি একটুও মনে পড়বে না আঠারো বছরের একটি মেয়ের সত্বীত্বের দাম- যা সে দিয়েছিলো জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষায়!” শিউরে ওঠা বক্তব্য বটে !
মুখে তালা লাগিয়ে রিহার্সাল দেখতে থাকি; তারপরও ফিসফিস করে জানতে চাই, বাকিরা কোথায়? শুনতে পেলাম, ইশরাত জাহান দিপ্তীও আসছেন, তিনি পথে রয়েছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এদিন অগ্নিলা ইকবালের রিহার্সাল ছিলো না। অগ্নিলা এখন ঢাকায়।
কনকের অংশ শেষ হতেই কথা বলার সুযোগ পেয়ে মঞ্জুলীদিকে প্রশ্ন করি, কেন হঠাৎ করেই মঞ্চনাটক করার ইচ্ছা উদয় হলো, তা-ও আবার বীরাঙ্গনাদের নিয়ে, বলো? তিনি বিন্দুমাত্র না-ভেবেই, যেন জানতেন আমি এই প্রশ্নই করবো, ঝরঝরে গলায় উত্তর দেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছোট ছিলাম কিন্তু পরবর্তীকালে সবসময়ই মনে হতো, যাদের জন্য স্বাধীনতা ভোগ করছি, তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। এই বোধ থেকেই নীলিমা খালার বীরাঙ্গনাদের নিয়ে দিনপঞ্জী ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ যখন পড়লাম তখন এই চরিত্রগুলি নিয়ে কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে। আমি তিনটা চরিত্র বেছে নিয়ে সেগুলোর নাট্যরূপ দিতে চেষ্টা করেছি। একাত্তরে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাদের বীরাঙ্গনা বলা হলেও আমরা এঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধাই বলি, বলতে চাই।’
কনকের কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম স্ক্রীপ্ট পড়ার সময় আমার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামতো। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, সেসময় জন্মগ্রহণ না করলেও এই নাটকের মাধ্যমে আমার স্বপ্নের কিছুটা ইচ্ছাপূরণ ঘটেছে। অভিনয় করতে অহংবোধ করছি।‘
যৌথ-নির্দেশক ফেরদৌস নাহারের সঙ্গে কথা বলার আগেই দিপ্তীর আগমন এবং তাঁর অংশের রিহার্সাল শুরু। দিপ্তীর অংশ শুনছি, “দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে...এবার ছাড়া পাবেন। মুক্তি, কিন্তু কিসের মুক্তি?...বাসের ড্রাইভার বললো, আপা দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে পরে পয়সা দেবেন...”। দিপ্তীরও চোখেমুখে আবেগ, চোখ ছলছল। প্রবাসের তাড়াহুড়ার এই জীবনে মঞ্চনাটকে সময় দিচ্ছেন কেন? উত্তর আসে, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পার হলো, তারপরও বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেলেন না, আফসোস। যুদ্ধের অনেক বছর পরে জন্ম নিয়েও তাই বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে রচিত কাহিনীতে আগ্রহ নিয়েই জড়িয়েছি।
কবি ফেরদৌস নাহার কিভাবে জড়ালেন এর সঙ্গে? মঞ্জুলীদি বললেন, ‘ফেরদৌস আমার বন্ধু। আমরা অনেক কাজই একসঙ্গে করি, আমাদের মেলবন্ধন ভালো। তাই যখন নাট্যরূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন ফেরদৌসের সাহায্যই চাইলাম।’
তাঁর কথার সঙ্গে ফেরদৌস একমত হয়ে বললেন, ‘টরন্টোতে আমি একপ্রকার নির্বাসিত জীবনযাপন করি। কিন্তু যখন মঞ্জুলী ডাকলো, তখন সঙ্গতকারণেই এগিয়ে এলাম ওঁর আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করতে। এক্কেবারে পাকা তিনবছর পরে এরকম পাবলিকলি প্রচারিত হওয়া কাজে নিজেকে জড়ালাম। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, এটা পুরুষের অর্জিত, আমি তাতে একাত্ম হতে পারি না। ব্যাপক নারীরা নানাভাবে যুদ্ধে জড়িত থাকার পরও তাদের ত্যাগকে সেভাবে তুলে আনা হয়নি, ঢালাওভাবে শুধু পুরুষের শৌর্যবীর্যেরই ঢোল পেটানো হয়েছে। সেদিক দিয়ে নীলিমা ইব্রাহীমের বীরাঙ্গনাদের কাহিনী ব্যতিক্রম। এর বাইরেও টরন্টোয় প্রথম নারী নাট্যনির্দেশক ও নাট্যরূপকার হিসেবে মঞ্জুলী যখন তাঁর সাথে আমার সাহায্য চাইলো, তখন আর তাঁকে না করতে পারিনি।‘
‘লালন’ সাংস্কৃতিক মঞ্চের দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ তিনটি আলাদা আলাদা চরিত্র নিয়ে তৈরি। মোট দেড়ঘন্টার এ মঞ্চ নাটকটির আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার টরন্টোর সেন্ট কলম্বাস অডিটোরিয়ামে প্রথম শো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আলোক পরিকল্পনায় মিশুক মুনীর ও আমিনুল খোকন, শব্দ নির্দেশনা-মাহবুব মুক্তাদির অতল, মিউজিক, পোশাক পরিকল্পনা ও মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় মঞ্জুলী কাজী ও ফেরদৌস নাহার। জানা গেল, দর্শনীমূল্য হিসেবে ১৫ ডলার ধার্য্য করা হয়েছে যার টিকেট অগ্রীম পাওয়া যাবে টরন্টোর এটিএন বাংলা মেগাস্টোরে এবং প্রদর্শনীর দিন প্রদর্শনীস্থলে।
এবার উঠতে হয়। বাইরে শরতের বিকেলের আমেজ, আলো ক্রমে নিভে আসছে; কিন্তু না, একফালি চাঁদ ঠিকই দেখা যাচ্ছে আকাশে!
http://www.notundesh.com/binodon.html

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




