somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব : ২) – রাজকন্যা সারার বিয়ে

০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সৌদি রাজকন্যার জীবন কাহিনী (পর্ব-১)

মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনী অবলম্বনে।

রাজকুমারি সুলতানারা ছিলেন ১০ বোন আর একটা মাত্র ভাই। সুলতানা ছিল সবার ছোট আর তার ভাই ছিল তারচেয়ে ২ বছরের বড়। আমাদের দেশের মত সৌদিতেও অনেকের কাছে ছেলে সন্তানের মূল্য বেশী, মেয়ে সন্তানের চেয়ে। তার বাবার কাছেও সুলতানা ও তার বোনেরা ছিল অবহেলিত অথচ তার ভাই আলী যা চাইত তাই পেত। আলী আর সুলতানার ঝগড়া বিবাদে তার বাবা সব সময় আলীকে সমর্থন করতো। শাস্তি হিসাবে সুলতানার খেলনা আলীকে দিয়ে দিতেন। এমন কি একবার শাস্তি দিলেন যে এখন থেকে সুলতানার খাবার প্লেটে খাবার তুলে দেবে আলী। আর আলীও মজা পেয়ে সুলতানার প্লেটে মাংসের সব চেয়ে ছোট টুকরা তুলে দিত।

এই রকম পরিস্থিতিতে সুলতানার বাবা আরও পুত্র সন্তানের আশায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু এই স্ত্রী পরপর তিনবার মৃত পুত্র সন্তান প্রসব করে। তখন এই স্ত্রীকে সুলতানার বাবা তালাক দিয়ে দেন। সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে তার পিতা একে একে চারটি বিয়ে সম্পন্ন করে ফেলেন। শেষের স্ত্রী তাকে অনেকগুলি পুত্র সন্তান দেয়ার পর তাদের পরিবারে পুত্র সন্তানের আধিক্যের জন্য হাহাকার অবশেষে দূর হয়। তবে প্রথম পুত্র সন্তান হিসাবে আলীর মূল্য সর্বদাই ছিল অনেক বেশী।

সুলতানার দৃষ্টিতে পৃথিবীর অন্য সমাজে যুগে যুগে মানুষের মন মানসিকতার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে সউদি পুরুষেরা ১০০০ বছর আগে যেমন সঙ্কীর্ণ মনের ছিল এখনও তেমনি আছে বলে সে মনে করে। এই ব্যাপারে সে ইসলাম ধর্মকে দোষ দেয় না কারণ আমাদের রসুল (সাঃ) সব সময় মেয়েদের প্রতি সদয় ও ন্যায্য আচরণ করতে বলেছেন। সৌদি পুরুষরা মনে করে যে সমাজে তার মর্যাদা নির্ভর করে কয়জন মেয়ে তার অধীনে আছে এবং সে কিভাবে এদের উপর খবরদারী করছে। কোনও পুরুষ এভাবে না করলে সমাজে তাকে হেয় করা হয়। ছোট বেলা থেকেই সৌদি ছেলেদের শেখানো হয় যে মেয়েদের মূল্য কম এবং তারা শুধু ছেলেদের আরাম আয়েশের জন্য। মা ও বোনদের সাথে পিতার অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ দেখে দেখে সৌদির ছেলেরা এটাকেই স্বাভাবিক মনে করে, ফলে পরবর্তীতে কোনও মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করা এদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। প্রভু আর দাসীর সম্পর্ক এদের মগজে ঢুকে যায় ফলে বিয়ের পরে এরা স্ত্রীকে নিজের সম্পত্তি মনে করে। এইসব কারণে বেশীরভাগ সৌদি পুরুষ বিবাহিত জীবনে অসুখী। এই অসুখী জীবন থেকে মুক্তির জন্য এরা একের পর এক বিয়ে করে ও উপপত্নি খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এরা বুঝতে চায় না যে, মেয়েদের যথাযোগ্য মর্যাদা না দিলে একটা পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী কেউই সুখী হতে পারে না। সৌদি আরবে তখনও মেয়েদের জন্ম ও মৃত্যুর নথিভুক্তিকরণ খুব কম হতো কারণ হাসপাতালের বাইরে নিজ গৃহে অনেক শিশুর জন্ম হতো।
তেলের কারণে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন আরও ভালো হোল তখন সৌদি আরবের সাধারণ পরিবারগুলিও বাড়িতে বিদেশ থেকে আনা চাকর- চাকরানী রাখা শুরু করলো। ফলে কাজ না থাকাতে বাড়ির মেয়েদের জীবন আরও একঘেয়ে ও কর্মহীন হয়ে পড়লো। গরমের কারণে অধিকাংশ রাজপরিবারের সদস্যরা বছরের কয়েক মাস জেদ্দা ও তায়েফে কাটাত। ১৯৬৮ সাল নাগাদ সুলতানার বাবা অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। তার ৪ জন স্ত্রীর প্রত্যেকের জন্য রিয়াদ, জেদ্দা, তায়েফ ও স্পেনে চারটা চারটা করে ১৬ টি হুবহু একই রকম প্রাসাদ তিনি নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদের ভিতরের কার্পেট ও আসবাবপত্র পর্যন্ত হুবহু একই ছিল। সুলতানার বাবা সুলতানার মাকে সবসময় যে কোনো জিনিস কেনার সময় ৪ টি করে কেনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নিয়ম বাচ্চাদের আন্ডারওয়েরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। চার জায়গার প্রাসাদে বাচ্চাদের রুমের আলমারিগুলিতে হুবহু একই পোশাক, খেলনা, বই ইত্যাদি থাকত।

