সুলতানার স্বামী কারিম তার নবজাত পুত্রের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সুলতানার হাসপাতাল সুইটের দরজায় সশস্ত্র প্রহরী নিযুক্ত করেছিল। একদিন অন্য একটা রুমের সামনেও সশস্ত্র প্রহরী দেখে সুলতানা ভাবলো যে হয়তো আরেকজন রাজকুমারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সুলতানার জন্য লন্ডন থেকে আনা সেবিকা তার ভুল ভাঙ্গিয়ে তাকে আরেকটা ভয়ংকর ঘটনা শোনাল। কাহিনীটা খুবই মর্মান্তিক। সংক্ষেপে বললে বলা যায় একটা তেরো বছরের নির্দোষ অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে কতল করা হবে কারণ সে নাকি ব্যভিচার করেছে। আসলে কিছু ছেলে তাকে ধর্ষণ করেছিল। পরে তারা মেয়েটার উপর ব্যভিচারের দোষ চাপিয়ে দেয়। তাকেই ধরে এনে হাসপাতালে পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে এবং বাচ্চার জন্মের পর তার শাস্তি কার্যকর করা হবে। মেয়েটা যদি ব্যভিচার করেও থাকে তারপরও তার শাস্তি হওয়ার কথা বড়জোর জেল ও বেত্রাঘাত। কিন্তু একটা কারণে তাকে কতল করা হবে। কারণটা জানার জন্য মূল বইটা পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি। ব্যভিচারের কারণে কতলের আরেকটা ঘটনাও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে বইয়ে। অনুরোধ করবো মূল বইটা পড়ার জন্য এই সব ভয়ংকর ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য।
সারা আর আসাদের প্রেম আরও জোরালো হয়েছে। আসাদ ইতিমধ্যে সারার বাবার সাথে কথা বলেছে এবং ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। তিন মাসের মধ্যে সারা ও আসাদের বিয়ে হবে। সারা ঠিক করেছে যে আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে ও আসাদ বাহরাইন গিয়ে গোপনে দেখা করবে ও সময় কাটাবে। সুলতানা এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করলে ভালো। না করলেও তার সিদ্ধান্ত সে পরিবর্তন করবে না। সারা বাবাকে বলবে সে সুলতানার কাছে আছে আর বড় বোন নুরা সুলতানার সাথে দেখা করতে আসলে তাকে জানানো হবে সে বাড়ি ফিরে গেছে। তার ধারণা কেউ বুঝতে পারবে না যে ওরা আসলে কোথায় আছে। সৌদি আরবের বিমান বন্দরে মেয়েদের স্বামী বা বাবার লিখিত অনুমতি লাগে প্লেনে চড়ে বিদেশ যাওয়ার আগে। আবার সারার পাসপোর্ট তার বাবার কাছে। সুলতানা তাই সারাকে জিজ্ঞেস করলো তাহলে তোমরা কিভাবে যাবে। সারা বলল যে সে তার এক বান্ধবীর পাসপোর্ট আর তার পিতার অনুমতি পত্র জোগাড় করেছে। মেয়েটার একজন আত্মীয়ের অসুস্থতার কারণে তার বাহরাইন যাত্রা বাতিল হয়েছে। এই পাসপোর্ট আর অনুমতি পত্র ব্যবহার করে সে যাবে কারণ নেকাবের কারণে বিমান বন্দরের কেউ তাকে চিনবে না। সুলতানার বর্ণনা মতে সৌদি আরবের অনেক মেয়ে এই পন্থা অবলম্বন করে বিদেশ ভ্রমণ করে। সারা বলল যে, পরে উপকারের প্রতিদান হিসাবে সেও একটা বিদেশ যাত্রার সিদ্ধান্ত হঠাৎ বাতিল করবে এবং তার পাসপোর্ট আর অনুমতি পত্র দিয়ে ঐ বান্ধবী বিদেশ ভ্রমণ করবে। সুলতানা প্রথমে তাকে নিষেধ করলো পরে মনে ভয় নিয়েও রাজি হোল। সারা বলল যে আসাদ বাহরাইনে তার এক বন্ধুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছে।
১৯৭৫ সালে সুলতানার ছেলে আবুদুল্লাহর দ্বিতীয় জন্মদিনে সুলতানাদের নিজস্ব বিমানে ফ্রান্স থেকে একটা সার্কাস দল আনা হোল এক সপ্তাহর জন্য। ইতিমধ্যে সারা আর আসাদের বিয়ে হয়ে গেছে ও সারা তখন অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ের আগে বাহরাইনে দুঃসাহসী ভ্রমণ শেষে ওরা নিরাপদে দেশে ফিরেছিল। আনন্দের আতিশয্যে আসাদ তাদের অনাগত সন্তানের জন্য কেনাকাটা করতে প্যারিস চলে গেল এবং তিনটি বড় স্টোরের সমস্ত বাচ্চাদের পোশাক কিনে ফেললো।
