প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন ভাঙ্গাচুরা স্কুলে পড়াশুনা করেও অনেক মানুষই তাদের কর্মজীবনে এখন চরম সফল। আমাদের আশেপাশে খুজলেই আমরা এই রকম অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। এই ব্লগেও হয়ত এরকম অনেকে আছেন। কিন্তু বর্তমান যুগের অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে নামকরা স্কুলে দেয়ার জন্য ঘুষ পর্যন্ত দিচ্ছেন। শোনা যায় দেশের নামকরা কয়েকটা স্কুলে মেধার পাশাপাশি ঘুষের বিনিময়ে ভর্তি করা হচ্ছে। দুই একটা ঘটনা আমিও জানি। কিন্তু শুধু জিপিয়ে মানেই কি মেধা আর সফলতা? আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা ভালো ফলাফল করে এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে অখ্যাত স্কুল/ কলেজ থেকে। কর্মক্ষেত্রেও দেখা যায় যে অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনা করে কর্মজীবনে এখন সামনের দিকে আছে। আমি অনেক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলেকে হাইস্কুলে এবং পরবর্তী জীবনে অনেক ভালো করতে দেখেছি। অনেকে এমনকি দেশের বাইরেও অনেক ভালো আছে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলিতে আমাদের যারা প্রবাসী আছেন তাদের একটা বড় অংশ আছেন যারা দেশে সাধারণ স্কুল/ কলেজ থেকে পড়ালেখা করেছেন এবং বর্তমানে সফল।
একটা নামকরা স্কুলে অবশ্যই ভালো ফলাফল করার জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা থাকে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যারা প্রকৃত মেধাবী তাদেরকে প্রতিকুল পরিবেশও সাধারণত দমিয়ে রাখতে পারে না। লেখাপড়ায় ভালো করতে হলে মেধা, শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায় থাকতে হয়। মেধাটা মুলত আল্লাহপ্রদত্ত। এটাকে ঝালাই করে কিছু বাড়ানো হয়তো যায়। আর অবহেলা করলে মেধাবী মানুষও ব্যর্থ হয়। মানুষ চেষ্টা করলে অধ্যবসায় এবং শৃঙ্খলা অর্জন করতে পারে। এই কারণেই অনেক অখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছেলেমেয়েরা শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে উপরে উঠে যায়। যাদের মেধা কম তারাও শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ভালো ফলাফল করতে পারে।
অখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছেলেমেয়েরাও যদি উদ্যমী ও পরিশ্রমী হয় তাহলে তারাও ভালো করতে পারে। তবে তারা অনেক ক্ষেত্রে ভালো দিকনির্দেশনা, ভালো শিক্ষক, ভালো নোট, ভালো ব্যবহারিক শিক্ষা পায় না। এই কারণগুলির জন্য তাদেরকে ভালো স্কুলের ছেলেমেয়েদের চেয়ে অনেক বেশী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এই ক্ষেত্রে ভালো স্কুলগুলি সুবিধা ভোগ করে। এটা একটা বড় সমস্যা। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকদের এবং শিক্ষা বিভাগের কর্তা ব্যক্তিদের উচিত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে ভালো শিক্ষক, ভালো পড়াশুনার উপকরণ, লাইব্রেরী ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। আর দেশের প্রাইমারি ও হাইস্কুলের হেডমাস্টারদের বিশেষ ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করা উচিত যেন তারা দেশের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মত সুন্দর প্রশাসন ও শৃঙ্খলা তাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরি করতে পারে।
একটা নামকরা স্কুল আর অখ্যাত স্কুলের মধ্যে মূল পার্থক্য হোল নামকরা স্কুলগুলিতে শৃঙ্খলা বেশী। অনেক নামকরা স্কুলের শিক্ষক আছেন যারা সাধারণ মানের। কিন্তু স্কুলের কড়া নিয়ম কানুনের কারণে স্কুলের ছেলেরা পড়াশুনা করতে বাধ্য হয় এবং ভালো ফলাফল করে। সাধারণ স্কুলগুলিও যদি নিয়ম শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করে তাহলে এই স্কুলগুলির ছেলেমেয়েরাও ভালো ফলাফল করবে।
শিক্ষার্থী নিজে যদি দৃঢ় সংকল্প করে তাহলে সাধারণ স্কুলে থেকেও তার পক্ষে ভালো ফলাফল করা সম্ভব। স্কুলের টেক্সট বই ভালো করে পড়লে এবং শিক্ষক ভালো হলে প্রাইভেট পড়তে হয় না। আমি আমার স্কুল জীবনে একমাস শুধু প্রাইভেট পড়েছিলাম পরীক্ষামূলকভাবে। কিন্তু এখন সমস্যা হোল অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে কোচিং না করলে আর ভালো স্কুলে না পড়লে ভালো ফলাফল করা যায় না। সংকল্পের দৃঢ়তা থাকলে সাধারন স্কুলে থেকেও ভালো ফলাফল করা সম্ভব। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের ৮০% নির্ভর করে শিক্ষার্থীর নিজের যোগ্যতা ও প্রচেষ্টার উপর আর বাকি ২০% নির্ভর করে সে কোন স্কুলে পড়ছে।
তাই সর্বশেষে বলব যে নামকরা স্কুলে ভর্তি হতে পারলে ভালো। কিন্তু যারা সাধারণ স্কুলে পড়ছে তাদের এই কারণে হীনমন্যতায় না ভুগে লেখাপড়ায় মন লাগাতে হবে। চেষ্টা করলে তারাও অনেক ভালো ফলাফল করতে পারে। অনেকে করেও। বাকিরাও চেষ্টা করলে পারবে। ঘুষ দিয়ে ভালো স্কুলে ঢোকা কিংবা কোচিং নির্ভর পড়াশুনা কোন ভালো লক্ষণ না। সামান্য কিছু প্রতিবন্ধকতা ছাড়া ভালো ফলাফলের মূল চাবিকাঠি শিক্ষার্থীর হাতেই থাকে। আর সাধারণ স্কুলের শিক্ষার্থীরাও কর্মজীবনে যে অনেক ভালো করছে এই কথা তারা যেন ভুলে না যায়। আরেকটা কথা হোল কর্মজীবনে শুধু গ্রেড দিয়ে ভালো করা যায় না। গ্রেডের পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন, ইন্টার পারসোনাল কমিউনিকেশন স্কিল, নেটওয়ারকিং, প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা করার মানসিক সক্ষমতা, কর্মের উপযোগী ব্যবহারিক জ্ঞান, আইসিটি নলেজ ইত্যাদিও জরুরী। এগুলি না থাকলে ভালো গ্রেড থাকা সত্ত্বেও অনেকে কর্মজীবনে ভালো করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১২:৩০