এই চারের নিয়ম অনুসরণ করে হঠাৎ তার ভাই আলীর জন্য কেনা হোল একই রকমের ৪ টি লাল দামী পরশে গাড়ি। তখন আলীর বয়স মাত্র ১৪ বছর। এত বাড়াবাড়ি দেখে তার মা বলতে বাধ্য হলেন যে যেখানে পৃথিবীর বহু লোক গরীব সেখানে এরকম কাজ লজ্জা জনক ও অপচয়। যদিও তার কথা গ্রাহ্য করার লোক তার স্বামী নয়। আলী তার ১০ বছর বয়সে স্বর্ণের রলেক্স ঘড়ি পায়। অথচ তখন সুলতানা বাবার কাছে তার জন্য একটা স্বর্ণের ব্রেসলেট চেয়ে পায়নি। এই কষ্ট সুলতানার মনে ছিল। দুই সপ্তাহ পরে সুলতানা সুযোগ পেয়ে গোপনে আলীর রলেক্স ঘড়িটা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে। আলীকে তার বাবা এই ক্ষতির জন্য বকা দেয়। কিন্তু এই ঘটনার ২ সপ্তাহ পর তাকে আরেকটি স্বর্ণের রলেক্স ঘড়ি কিনে দেয়। সুলতানা তার বাবার ভালোবাসা পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। শেষমেশ কিছু উলটাপালটা কাজ করেছে এই আশায় যে হয়ত তার বাবা তার দিকে দৃষ্টি দিবেন ও তাকে ভালবাসবেন। কিন্তু এতে আসলে কোনও কাজই হয়নি।

তার ভাই আলী ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। সুলতানার কুকুর ছানা সে তার বাবার প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নিয়েছিল। শেষমেশ সে ঐ কুকুর ছানাকে একদিন চলন্ত গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে সুলতানা এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার নিজের মত করে প্রতিশোধ নিত। কখনও সে আলীর নতুন মার্সিডিজ গাড়িতে বালি ছিটিয়ে দিত, কখনও তার বাবার মানি ব্যাগ থেকে টাকা সরাত, কখনও আলীর স্বর্ণমুদ্রা বাগানে পুতে ফেলত, কখনও সুইমিং পুলে সে সাপ ছেড়ে দিত যখন আলী গোসল করতো।

সুলতানার বয়স যখন ১৩ তখন তার নয় নম্বর বোন সারার বয়স ১৬ বছর। সারা ছিল অনেক সুন্দরী। সে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতো। তার স্বপ্ন ছিল সে ইতালিতে গিয়ে ছবি আঁকা শিখবে এবং জেদ্দাতে তার আর্ট গ্যালারী খুলবে। তার সব সাধ ধুলায় মিলায় যখন তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ৬২ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ বড় ব্যবসায়ীর সাথে যার তখনই দুই স্ত্রী ছিল। সারা বিভিন্নভাবে তার বিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করলো। তার মা ছিল এই ব্যাপারে তার বাবার কাছে নিতান্ত অসহায়। সারা প্রতিদিন তার বাবার অফিসে ফোন করে বার্তা পাঠাতো যে সে বিয়েতে রাজি না। এমন কি সে তার হবু বরের অফিসের সেক্রেটারিকেও বার্তা পাঠিয়েছিল। এসব জেনে তার বাবা তাদের বাসার ফোন লাইন কেটে দেয় এবং তাকে একটা রুমে আটকে রাখে।


বিয়ের দিন সকালে সারার খালা, ফুফু ও কাজিনরা তাদের বাসায় আসে। সারার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আত্মীয়ারা তার মাথার চুল আর চোখের ভুরু ছাড়া সমস্ত দেহের পশম তুলে ফেলার ব্যবস্থা করে। চিনি, গোলাপজল ও লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে চুলায় গরম করে পেস্ট বানানো হয় তার গায়ে দেয়ার জন্য। এই পেস্ট গায়ে দিয়ে শুকানোর পর যখন এটা ধীরে ধীরে তুলে ফেলা হোল তখন তার সাথে দেহের সমস্ত পশম উঠে গেলো। কিন্তু তারা এই সময় সারার ব্যথার দিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ করল না।

সারার বাবা প্রাসাদের একজন পাকিস্তানি ডাক্তারকে দিয়ে সারার দেহে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করিয়েছিল যেন সে কোনও ঝামেলা না করতে পারে। ডাক্তার সারার স্বামীর কাছে সারার জন্য অনুরুপ ট্যাবলেট দিয়ে দেয়। তবে স্বামীকে বলা হয় যে সারার বিয়ের দুশ্চিন্তাজনিত পেট ব্যথা দূর করার জন্য এই ট্যাবলেট। বিয়ের অনুষ্ঠানে সাধারণ শ্রেণীর সৌদি মহিলারাও দাওয়াত পায়। এরা নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। অনেকে বলে যে অনেক সময় অনেক পুরুষ, মেয়ে দেখার জন্য নেকাব পরে মেয়েদের এলাকায় প্রবেশ করে। বিয়েতে মদ থাকে না প্রকাশ্যে, তবে অনেক রাজপরিবারের মেয়ে তাদের ব্যাগে মদ রাখে ও খাওয়ার পরে ওয়াশ রুমে গিয়ে অল্প মাত্রায় চেখে দেখে। মিশরের বেলি ড্যান্সার আনা হয়েছিল। সুলতানার এক বয়স্ক খালা এক পর্যায়ে মঞ্চে উঠে বেলি ড্যান্সারদের সাথে নাচতে থাকে। সৌদি বিয়েতে মেয়েরা উলুধ্বনি দেয় ভারতবর্ষের হিন্দুদের মত। বরের বয়স ছিল সুলতানার বাবার চেয়েও বেশী। এভাবে ধুমধাম করে সারার বিয়ে হয়ে গেলো সারার বিষণ্ণ মনকে তোয়াক্কা না করে। পরের পর্ব শুরু হবে এই বিয়ের বিচ্ছেদ দিয়ে। আশা করি পরের পর্বের জন্য আপনারা ধৈর্য ধারণ করবেন। (চলবে)
ছবি - ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:২৫
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×