বাদশাহ ফয়সাল ও তার স্ত্রী ইফফাতের প্রচেষ্টায় সৌদি আরবের মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হওয়ার কারণে মেয়েদের উপর কঠোর নিয়ম কানুন কিছুটা শিথিল হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়ে সাহস করে নিকাব ছাড়াই মুখ খোলা রেখে চলাফেরা শুরু করে। এদের সাহসিকতায় মুতওয়ারাও কিছু বলতে পারতো না। তবে মেয়েরা বোরখা ও হিজাব ত্যাগ করেনি। মেয়েদের জন্য নতুন নতুন স্কুল তৈরি করা হচ্ছিল।
ইতোমধ্যে সুলতানা ও কারিম আরও ৪ টি প্রাসাদোপম বাড়ির মালিক হয়েছে। প্রথমটা রিয়াদে, দ্বিতীয়টা জেদ্দাতে, তৃতীয়টা লন্ডনে ও চতুর্থটা কায়রোতে। তাদের পুত্র আবুদল্লাহর জন্মের সময় প্যারিস থেকে তাদের পারিবারিক জুয়েলারস এসেছিল ডায়মন্ড, রুবি আর ইমেরালড দিয়ে তৈরি নেকলেস, ব্রেসলেট আর কানের দুল নিয়ে।
কারিম একদিন তার ছেলেকে খেলতে দেখে তার নিজের ভাগ্যের প্রশংসা করলো। সুলতানা তাকে বলল যে এভাবে করলে বাচ্চার গায়ে নজর লাগতে পারে। সৌদি আরবে নজর লাগা ঠেকানোর জন্য বাচ্চার জামাতে নীল রঙের একধরনের মালা পড়ানো হয়। আব্দুল্লাহকেও অনুরুপ মালা পড়ানো হয়েছিল যেন তার উপর নজর না লাগে।
হঠাৎ একদিন আসাদ এসে জানালো যে বাদশাহ ফয়সাল একজন আত্মীয়ের হাতে খুন হয়েছেন। দশ বছর আগে দেশের প্রথম টেলিভিশন স্টেশন চালু করা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হয়। টেলিভিশন স্টেশন চালু করাকে অনেকে ইসলাম বিরোধী মনে করতো। তবে বাদশাহ ফয়সাল সব সময়ই দেশের আধুনিকায়নে বিশ্বাস করতেন। কারিম বলল যে সে বাদশাহ ফয়সালকে বলতে শুনেছে যে সৌদিরা পছন্দ করুক বা না করুক আমি এদেরকে টেনে হিঁচড়ে হলেও বিংশ শতাব্দীতে নিয়ে যাব। সমাজের কিছু গোঁড়া মন মানসিকতার আলেম ও তাদের কিছু সমর্থক সর্বদা এই ধরণের কাজে বাধা সৃষ্টি করতো। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার পিতা আব্দুল আজিজও একই ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এর আগে প্রথম রেডিও স্টেশন চালু করার সময়ও এরা বাধা সৃষ্টি করেছিল। এদের নিবৃত করতে কোরআনের বাণী নিয়মিত রেডিওতে তেলাওয়াত করা হতো। বাদশাহ ফয়সাল বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র নারী শিক্ষার মাধ্যমে মেয়েদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব কারণ অজ্ঞতাই মেয়েদেরকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। সুলতানার মতে বাদশাহ ফয়সাল ছাড়া আর কোনও বাদশাহ মেয়েদের দুর্দশা দূর করতে মেয়েদের পাশে থাকেনি। রাজপরিবারের নারীরা নিজেদের মধ্যে এই হত্যার জন্য ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে। পুরো দেশবাসী শোকে নিমজ্জিত হয়।
১৯৬৫ সালে যখন প্রথম টেলিভিশন স্টেশন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয় তখন রাজপরিবারের কিছু সদস্যও এইসব প্রতিবাদকারীদের সাথে শামিল হয়েছিল। সুলতানার এক গোত্রীয় ভাইও এই প্রতিবাদীদের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে টেলিভিশন স্টেশন ঘেরাও করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ১০ বছর পর সেই প্রিন্সের এক ভাই বাদশাহ ফয়াসালকে গুলি করে হত্যা করে তার ভাই হত্যার বদলা নেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর সারা একটি মেয়ে সন্তানের মা হয়। সারা আসাদকে একটা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে যার মধ্যে লেখা ছিল যে সারার মেয়ে ফাদিলা বড় হলে পরিবারের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজের পছন্দ মত স্বামী বেছে নিতে পারবে। সারা একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। সারা স্বপ্নের মধ্যে দেখে যে একটা বিমান দুর্ঘটনায় সে ও আসাদ মারা গেছে কিন্তু তাদের মেয়ে বড় হচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্কীর্ণ মন মানসিকতার মধ্যে। আসাদ সারাকে অনেক ভালবাসে তাই সে নির্বিবাদে কাগজে সাক্ষর করে দেয় এবং মেয়ের জন্য ১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সুইস ব্যাঙ্কে হিসাব খুলে দেয়।
সুলতানার বড় ভাই আলী আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে আসলে একদিন পরিবারের সবাই রাতে খাওয়ার জন্য একত্র হয়। মেয়েদের গাড়ি চালানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় পরিবারের সদস্যরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বিষয়টির পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে আলী বলে যে মেয়েদের গাড়ি চালাতে দিলে ওরা ছেলেদের মত রাস্তায় গাড়ির রেস করবে। ছেলেদের অনুকরন করতে যেয়ে তারা শুধু দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়াবে। এই কথা শুনে সুলতানা মাথা ঠিক রাখতে না পেরে আবার তার ছোটবেলার রূপ গ্রহণ করে। সে লাফিয়ে গিয়ে আলীর চুল ধরে প্রচণ্ডভাবে টানাটানি শুরু করে। কারিম ও সুলতানার বাবা অনেক কষ্ট করে সুলতানাকে আলীর কাছ থেকে সরিয়ে আনে। ওর কাণ্ড দেখে বাকি বোনদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়।
পরের দিন আলী সুলতানার সাথে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলে কারণ তার পরের দিন সে আমেরিকা চলে যাবে। এবারের ছুটিতে আলীর সাথে রাজপরিবারের এক মেয়ের ইতিমধ্যে বাগদান হয়ে গেছে। সে চায় তার হবু স্ত্রী হবে সতী-সাধ্বী। আলীর সাথে কথা বলার সময় আবারও মেয়েদের প্রসঙ্গ আসলে সুলতানা স্বীকার করে যে সৌদি আরবে অক্ষতযোনি মেয়ে পাওয়া এখন দূষকর ব্যাপার। আলী জিজ্ঞেস করে এই মেয়েগুলি বিয়ের রাতে কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কারণ আরবে বাসররাতের রক্ত মাখা বিছানার চাদর শাশুড়ির হাতে দিতে হয়। রক্ত না পাওয়া গেলে পরের দিন বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। সুলতানা বলে যে অনেক মেয়ে তাদের হাইমেন অপারেশন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়। এইসব মেয়েরা স্বেচ্ছায় বিয়ের আগে এমন লোকের কাছে কুমারিত্ত বিসর্জন দেয় যাদেরকে কেউ কখনো সন্দেহও করবে না। কোনও কারণে অপারেশন করা সম্ভব না হলে মিলনের আগে মেয়েরা ভেড়া/ দুম্বার কলিজা তাদের যৌনাঙ্গের ভিতরে দিয়ে রাখে। স্বামী বা শাশুড়ির পক্ষে রক্ত আর রক্তাক্ত কলিজার পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। যদিও সুলতানা বইয়ের পরের অংশে উল্লেখ করে যে ভেড়ার কলিজার গল্পটা আসলে সে আলীকে বোকা বানানোর জন্য বলেছিল।
মার্কিন লেখিকা জিয়ান সেসন (Jean Sasson) এর বই Princess: A True Story of Life Behind the Veil in Saudi Arabia তে বর্ণিত রাজকন্যা সুলতানার জীবন কাহিনীর সারসংক্ষেপ।
ছবি – ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪০